প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: আমি পেছনের বেঞ্চে বসে থাকা ছেলেগুলোর কথা ভাবছি। হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগে পেছনে বসতে হবে এমনটা কখনো তারা চিন্তা করেনি। কত স্বপ্ন নিয়ে ওরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে, পেছনে ফেলে আসে মা-বাবা, ভাইবোনদের মতো আপনজনদের স্বপ্নের মায়া জন্মানো বিন্দু বিন্দু চোখের পানি। যে চোখ বিশ্বাস আর আশায় টইটুম্বুর থাকে, স্বপ্ন একটাই একদিন ওরা সব অচলায়তন ভেঙে ফেলে ভেঙে পড়া সংসারের হাল ধরবে। মা-বাবার গর্বে বুকটা তখন ভরে উঠবে, সেদিনের আনন্দ তাদের এতটাই হাসাবে যে হাসতে হাসতে তারা হয়তো কেঁদে ফেলবেন, সে কান্না লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টাও করবেন। কখনো কখনো কান্না যে গর্বের হয়, আনন্দের হয়, সব কান্নায় কষ্ট থাকে না।
কিন্তু সবখানেই তো বৈষম্য, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। বৈষম্য যেন আমাদের রক্তের ভেতর ঢুকে গেছে, আর রক্তের ভেতর ঢুকে গেলে সেটা খুঁজে বের করে দেওয়াটা খুব কঠিন হয়। এ বৈষম্যের সহজ সরল সূত্রটাই হলো ভালো ছাত্ররা সামনে বসবে, খারাপ ছাত্ররা পেছনে।
শিক্ষকরা কি কখনো পেছনের বেঞ্চে বসে থাকা ছাত্রদের নিয়ে ভাবেন? তাদের দিকে চোখ তুলে তাকান? কখনো কি শিক্ষকরা সবার পেছনে বসে থাকা ছাত্রগুলোর কাছে পৌঁছাতে পারেন? খুব কঠিন প্রশ্ন। কঠিন প্রশ্নের উত্তর দিতে আমরা খুব কুণ্ঠিত হই। কমন পড়া সহজ প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়াতেই সবার মধ্যে আগ্রহ থাকে বেশি; কিন্তু প্রশ্ন যত কঠিন হবে, উত্তর তত সহজ হবে, এমন ধ্যান-ধারণা আমাদের মধ্যে নেই। নেই বলেই হয়তো ওদের এমন করে বদলে যাওয়া ভাবনাটা নিয়ে শিক্ষকদের কোনো গবেষণা নেই।
একজন শিক্ষকের কাছে প্রথম বেঞ্চে বসা ছাত্ররা যেমন, পেছনের বেঞ্চে অসহায়ের মতো মুখ বুজে বসে থাকা ছাত্ররাও তেমন। কিন্তু তেমন করে বিষয়টাকে আমাদের শিক্ষকরা কি বোঝার চেষ্টা করেন? কেন একজন ছাত্র ক্রমাগত নিজেকে খারাপ ছাত্র ভাবতে ভাবতে পেছনের বেঞ্চগুলোকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকে, তার অন্তর্নিহিত সত্যগুলো জানার চেষ্টা করেন? সামনে দাঁড়িয়ে থেকে নেতা হওয়া যায়, শিক্ষক হওয়া যায় না। শিক্ষককে শ্রেণিকক্ষের সামনে থেকে পেছনে সব জায়গায় তার দৃষ্টি পৌঁছাতে হয়, প্রতিটা ছাত্রের ভেতর যে ধ্বংস-সৃষ্টির খেলা চলছে তা জানার জন্য চোখ খোলা রাখতে হয়। কপালের নিচে থাকা চোখ যা দেখে, বুকের ভেতরের চোখ তার থেকে অনেকগুণ বেশি অনুভব করে। সে চোখ এখন আর কতজন শিক্ষকের আছে?
‘সবাই শিক্ষক নন, কেউ কেউ শিক্ষক’ এ কথাটা সত্য কিনা জানি না, তবে এটা যে মিথ্যা নয় সেটা জানি। গলদটা কোথায়- শিক্ষায়, শিক্ষাদানে না অবহেলায়? সবই অমীমাংসিত সমীকরণের মতো, সেগুলো মেলানোর মতো দৃষ্টিভঙ্গি কতটা আছে আমাদের? সব কিছুই আবছা আবছা, ধোঁয়াশা, ধোঁয়াশা। অথচ কারও কারও মতে, পৃথিবীর ইতিহাস নাকি বদলেছে ব্যাক ব্র্যাঞ্চারদের হাত ধরেই।
পেছনের বেঞ্চের ছাত্ররা দেরি করে ক্লাসে আসে, সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে ক্লাস থেকে পালিয়ে যায়। এমন অনেক অভিযোগ হয়তো আমরা শুনতে পাই। কিন্তু সেটা ভালোবাসা, মায়া, মমতা আর বিশ্বাস নিয়ে কতটা পরিবর্তনের মনোভাব আমরা তাদের মধ্যে গড়তে পারি, সেটা হয়তো কখনো জানতেও চাই না আমরা।
যেদিন শিক্ষকরা সামনে থেকে নয়, পেছন থেকে তাদের ক্লাস লেকচারগুলো শুরু করবেন সেদিন থেকেই হয়তো ঘুচে যাবে এ বৈষম্যের সীমারেখা। কেউ খারাপ ছাত্র নয়, সবার ভেতরেই সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। সেগুলো খোঁজার দায়িত্ব শিক্ষকের। শিক্ষক হতে হলে বাবা হতে হয়, সন্তানের চোখে চোখ রেখে সাহস জোগাতে হয়। কারণ সব বাবাই চান, তার সন্তানরা তাকে একদিন ছাড়িয়ে যাবে। সন্তান যখন বাবাকে অতিক্রম করে তখন এর চেয়ে বড় সুখ বাবার হয়তো আর কিছুই থাকে না।
২.
মনে পড়ছে সেই শিক্ষকদের মায়াবী মুখগুলোর কথা, যাদের জন্মই হতো ছাত্রদের মানুষের মতো মানুষ করতে। ছাত্রদের ভালো মানুষ হিসাবে গড়তে যেমন শাসন-বারণ করতেন, ঠিক তেমনি নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে ভালোবাসতেন। সংসারের হাজারটা অভাব-অনটন মাথায় নিয়ে তাদের একটাই চিন্তা ছিল কীভাবে ছাত্রদের জ্ঞানী মানুষ বানাবেন, বড় মানুষ বানাবেন। এমনও হয়েছে ছাত্রদের পেছনে নিজের শ্রেষ্ঠ সময়টুকু দিতে গিয়ে নিজের সন্তানদের দিকে কখনো সেভাবে নজর দিতে পারেননি। ছাত্ররা যখন বড় মানুষ হয়ে সারা দুনিয়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তখন তাদের সন্তানদের জীবনযুদ্ধে লড়তে হয়েছে। তাতে কী? সন্তানদের মানুষ করতে পারেননি কিন্তু যে মা-বাবা শিক্ষকদের ওপর বিশ্বাস রেখে সন্তানদের তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, তাদের মানুষ বানাতে এতটুকু কার্পণ্য তারা করেননি। বাবা হিসাবে ব্যর্থতা হয়তো তাদের ভেতরে ভেতরে কাঁদাত, কিন্তু শিক্ষক হিসাবে তাদের সফলতা তাদের ভেতরে ভেতরে গর্বের জায়গা তৈরি করত। একটা কম দামি সাইকেলে করে সাধারণ বেশভুষায় স্কুলে আসতেন, কিন্তু লাইব্রেরিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটার পর একটা বই পড়ে নিজেদের ক্লাস নেওয়ার জন্য প্রস্তুত করতেন।
তারা শিক্ষকতাকে চাকরি বলে মনে করতেন না বরং শিক্ষকতাকে তারা সেবা বলে মনে করতেন। খেয়ে না খেয়ে ভেঙে পড়া মুখ আর শরীরটা নিয়ে ছাত্রদের ক্লাস নিতেন। হয়তো শরীরে অসুখ বাসা বেঁধেছে, ক্লান্তিতে অসাড় হয়ে আসছে দেহটা কিন্তু তাতে কী, ক্লাস কামাই করলে যে ছাত্রদের বঞ্চিত করা হবে, এ বোধটুকু তাদের মধ্যে সব সময় কাজ করত। আহা, আরও কত কি মনে পড়ছে, চোখ গড়িয়ে তাদের জন্য পানি ঝরছে কিন্তু তাদের ঋণ শোধ করার সুযোগও তারা দেননি। আর্থিক অভাব-অনটন তাদের ব্যক্তিত্বকে কখনো আপস করতে শেখায়নি। ঋণ শোধ করার জন্য কিছু করতে চাইলে তারা বলতেন, ‘না বাবা, আমার কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই, আমি অনেক ভালো আছি, তোমরা আরও বড় হও, তোমরা এমনভাবে কাজ করবে সেটা যেন আমাদের জন্য কষ্টের না হয়, মর্যাদা ও অহংকারের হয়।’
ওই ত্যাগী ও নিঃস্বার্থ মানুষেরা ছিল বলে আজ হয়তো আমরা মানুষ হতে পেরেছি, পৃথিবীতে নিজেদের একটা পরিচয় তৈরি করতে পেরেছি। আকাশের তারার দিকে তাকালে মনে হয়, স্যারেরা আমাদের জন্য সেখানে আলো জ্বালিয়ে রেখেছেন, যেন আমরা সঠিক পথ চিনতে কখনো ভুল না করি। তাদের অনেকেই এখন হয়তো নেই; কিন্তু তারা কখনো হারিয়ে যাননি আমাদের জীবন থেকে।
হাল আমলের শিক্ষকদের দিকে তাকালে খুব কষ্ট হয়, লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে আসে। তারা শিক্ষক না ব্যবসায়ী এটা বুঝতেই সময় পেরিয়ে যায়। কিসের ত্যাগ, কিসের ভালোবাসা, কিসের ব্যক্তিত্ব; স্বার্থপরতা, লোভ, অস্বচ্ছতা এখন শিক্ষকদের শরীরকে শিকড়ের মতো জড়িয়ে ধরেছে। সবার কথা বলছি না, এর মধ্যে কেউ কেউ এখনো আছেন যারা শিক্ষকতাকে ধরে রেখেছেন; কিন্তু তাদের প্রতিকূলতার সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে বাঁচতে হচ্ছে, নিজের আত্মসম্মানটুকু বাঁচাতে খড়কুটোকে আঁকড়ে ধরে থাকতে হচ্ছে। এখন শিক্ষকরা ছাত্রদের নিজ স্বার্থে ব্যবহার করেন, ছাত্ররাও শিক্ষকদের এ দুর্বলতা দেখে মনে করে সব শিক্ষকরাই বুঝি এমন।
ছাত্রদের শাসন-বারণ তো দূরের কথা নিজেদের দোষে শিক্ষকরাই এখন ছাত্রদের তোপের মুখে থাকেন। এটি ছাত্রদের দোষ নয়, বদলে যাওয়া সময় আর পরিস্থিতির দোষ, যেখানে শরীরের পচন মনের ভেতরেও পচন ধরিয়েছে। কাউকে ছোট করার জন্য এমন কথা বলছি না, সব শিক্ষকের প্রতি বিনীত সম্মান রেখে বলছি। কারণ সবকিছু নষ্ট হলেও তা আবার ভেঙে গড়ে তোলা যায়, শিক্ষাকে যাদের মাথার ওপর তুলে দিয়ে জাতি গড়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সে মাথাতে আবর্জনা জমলে তা পরিষ্কার করা খুব কঠিন। ঝুড়ির ভেতর একটা আমে পচন ধরলে ঝুড়ির অন্য আমগুলোতে পচন ধরতে বেশি সময় লাগে না। আমি নিজে শিক্ষক বলে স্বপেশার সমালোচনা করতে এতটুকু ছাড় দেই না। কারণ আমি বিশ্বাস করি, আত্মসমালোচনা করতে না পারলে আত্মশুদ্ধির পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।
৩.
আর্থিক সংকটের কারণে ঘানার স্কুলগুলোতে তখন কম্পিউটার ছিল না, যদিও সারা পৃথিবীতে কম্পিউটার বিষয়ে জানাটা সে সময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। সেখানকার শিক্ষার্থীরা আধুনিক এ প্রযুক্তির ধারণা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল। প্রযুক্তির এ ধারণা থেকে একটা প্রজন্ম পিছিয়ে পড়বে বিষয়টা কোনোভাবেই মানতে পারছিলেন না সেখানকার একজন স্কুল শিক্ষক রিচার্ড আপ্পিয়াহ আকোটো। তার কাছে না ছিল হুয়াইড বোর্ড-মার্কার, না ছিল মাল্টিমিডিয়া, সম্বল ছিল চক আর ব্ল্যাক বোর্ড। হাতে চক নিয়ে ব্ল্যাক বোর্ডে মাইক্রোসফট ওয়ার্ড খুব নিখুঁতভাবে এঁকে ছাত্রদের শেখাতেন, বোঝাতেন নিজের সবটুকু বিলিয়ে দিয়ে। এটা করতে গিয়ে অনেক ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হচ্ছিল তাকে, তারপরও শিক্ষক হিসেবে নিজের সর্বোচ্চটা দিতে কখনো কুণ্ঠিত হননি তিনি। সব সময় ভেবেছেন, প্রতিকূল পরিস্থিতি থাকতে পারে কিন্তু হার মানা যাবে না, বিকল্প কোনো উপায় খুঁজে বের করতে হবে। যার কিছু নেই তার স্বপ্ন থাকে, স্বপ্ন না থাকলে মানুষ যে মৃত হয়ে যায়, সেই স্বপ্নটুকু সম্বল করেই স্বপ্ন দেখাতেন নিজের শিক্ষার্থীদের। ইচ্ছা করলেই তিনি কম্পিউটার না থাকার অজুহাত দেখিয়ে বিষয়টাকে এড়িয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু যার ভেতরে শিক্ষক নামের নিঃস্বার্থ একটা মানুষ লুকিয়ে থাকে, তিনি কখনো থেমে যান না, বরং যেখানে NO বলে কোনো শব্দ থাকে সেখানেই Next Opportunity খুঁজে বেড়ান।
ঘানার প্রত্যন্ত স্কুলে হার না মানা মহান একজন শিক্ষক আছেন, এ কথাটি গিয়ে পৌঁছাল মাইক্রোসফটের মালিক বিল গেটসের কাছে। আবেগে আপ্লুত হলেন তিনি, শিক্ষকের এমন মহত্ব তার মনকে নাড়া দিল খুব গভীরভাবে। শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকের এমন ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ দেখে ঘানার সেই স্কুলে তিনি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কম্পিউটার ল্যাব তৈরি করে দিলেন। সেই ত্যাগী ও মহান শিক্ষককে মাইক্রোসফট কোম্পানির পক্ষ থেকে বিশেষ সম্মানও প্রদান করা হলো।
মানুষ অভাবের কারণে দরিদ্র হয় না, মানুষ দরিদ্র হয় যখন অভাবের জায়গাগুলো কীভাবে পূরণ করা যায়, সেগুলো খুঁজে বের করার মতো নিজেদের যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারে না বা সাহস দেখাতে চায় না। রিচার্ড আপ্পিয়াহ আকোটো সে সাহসের কাজটাই করেছিলেন, যার পেছনে কাজ করেছিল দেশের প্রতি গভীর আনুগত্য, সততা, ভালোবাসা ও ত্যাগ। স্যালুট নাম না জানা অখ্যাত এই মহান শিক্ষককে।
প্রকৃত শিক্ষকদের এ সংকটের সময়ে এমন নাম না জানা মহান শিক্ষকদেরই আমাদের বেশি দরকার। যারা ক্ষমতা, অর্থ, স্বার্থের পরিবর্তে দেশের জন্য নিঃস্বার্থভাবে নীরবে নিভৃতে কাজ করে যেতে চায় ।
ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ৩১ জুলাই ২০২৩ /এমএম