প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনী হত্যাকাণ্ডের ১১ বছর পার হয়ে গেলেও এখনো মামলাটির তদন্ত শেষ হয়নি। এ তদন্তই হলো কোনো মামলার প্রাথমিক ধাপ। অথচ তদন্তকারী সংস্থা র্যাব এরই মধ্যে তদন্ত জমা দেওয়ার জন্য ১০০তম বার সময় বাড়ানোর আবেদন করলে আদালত তা মঞ্জুর করেন। কিছুদিন পরপর সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ডের তদন্ত জমা দেওয়ার বিষয়ে গণমাধ্যমে খবর হয়। সেসব খবরে এ মামলার তদন্তের অগ্রগতি কতটুকু হলো সে তথ্য না থাকলেও, তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় কতবার পেছানো হলো সে খবরই থাকে। বাংলাদেশের ইতিহাসে দীর্ঘ এগারো বছর ধরে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় এভাবে পেছানোর নজির নেই। অতীতে বিচারকার্যের দীর্ঘসূত্রতা হতে দেখেছি, কিন্তু কোনো একক ঘটনার তদন্তে এমন দীর্ঘসূত্রতা হতে দেখিনি।
সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ডের তদন্ত নিয়ে যা চলছে তা সত্যিই নজিরবিহীন। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সাগর-রুনী হত্যার পর যে মামলা হয়, সে মামলার তদন্তকারী সংস্থারও পরিবর্তন হয়েছে কয়েকবার। প্রথমে এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন শেরেবাংলা নগর থানার একজন এসআই। চারদিন পর এ হত্যা মামলার তদন্তভার হস্তান্তর হয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ বা ডিবির কাছে। দুই মাসেরও বেশি সময় নিয়েও ডিবি এ রহস্যজনক হত্যাকাণ্ডের তদন্ত সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তী সময়ে আদালতের নির্দেশে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হত্যা মামলাটির তদন্তভার দেওয়া হয় র্যাবকে।
হত্যাকাণ্ডের পরপরই সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেফতার করা হবে। ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে তৎকালীন আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছিলেন, তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে; কিন্তু তারপরই হঠাৎ থমকে যায় তদন্তের অগ্রগতি। হত্যাকাণ্ডের রহস্যের জট তো খুলেইনি বরং আরও ঘনীভূত হয়েছে। ২০১২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েই মহীউদ্দীন খান আলমগীর ১০ অক্টোবরের মধ্যে সাগর-রুনীর হত্যা রহস্য উদ্ঘাটিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছিলেন। তারপর ৯ অক্টোবর ‘চমক দেওয়া’ সংবাদ সম্মেলনে একজনকে ধরতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন। পরে সেই ব্যক্তিকে ধরাও হয়েছিল, কিন্তু ঘটনার রহস্য আর উন্মোচিত হয়নি। এরপরই এ হত্যার পেছনে কে বা কারা জড়িত তাদের নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে নানা কিচ্ছা-কাহিনি। অনেকে বলেছেন, প্রভাবশালী কেউ এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকতে পারেন।
শোনা গিয়েছিল, দেশের এক প্রভাবশালী মহলের নানা কুকীর্তির বেশকিছু বিশ্বাসযোগ্য দলিল সাংবাদিক সাগরের হস্তগত হয়েছিল, যা প্রকাশ পেলে ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে তার। আবার অনেকেই মনে করছেন, হত্যাকাণ্ডের আসল মোটিভ থেকে সবার দৃষ্টি আড়াল করার জন্য সাগর-রুনীর চরিত্রে কলঙ্কলেপনেরও চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি পুলিশ চুরির তত্ত্ব নিয়েও তখন হাজির হয়েছিল। গ্রিল কাটা চোর নিয়ে মহড়া করে সেটা ভিডিও করেছিল। এসব নানা তত্ত্ব যখন বাজারে ছড়ায়, তখন অনুমান করা যায়, ঘটনার আসল তদন্ত হচ্ছে না। এসবের উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষের মনে নানা প্রশ্নও দেখা দেয়। অনেকেই তখন বলেছিলেন, তদন্ত সঠিক পথে চলছে না বলেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকেই উদ্দেশ্যমূলকভাবে নানারকম গুজব ছড়ানো হয়েছিল।
চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্ত নিয়ে সংশ্লিষ্টরা মোটেও তৎপর নন বলেই অভিযোগ আছে। হত্যাকাণ্ডের পর এতগুলো বছর চলে গেলেও বিচার তো দূরে থাক, কী কারণে এবং সম্ভাব্য কারা খুন করেছে, সেটাও জানা গেল না। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ পেছানোর হার দেখে খোদ আদালতের কর্মকর্তারা বলছেন, কোনো মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য এত সময় নেওয়া হয়, এমনটি আগে কখনো দেখেনি। প্রশ্ন হচ্ছে, র্যাব তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারল না কেন? বাংলাদেশে র্যাবকে এলিট ফোর্স বলা হয়। আধুনিক প্রযুক্তি আছে তাদের। অতীতে এর চেয়েও জটিল ঘটনার রহস্যের উন্মোচনের রেকর্ডও আছে। তাদের কর্মক্ষমতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। সে আস্থা থেকেই ডিবি এ তদন্তে ব্যর্থ হওয়ায় আদালত র্যাবকেই এ কাজটি সম্পন্ন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, তদন্ত করতে গিয়ে এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে জড়িত এমন কিছুর সন্ধ্যান কি তারা পেয়েছেন, যা প্রকাশ করলে কারও জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে? এ ব্যাপারে তারা কি কোনো মহলের বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন?
এজন্যই কি তারা তদন্ত কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছেন না? এমন আরও অনেক প্রশ্ন মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে! ১০০তম বার সময় নিয়েও তদন্ত প্রতিবেদন জমা না দেওয়া র্যাবের মতো একটি এলিট ফোর্সের জন্য অস্বাভাবিক ঘটনাই বটে। তবে র্যাব এখনো বলছে, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সাগর-রুনী হত্যা মামলার তদন্ত করে যাচ্ছে তারা। সাগর-রুনী হত্যার প্রকৃত কারণ কী, কারা হত্যাকাণ্ডে জড়িত, সেটি সুনিশ্চিতভাবে বলার মতো সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ তাদের কাছে আসেনি। সংবাদমাধ্যমে জানা যায়, র্যাব এ পর্যন্ত আদালতে যতগুলো তদন্তের অগ্রগতি সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে, তাতে প্রতিটি প্রতিবেদনে প্রায় একই ধরনের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। হত্যারহস্য বা এসংক্রান্ত বিষয়ে কোনো তথ্যের উল্লেখ নেই।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, হত্যা মামলার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এযাবৎ আটজন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে। এ আটজনের মধ্যে দুজন অভিযুক্ত জামিনে আছেন। বাকি ছয়জন গত ১১ বছর যাবৎ কারাগারে আছেন। সন্দেহভাজন হিসাবে গ্রেফতার আটজনের একজনও এখন পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেননি। মামলার তদন্ত শেষ না হলেও এসব অভিযুক্তকে আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিয়ে যেতে হচ্ছে।
যেহেতু তদন্ত শেষ হয়নি, অভিযোগপত্রও দেওয়া হয়নি, সুতরাং আটককৃত ব্যক্তিদের মধ্যে কে অপরাধী, আর কে অপরাধী নন, তা চিহ্নিত করাও সম্ভব নয়। তদন্ত শেষে বিচার হলে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তি সাজা পাবেন, না হলে খালাস পেয়ে যাবেন। প্রশ্ন হচ্ছে, বিচার শেষে যদি কেউ নিরপরাধ প্রমাণিত হন, তাহলে অপরাধ না করেও কারাগারে আটকে রেখে যে ব্যক্তির জীবন থেকে এতগুলো বছর কেড়ে নেওয়া হলো, তার জবাব রাষ্ট্র কীভাবে দেবে?
এখন পর্যন্ত নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ার লজ্জা সবার আগে হওয়া উচিত সাংবাদিকদের, যারা তাদের দুই সহকর্মী হত্যার বিচার দাবিতে সেই অর্থে সোচ্চার হতে পারেননি। সাগর-রুনী হত্যার বিচার চেয়ে ঘটনার পরপরই আন্দোলনে নেমেছিলেন অনেকেই। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যে সেই আন্দোলনে ভাটা পড়ে। আন্দোলনে ভাটা পড়ার জন্য কিছু সাংবাদিক নেতার দিকে সন্দেহের তির ছোড়া হয়। কথিত আছে, ব্যক্তিস্বার্থ আদায়ে ব্যস্ত কিছু চিহ্নিত সাংবাদিক নেতাকে আন্দোলন স্তিমিত করার জন্য দায়ী করা হয়। এতগুলো বছর চলে যাওয়ার পরও আন্দোলন জোরালো করতে না পারলেও সাগর-রুনী হত্যা দিবসে, বর্তমান সাংবাদিক নেতারা নিয়মমাফিক প্রতিবাদ সমাবেশ করে থাকেন। বছরের অন্যান্য দিনে এ নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হতে দেখা যায় না। তবে এসব প্রতিবাদ সমাবেশে সাংবাদিক নেতারা বেশ সোচ্চার বলেই মনে হয়। গত ১১ বছরেও তদন্ত শেষ না হওয়ায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করে সাংবাদিক নেতারা বলেছেন, এই ১১ বছর আমাদের সাংবাদিক সমাজের সঙ্গে খেলাধুলা হয়েছে রাষ্ট্রের দিক থেকে, যেভাবে বিব্রত ও বিভ্রান্ত করা হয়েছে, তাতে সাংবাদিক মহল হতাশ।
আমরা ধরেই নিয়েছি, আমরা যতই আন্দোলন করি, এর কোনো সুরাহা হবে না; খুনিরা ধরা পড়বে না। রাষ্ট্র যেদিকে চলছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেদিকে চলছে। তবে রাষ্ট্র ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলতে চাই, সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ড নিয়ে কোনো ধরনের গল্প ফাঁদার চেষ্টা করবেন না। তদন্তের দায়িত্বে নিয়োজিত র্যাবের উদ্দেশে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে কোনো ধরনের গল্প ফেঁদে তদন্ত প্রতিবেদন না দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। আর তা যদি না হয়, তবে তাদের বিরুদ্ধে সাংবাদিক সমাজের লড়াই শুরু হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।
সাগর-রুনী হত্যার বিচার না হওয়ায় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষজ্ঞরাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। হত্যাকাণ্ডের দশকপূর্তি উপলক্ষ্যে জেনেভা থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের স্পেশাল প্রসিডিউরস তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে বলেছেন, বিগত এক দশকে বাংলাদেশে অন্তত ১৫ সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশের সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের বিনা বিচারে আটক, আক্রমণ, অপহরণ, আইনি হয়রানির শিকার হওয়ার বহু খবর তাদের কাছে আছে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন অভিযোগ বাংলাদেশ সরকারের নজরে আনলেও প্রায়ই কোনো জবাব দেওয়া হয় না বলে জানান। সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ডের পর জাতিসংঘ থেকে এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হলেও কোনো জবাব সরকারের কাছ থেকে কখনোই পাওয়া যায়নি বলে তারা জানান।
গত এক দশকেও সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শেষ না হওয়া এবং দোষী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে না পারার পেছনে বাংলাদেশে দায়মুক্তির সংস্কৃতি অন্যতম কারণ বলে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিত্বরাও মনে করেন, ‘এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এমন প্রভাবশালী কেউ জড়িত, যার কেশাগ্র স্পর্শ করার ক্ষমতা কারও নেই।’ তবে এ কথা ঠিক, এ ঘটনায় মানুষের মনে এমন একটা ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, এর বিপরীত কোনো তথ্য তদন্তে বের হলেও তা প্রকাশ করা যাচ্ছে না। কোনো মামলায় যখন নানাবিধ চাপ কিংবা বাধা তৈরি হয়, তখন অনেক সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা কাজ শেষ না করে সময়ক্ষেপণের কৌশল বেছে নিয়ে থাকেন।
সাগর-রুনী হত্যা মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে এমনই কিছু হয়েছে কি না তা কে জানে? র্যাব বারবার এভাবে সময়ক্ষেপণ করে সেটাই কি প্রমাণ করছে না? একটি মামলা এভাবে অনন্তকাল চলতে পারে না। র্যাবের অনুরোধে আদালতও বারবার সময় বাড়িয়ে দিয়েছেন। তদন্ত শেষ না করতে পারলে র্যাব আদালতকে জানাতে পারে। আদালতও আর সময় না বাড়িয়ে র্যাবকে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিতে পারে। তাতে সুফল পাওয়া যেতেও পারে। তা না হলে এ জোড়া খুনকে কেন্দ্র করে মানুষের মনে যে সন্দেহের দানা বেঁধেছে, তা দূর করা যাবে না।
একেএম শামসুদ্দিন : সাবেক সেনা কর্মকর্তা
প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ১৬ আগস্ট ২০২৩ /এমএম