প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: আপনি যদি পশ্চিমা মতবাদের দুটি কেন্দ্রীয় নীতি এবং ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পর্কে প্রচারণা বিশ্বাস করেন, যেমন-রাশিয়ার আগ্রাসন ছিল উসকানিহীন এবং ইউক্রেনের সীমানা ছাড়িয়ে মস্কোর সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে, তাহলে আপনি স্বাভাবিকভাবেই ন্যাটোকে এ হুমকির বিরুদ্ধে সর্বোত্তম প্রতিরক্ষা হিসাবে বিবেচনা করবেন।
তবে আপনি যদি ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দেন এবং রুশ কর্মকর্তারা আসলে যা বলছেন, করেছেন এবং এ যুদ্ধের শুরুতে তাদের আচরণগুলো খতিয়ে দেখেন, তাহলে আপনি সিদ্ধান্তে আসবেন যে, ন্যাটোর প্রতি ইউক্রেনের ক্রমবর্ধমান আচ্ছন্নতা এবং দনবাসে রুশ ভাষাভাষীদের ওপর ইউক্রেন কর্তৃক জাতিগত নির্মূলকরণ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার ঘটনা রাশিয়াকে আগ্রাসনের ব্যাপারে ব্যাপকভাবে প্ররোচিত করেছিল।
যদি কাল্পনিক কাহিনির পরিবর্তে বাস্তব ঘটনাগুলো খতিয়ে দেখেন, তাহলে আপনি এটিও লক্ষ করবেন যে, মস্কোর সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষার বর্ণনাটি ২০১৪ সালের দিকে কিয়েভে মার্কিন-সমর্থিত নব্য-নাৎসি অভ্যুত্থান চেষ্টার পর তৈরি করা হয়েছিল। সেই সময়ের আগে, অধ্যাপক জন মিয়ার্সহাইমার যেমনটা উল্লেখ করেছেন, পুতিনকে সাম্রাজ্যবাদী হিসাবে বিবেচনা করা হতো না।
কিন্তু একবার যখন ন্যাটো রাশিয়ার আঙ্গিনার সামনে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে উপস্থিত হয়, তখন মস্কোকে সাম্রাজ্যবাদী হিসাবে বর্ণনা করা খুব প্রয়োজনীয় বলে প্রমাণিত হয়। ন্যাটো এমন একটি বিপদ তৈরি করেছে, যার সমাধানের জন্য জোটটির আরও সদস্য প্রয়োজন। এখন সেই জগাখিচুড়ি পরিস্থিতি লাখ লাখ ইউক্রেনীয় সেনা এবং হাজার হাজার রাশিয়ানকে হত্যা করেছে। এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার খুব কাছে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে, যখন পারমাণবিক হুমকির কারণে মানবতা টলায়মান।
ন্যাটো না থাকলে ধারাবাহিক এসব ঘটনার কিছুই ঘটত না। সামরিক জোটটির রাশিয়ার দিকে পূর্বমুখী এমন উন্মাদনাপূর্ণ সম্প্রসারণও ঘটতো না। অনেক প্রতিশ্রুতিই পশ্চিমা কর্মকর্তারা ভঙ্গ করেছেন। মস্কো কয়েক দশক ধরে বলে আসছিল, কিয়েভ ন্যাটোতে যোগ দিলে রাশিয়া ইউক্রেনকে ধ্বংস করবে। এবং সেটাই ঘটছে। কেন? কারণ মস্কো ইউক্রেনের ন্যাটো জোটে থাকাকে অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসাবে বিবেচনা করে, যা সম্ভবত বাস্তব।
সত্যটা হলো, স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ন্যাটোরও বিলুপ্ত হওয়া উচিত ছিল। বহু মার্কিন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ এবং জাতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক এমনটাই বলেছেন। কিন্তু পশ্চিমারা তা বিলুপ্ত করার পরিবর্তে এটিকে বাঁচিয়ে রাখার অনুমতি দিয়েছে, জোটের সদস্যদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করেছে, যুদ্ধের মুনাফাখোর এবং অস্ত্র মোগলদের মানিব্যাগ মোটা করেছে এবং যুগোস্লাভিয়া, আফগানিস্তান, লিবিয়া শেষ করে এখন ইউক্রেনে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। তারা এখন চীন সাগর নিয়েও কথা বলছে। এমনকি গণতন্ত্রকে পঙ্গু করতেও ন্যাটো সাহায্য করছে, যেমনটা করেছে যুক্তরাষ্ট্রকে।
কীভাবে? সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর নতুন করে রাশিয়ার হুমকি তৈরি করে। ২০১৪ সালে কিয়েভে সিআইএ-সমর্থিত অভ্যুত্থানের পর সেখানে ন্যাটো সরঞ্জাম স্থাপন করে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে ডেমোক্রেটদের অপমানজনক পরাজয়ের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে রাশিয়াগেটের মতো বাজে ঘটনার জন্ম দিয়ে পুতিনকে খলনায়কে পরিণত করে হিলারি ক্লিনটন এবং বারাক ওবামা বেশ স্বচ্ছন্দবোধ করেছিলেন। এই বলে আমেরিকান জনসাধারণের মাঝে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হয় যে, মস্কো ইউরোপে আধিপত্য বিস্তার করতে চায়।
এমন আরও ছলচাতুরীর আশ্রয় নেওয়া হয়, বিশেষ করে ২০২০ সালের নির্বাচনি প্রচারণাকালে সাবেক মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এমন প্রোপাগান্ডাও চালানো হয় যে, হান্টার বাইডেনের (আইনজীবী) ল্যাপটপ রাশিয়ার মিথ্যা তথ্যে পূর্ণ ছিল; কিন্তু আদতে তা ছিল না। এমনকি হান্টার বাইডেন নিজেও তা বলেছিলেন। অবশ্য জো বাইডেনের নির্বাচনের সময় এসব প্রোপাগান্ডাকে আড়াল করা হয়, যেহেতু এসব বিষয় তাকে পরাজিতও করতে পারত। এটি আরেকটি ঝড়কে উসকে দিতে পারে বলেই আগের নির্বাচনে রাশিয়া কারসাজি করেছে-এমন সস্তা প্রচারণা থেকে তারা সরে আসে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় রাশিয়ার বিষয়ে যে প্রচারণাটি হয়েছিল, তা হোয়াইট হাউজ এবং এফবিআই সেন্সরের চেষ্টা করলে তা আরও খারাপের দিকে যায়। ইউক্রেনে দুর্নীতির মাধ্যমে বাইডেনের পরিবারের লেনদেনের প্রমাণ মিললেও সেবার নিরাপত্তা বিভাগ বিষয়টি বাতিল করে দেয়। যখন ন্যাটোর তৃষ্ণা মেটাতে প্রকাশ্য শত্রুর তাজা রক্তের প্রয়োজন হয়, তখন মস্কোকেই টার্গেট করা হয়, যে দেশটি দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী।
এ পরিস্থিতি আমাদের একজন শীর্ষস্থানীয় বিকল্প প্রেসিডেন্টের কথা মনে করিয়ে পীড়া দেয়। যেমন, অভিযুক্ত ট্রাম্প, যিনি এমনকি কারাগারে থেকেও প্রচারণা চালাতে পারেন এবং স্পষ্টতই সামরিক আইন জারি করার মাধ্যমে নিজেকে আজীবন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় দেখতে চান এবং তার শত্রুদের বিরুদ্ধে বিচারের নাটক পরিচালনা পর্যন্ত করতে পারেন। দ্বিদলীয় এ ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় হলো আমাদের জন্য একজন তৃতীয় পক্ষের প্রার্থী ঠিক করা এবং এর একজন চমৎকার উদাহরণ হতে পারেন বুদ্ধিমান ও করিৎকর্মা কর্নেল ওয়েস্ট (মার্কিন দার্শনিক)। অথবা শেষ পর্যন্ত বাইডেন যদি সঠিক কাজটা করেন, প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেন এবং সরে দাঁড়ান।
কিন্তু মার্কিন গণতন্ত্রের যেটুকু অবশিষ্ট আছে বাইডেন যে তা ধ্বংস করছেন, সেই বার্তাটি তিনি এখনো পাননি। তবে বাইডেন জানেন যে, তার বিরুদ্ধে ঘুসের অভিযোগ উঠতে পারে, বিশেষ করে পাঁচ মিলিয়ন ডলার পরিশোধের বিষয়ে। এখনো তার প্রেসিডেন্ট থাকার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও আত্মমুগ্ধতা তাকে চালিত করে, যা ক্রমেই তাকে ঝুঁকির মুখে নিয়ে ফেলছে, সবাই তার কাছ থেকে সরে যাচ্ছে। সম্ভবত তিনি ভেবেছেন, এ ধাক্কা সামলে উঠতে পারবেন। কোনো চাতুরী দিয়ে পাঁকে পড়া অবস্থা কাটিয়ে উঠবেন।
কিন্তু এখন এটি স্পষ্ট যে, তিনি তা পারবেন না। তার শালীনতা থাকা উচিত। তার জীবনের গোধূলি বেলায় অসুস্থ সুবিধাবাদিতাকে ত্যাগ করতে হবে, যা তাকে বেআইনি ইরাক যুদ্ধ পরিচালিত ও ত্বরান্বিত করতে চালিত করেছিল এবং ২০২১ সাল থেকে এ পর্যন্ত রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক ইস্যুতে যা করছেন। এখন তার ক্ষমতা থেকে সরে নজির স্থাপন করা উচিত। এবং ভাগ্য সহায় হলে ট্রাম্পও তার পথ থেকে সরে যেতে পারেন। শুধু রিপাবলিকান পার্টিই বিকল্প নয়। যে কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠী জলবায়ু সংকট মোকাবিলার জন্য ১ হাজার পৃষ্ঠার সব নিয়ম ও আইনকে ভেস্তে দিতে পারে, যেমনটা করেছিল ট্রাম্পের দল। এটি কোনো দল নয়, এরা মানবজাতির শত্রু।
ইতোমধ্যে যুগোস্লাভিয়া, আফগানিস্তান, লিবিয়াকে রক্তাক্ত করে এখন ইউক্রেনকে প্রায় শেষ করে ন্যাটো তার ক্ষুধার্ত দৃষ্টি তাইওয়ানের দিকে ঘুরিয়েছে। ভ্যাম্পায়ারের সুপরিচিত ও কলঙ্কজনক ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও তাইওয়ান তা বুঝতে পারেনি। আমেরিকার হুমকিতে দ্বীপটির প্রতিক্রিয়া কী? ‘আপনি যা বলবেন আমরা তাই করব, গুরু। বন্দুক পাঠাও।’ ওহে, এটা কি আত্মঘাতী না অন্যকিছু? হতে পারে বাইডেন বা কোনো রিপাবলিকান নেতার দ্বারা দূরপ্রাচ্যে হামলার ঘটনা ঘটবে না। হতে পারে মানবতা আরও একবার পারমাণবিক ফাঁসির রজ্জু থেকে রক্ষা পাবে। হতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সাম্রাজ্যের আকার আর বাড়াবে না এবং ন্যাটোকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনবে। তবে এতটা আশা করা সম্ভবত একটু বেশিই হবে।
বাইডেনের উপস্থিতিতে দুবার ইউক্রেন আক্রমণ করেছে রাশিয়া-যখন তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্বে ছিলেন, এরপর আবার ২০২২ সালে কমান্ডার ইন চিফ হিসাবে। উভয় ক্ষেত্রেই মস্কোকে উসকানি দেওয়া হয়। সম্ভবত বাইডেনের ইতিহাসের রায় মেনে নেওয়ার সময় এসেছে যে তিনি এ সমস্যার অংশ; তিনি এ দুটি ভয়াবহ হামলায় ভূমিকা রেখেছেন এবং তাই এর কোনো সমাধান হতে পারে না। বাইডেনের জন্য সঠিক ও শোভনীয় কাজটি করার সময় এসেছে : চলে যাওয়া। এটি ইউক্রেন, তাইওয়ান এবং সম্ভবত আমাদের বাকিদের পারমাণবিক বিপর্যয় সৃষ্ট পরিস্থিতি থেকে জীবন বাঁচাতে পারে। কিন্তু তার অতীতের কর্মকাণ্ড যদি বিচার করেন-কখনো কি অন্য মানুষের জন্য নিঃস্বার্থ উদ্বেগ তাকে তাড়িত করেছে?
কাউন্টারপাঞ্চ থেকে ভাষান্তর : খালিদ বিন আনিস
ইভ ওটেনবার্গ : মার্কিন ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক
প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ০২ সেপ্টেম্বের ২০২৩ /এমএম