প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: প্রচলিত প্রবাদ হচ্ছে, ‘মূর্খ লোকের জন্য কখনোই সমাজ নষ্ট হয় না, সমাজ নষ্ট হয় শিক্ষিত লোকের মূর্খ স্বভাবের জন্য।’ আমাদের দেশের বর্তমান রাজনৈতিক চরিত্র কীভাবে নষ্ট হয়ে আসছে তার বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ প্রয়োজন। সাধারণ মানুষের মনস্তত্ত্ব অধ্যয়ন না করে ব্যক্তিস্বার্থে পরিচালিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কখনোই জনকল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে না।
এটি সর্বজনবিদিত যে, রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিপরীতে অপসংস্কৃতির চর্চা করা হলে বিরোধ-সহিংসতাসহ রাজনৈতিক অপরাধ ও জনদুর্ভোগে পুরো সমাজ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অভিজ্ঞতা থেকে এটুকু বলা যায়, কর্মসূচি-পালটা কর্মসূচির প্রভাবে সর্বস্তরের জনসাধারণের জীবনপ্রবাহ প্রচণ্ডভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে দাবি আদায়ের নামে রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন সভা-সমাবেশ সহনশীল পরিবেশে আবদ্ধ থাকছে না। অধিকন্তু নানামুখী আক্রমণ-সংঘাত-ভাঙচুর ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সাধারণত শ্রমজীবী খেটে খাওয়া মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে রাজনীতি প্রণিধানযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
এর বিপরীত কর্মকাণ্ড জনমনে আতঙ্কের জন্ম দেয়, যা কখনো কাম্য নয়। দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে দেখা যায়-পারস্পরিক সমঝোতা, সৌহার্দ, সম্প্রীতির বিপরীতে সহিংসতা-ষড়যন্ত্র-অসহিষ্ণু আচরণ মানুষের মনে রাজনীতির প্রতি ব্যাপক অনাগ্রহ তৈরি করছে। মানুষের মর্যাদা সুদৃঢ় করার জন্য প্রয়োজনীয় নাগরিক স্বাধীনতা অপরিহার্য। রাষ্ট্রের সব জনগণের সামগ্রিক সুযোগ-সুবিধা অবারিত ভোগ করাই গণতান্ত্রিক সভ্যতার অন্যতম উপজীব্য। আধুনিক সমাজ ক্রমবিকাশের ধারায় মুক্ত রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের অধিকার প্রয়োগ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গতিশীল করে সমাজের স্বয়ম্ভরতা অর্জনে মুক্তচিন্তার অবাধ প্রকাশ এবং সাংস্কৃতিক বিবেকের জাগরণ একান্ত প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচ্য।
সরকারি দলের ভুলত্রুটি বা নানাবিধ ক্ষমতার প্রয়োগ যদি বিরোধী দলের মনঃপূত না হয়ে থাকে, তাহলে তারা শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করে প্রকৃত অর্থেই অর্থবহ সমালোচনা-কর্মসূচিতে জনসমর্থন আদায়ে সচেষ্ট হবে-এটিই সব নাগরিকের প্রত্যাশা। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে পরিচ্ছন্ন-নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্র তৈরিতে বিরোধী দলের ভূমিকা কম নয়। ভোটারদের মনোযোগ আকর্ষণে পরিশীলিত-পরিমার্জিত-দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ উন্নয়ন-অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নেওয়ার ব্রত নিয়েই বিরোধী দল কার্যকর সক্ষমতা অর্জনে প্রতিশ্রুত থাকুক। শুধু বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা নয়, জনমন জয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনাকে ধারণ করে সব পক্ষই সদাচার-ন্যায়নিষ্ঠ-দেশের সামগ্রিক জনকল্যাণকে অগ্রাধিকার দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে একযোগে জনগণের রায় বা জয়-পরাজয় মেনে নিয়েই সম্ভাব্য বৈশ্বিক মন্দা উত্তরণে যথাযথ দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক-দল হিসাবে যে কোনো রাজনৈতিক পরিচয়ে মতাদর্শের ভাবমূর্তি সুরক্ষায় এটিই হবে সর্বোৎকৃষ্ট উদ্যোগ।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, নির্বাচনকালীন সরকার, নির্বাচনের আগে সরকার পদত্যাগের একদফাসহ নানা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সরকারি-বিরোধী দলগুলোর পালটাপালটি সমাবেশ-মহাসমাবেশ-গণসমাবেশ-পদযাত্রা সচেতন মহলসহ দেশবাসীর মনে উদ্বেগের জন্ম দিচ্ছে। বিশেষ করে বিরোধী দলগুলোর একটানা কর্মসূচির ফলে সৃষ্ট জনদুর্ভোগে মানুষের মনে এক ধরনের উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক প্রস্তুতি থাকলেও যে কোনো সময় সহিংসতা-নাশকতার আশঙ্কা অমূলক নয়। উজ্জীবিত কর্মীদের উদ্দেশে দলীয় নেতাদের উত্তেজক বক্তৃতা-বিবৃতিতে নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক দলগুলোর রাজপথে ফয়সালা বা রাজপথ দখল করার হুমকি-ধামকি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। বিদ্যমান দেশীয় ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটে কোনো দলের অস্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টির পাঁয়তারা কাম্য নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘এমনিতেই অর্থনীতি ঝুঁকিতে আছে।
এর মধ্যে রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনা ঘটলে পরিস্থিতি আরও নাজুক হবে। আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান বের করতে হবে। যদি দেশে সত্যি সত্যি কোনো সংঘাত দেখা দেয়, বিদেশি ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নেবে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় জনজীবনের পাশাপাশি অর্থনীতির যে ক্ষতি হয় তা শুধু ক্ষতিই নয়, দেশ-জাতির জন্য অভিশাপ হিসাবেও জিইয়ে থাকে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সচল রাখতে হলে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে রাজনীতির সব পক্ষকেই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। চলমান বৈশ্বিক সংকটের বাইরে আমরাও নই। এ অবস্থায় রাজনৈতিক সংকট জনজীবনে সংকটের ছায়া আরও গাঢ় করুক, তা কোনোভাবেই ঠিক হবে না।’
গত ১৮ জুলাই রাজধানীতে একই দিনে দুই পক্ষের কর্মসূচির প্রভাব পড়ে ব্যস্ত সড়কগুলোতে। স্বাভাবিক সময়ে তীব্র যানজটের কারণে নগরবাসীকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয়। কিন্তু সড়কনির্ভর রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে নগরী কার্যত প্রায় অচল হয়ে পড়ে। রাজধানীসহ দেশের প্রতিটি নগরীতে প্রায়ই এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। সভা-সমাবেশ করা প্রতিটি রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক অধিকার হলেও জনগণের ভালো-মন্দ দেখভালের দায়িত্বও তাদের ওপর বর্তায়। রাজনৈতিক দলগুলোর বর্তমান কর্মসূচিতে এর বিন্দুমাত্র প্রতিফলিত নয়। বিরোধী দলের পদযাত্রা এবং সরকারি দলের শান্তি সমাবেশের ফলে রাজধানীবাসী অপরিসীম দুর্ভোগের শিকার এবং অতি প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হওয়া মানুষ চরম বিপাকে পড়েছিল।
অফিসগামী বা দূরযাত্রার কোনো মানুষই নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে পারেনি। পরিবহণ সংকটের কারণে অনেককে গুনতে হয়েছে বাড়তি ভাড়া। অ্যাম্বুলেন্সে থাকা রোগীদের দীর্ঘ সময় রাস্তায় আটকে থাকতে হয়েছে। ভুক্তভোগীদের অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। এ ছাড়া ১৯ জুলাই দলগুলোর শক্তি প্রদর্শনের উত্তাপ দেশব্যাপী কমবেশি অনুভূত হয়েছে। দেশের কোথাও কোথাও আক্রমণ-পালটা আক্রমণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলার পাশাপাশি প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।
দেশে বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনকালে প্রচণ্ড সংঘাত-সংঘর্ষে হতাহতের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জোটটির সদস্য দেশগুলোর ঢাকা মিশন থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। গত ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ইইউ প্রতিনিধিদলের পক্ষে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইন বাংলাদেশ নামে টুইটার বার্তায় বলা হয়েছে, ইইউ এবং ইইউ সদস্য দেশগুলোর ঢাকা মিশন রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সহিংসতার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলো নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত সবাইকে তারা শান্তিপূর্ণ ও আইনানুগ পদ্ধতিতে রাজনীতি পরিচালনার জন্য দৃঢ়ভাবে উৎসাহিত করছে। ১ নভেম্বর ২০২২ গণমাধ্যমে প্রকাশিত মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে ৪২টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় সরকারি দলের ছয়জনসহ মোট সাতজন নিহত হয়েছে। আহত হওয়া ৩৭৪ জনের মধ্যে ৩০ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। এ সময় আটক করা হয়েছিল ১০৩ জনকে।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বিরোধিতা করে জোটভুক্ত দলগুলো রাজনৈতিক অপরাধের আশ্রয় নেয়। তারা দেশজুড়ে জ্বালাও-পোড়াও, চলন্ত গাড়িতে পেট্রোলবোমা হামলা, সড়কে ককটেল ও হাতবোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। সেসময় তারা শত শত যানবাহন ভাঙচুর করে সেগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। যানবাহন চালক, দিনমজুর, কর্মজীবী মানুষ, শিক্ষার্থী, নারী-শিশুকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। তাদের পেট্রোলবোমা, হাতবোমা হামলায় এবং অন্যান্য সহিংসতায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২০ সদস্যসহ ২০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়।
সহিংসতার সময় রাস্তার পাশে থাকা হাজার হাজার গাছ কাটাসহ ছোট দোকান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতেও আগুন দেয় তারা। নির্বাচনের দিন একজন প্রিসাইডিং অফিসারসহ মোট ২৬ জনকে হত্যা করা হয় এবং সারা দেশে ৫৮২টি স্কুলের ভোটকেন্দ্রে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের এক বছর পূর্তির দিন আবারও জ্বালাও-পোড়াওয়ের মাধ্যমে ২৩১ জনকে হত্যা করা হয়। সেসময় ২ হাজার ৯০৩টি গাড়ি, ১৮টি রেলগাড়ি এবং ৮টি যাত্রীবাহী জাহাজে আগুন লাগিয়ে হামলা চালায় তারা। ওই সময় সরকারি অফিসগুলো হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। ভাঙচুরে এবং আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়ে যায় ৬টি ভূমি অফিসসহ ৭০টি সরকারি কার্যালয়। ২০১৫ সালের ২৩ জানুয়ারি সংবাদপত্রে পরিবেশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, হরতাল-অবরোধের নামে তাদের অগ্নিসন্ত্রাসের কারণে গড়ে প্রতিদিন রাষ্ট্রের ২ হাজার ২৭৮ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এমনকি এ ক্ষতির পরিমাণ পরবর্তীকালে বেড়ে গড়ে প্রতিদিন আড়াই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতার মাধ্যমে সৃষ্ট সংকটে দেশের গণতন্ত্র বিপর্যস্ত হলে সুযোগসন্ধানীরা অশুভ যোগসাজশের মাধ্যমে জনগণকে বিপথগামী করার চক্রান্তে লিপ্ত হতে পারে। দেশের স্বার্থেই রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীল ও সহনশীল আচরণ কাম্য। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, দেশের জনগণ যে কোনো সময়ের তুলনায় অধিক সচেতন। তাদের যুক্তি-জ্ঞাননির্ভরতা অনেক প্রখর। শত প্রলোভন বা প্রতিশ্রুতিতে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করার তেমন কোনো সুযোগ নেই। তবুও চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে আবদ্ধ করে দেশকে কলুষিত করার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া মোটেও সমীচীন হবে না।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ২৭ জুন ২০২৩ /এমএম