Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক ::‌  গত দুই সপ্তাহে সংবাদমাধ্যমগুলো দুটি আর্থিক বিষয়ের ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করেছে। প্রথমটি হলো, সুইস ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন; দ্বিতীয়টি হলো ধনী-গরিবের বৈষম্য দিনকে দিন বেড়ে যাওয়া। এ দুটি বিষয়ে কিছুটা আলোচনা করা যেতেই পারে।সুইস ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন বাংলাদেশে লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে দিয়েছে। গত ২২ জুন সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে গত এক বছরে বাংলাদেশি আমানতকারীরা ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ তুলে নিয়েছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশিদের জমানো অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ দশমিক ১১ কোটি সুইস ফ্রাংক। এক সুইস ফ্রাংক সমান যদি ১২৪ টাকা ধরা হয়, তাহলে বাংলাদেশি টাকায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ হাজার ৮০২ কোটি টাকা। ২০২২ সালের প্রতিবেদন বলছে, বর্তমান সময়ে আমানতের পরিমাণ মাত্র ৫ কোটি ৫২ লাখ সুইস ফ্রাংক বা প্রায় ৬৮৫ কোটি টাকা। তার মানে, বাকি ১০ হাজার ১১৭ কোটি টাকা এক বছরে তুলে নেওয়া হয়েছে। আরও বলা হচ্ছে, যদি কোনো বাংলাদেশি তার পরিচয় গোপন করে অর্থ জমা করে থাকে, তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা যায়নি। গত ১০ বছরের তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমানো অর্থের পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েছে, কেবল তিনটি বছর ছাড়া। ২০১৩ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানতের পরিমাণ ছিল ৩৭ দশমিক ১৮ কোটি সুইস ফ্রাংক; ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০ দশমিক ৬০ কোটি ফ্র্যাংকে; ২০১৫ সালে ৫৫ দশমিক ০৮ কোটি; ২০১৬ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৬৬ দশমিক ১৯ কোটি সুইস ফ্রাংক; ২০১৭ সালে কমে দাঁড়ায় ৪৮ দশমিক ১৩ কোটি ফ্রাংক; ২০১৮ সালে তা আবার বেড়ে দাঁড়ায় ৬১ দশমিক ৭৭ কোটি ফ্রাংক; ২০১৯ সালে কিছুটা কমে হয় ৬০ দশমিক ৩০ কোটি; পরের বছর আরও কমে দাঁড়ায় ৫৬ দশমিক ২৯ কোটি সুইস ফ্রাংকে। ২০২১ সালে আমানতের পরিমাণ প্রায় ৫৭ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৮৭ দশমিক ১১ কোটি সুইস ফ্রাংকে এবং ২০২২ সালে এক ঝটকায় প্রায় ৯৫ শতাংশ কমে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৫২ কোটি ফ্রাংক। এটা ঠিক, আমানতের অর্থের পুরোটাই পাচারকৃত নয়, তবে বেশির ভাগটাই।

এক বছরে এই বিশাল অঙ্কের টাকা কোথায় গেল, তা নিয়ে বিস্ময় ও কৌতূহলের শেষ নেই। একসময় সারা বিশ্বের অর্থ পাচারকারীদের গোপনীয়তা শতভাগ রক্ষা করে চলত সুইস ব্যাংকগুলো। এ কারণে বিভিন্ন দেশের অবৈধ অর্থের মালিকদের জন্য সুইস ব্যাংক ছিল নির্ভরতার মূর্তপ্রতীক, বিশ্বস্ততার অন্যতম প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ২০০২ সাল থেকে সারা বিশ্বের দেশগুলোয় অর্থ পাচার নিয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি হয় এবং এ নিয়ে সুইস ব্যাংকের সমালোচনা তীব্রতর হয়। ফলস্বরূপ, কয়েক বছর আগে থেকে সুইস ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের হিসাব ও তথ্য উন্মোচিত করে দেয়, গোপনীয়তার অবসান ঘটে। অনেকে মনে করেন, এটি অর্থ উত্তোলনের একটি কারণ। তবে এর পাশাপাশি একথাও বলে রাখা প্রয়োজন যে, পাচারকৃত অর্থের টাকা আমানত রাখার আগের আকর্ষণ এখন আর সুইস ব্যাংগুলোয় নেই। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশিদের জন্য সুইজারল্যান্ড বাদে কমপক্ষে নয়টি দেশ আছে যেখানে নিরাপদে টাকা পাচার করা যায় এবং নিরাপদে সংরক্ষণ করা যায়। বর্তমান সময়ে অর্থ পাচার প্রভাবশালীদের কাছে একটি ‘মামুলি’ বিষয় মাত্র। যে নয়টি নতুন গন্তব্যে অর্থ পাচার এখন নিরাপদ সেগুলো হলো-সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, হংকং ও থাইল্যান্ড। এসব দেশে প্রতিবছর আমাদের মোট বাণিজ্যের প্রায় ৩৬ শতাংশ অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে, যার পরিমাণ ৮০ হাজার কোটি টাকার কম নয় বলে গবেষকরা মনে করেন।

টাকা পাচারের কারণ হিসাব তিনটি বিষয়কে চিহ্নিত করা যায়। প্রথমত ও প্রধানত দুর্নীতি, দ্বিতীয়ত রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং তৃতীয়ত অর্থনৈতিক দুর্বলতা। অর্থ পাচার নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে গত এক দশকে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে এবং হচ্ছে; কিন্তু প্রতিকারের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা বা এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সদিচ্ছা চোখে পড়ছে না। অর্থ পাচার রোধে দেশে যে আইন আছে, তা যথেষ্ট বলে অনেকেই মনে করেন। তবে সেই আইন প্রয়োগে সরকারের রহস্যজনক নীরবতা সবাইকে বিস্মিত করে। বর্তমান সরকার পাচার করা অর্থের অতি সামান্য অংশ রাজনৈতিক কারণে হলেও দেশে ফেরত আনার সক্ষমতা দেখিয়েছে। তাহলে বিরাট অংশের টাকা ফেরত আনার বিষয়ে অনীহাও কি রাজনৈতিক কারণেই? এটি একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। সরকার যদি আন্তরিক হয়, তাহলে এখনো ভালো কিছু করার সুযোগ রয়েছে। এই যে ১০ হাজার কোটি টাকা তুলে নেওয়া হলো, এই টাকা কে নিয়েছে, কোথায় গেছে, এর কোনো তথ্য ব্যাংকটির বার্ষিক প্রতিবেদনে নেই। তবে ব্যাংকের কাছে এ তথ্য মজুত আছে। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলে তথ্যগুলো জানতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত কে বা কারা টাকাগুলো সুইস ব্যাংক থেকে তুলে নিল এবং কোথায় নিয়ে গেল-এসব বিষয়ে দ্রুত তথ্য সংগ্রহ করা এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া। হাজার নিরাশার মাঝেও খানিকটা আশার আলো দেখতে চাই।

গত সপ্তাহের দ্বিতীয় উদ্বেগের সংবাদটি হলো-দেশে আয়বৈষম্য দিনকে দিন বেড়ে যাওয়া। ধনীরা আরও বেশি মাত্রায় ধনী হচ্ছে, বিপরীতভাবে গরিবরা হচ্ছে আরও গরিব। পাঁচ দশক ধরে আমাদের অর্থনীতিতে এ কাজটি চলছে নির্দয়ভাবে। দু-একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টির ভয়াবহতা উপলব্ধি করা যাবে। প্রথমে আমাদের মোট জনসংখ্যাকে সম্পদের মালিক হিসাবে ১০টি ভাগে ভাগ করা যাক। যেমন: প্রথম ১০ শতাংশ সবচেয়ে ধনী, এর পরের ১০ শতাংশ একটু কম সম্পদের মালিক এবং ক্রমানুসারে সর্বশেষ স্তরের ১০ শতাংশ সবচেয়ে গরিব। ১৯৭৩-৭৪ সালের সঙ্গে ২০২২ সালের তুলনা করলে আমাদের মোট সম্পদের ওপর একমাত্র প্রথম ১০ শতাংশের মালিকানাই বেড়েছে, বাকি নয়টি আয় স্তরের মানুষের সম্পদের মালিকানা কমেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের খানার আয় ও ব্যয় জরিপ থেকে উঠে এসেছে এ তথ্য।

১৯৭৩-৭৪ সালে দেশের মোট সম্পদের ২৮ দশমিক ৪ শতাংশের মালিক ছিল সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ ধনিক শ্রেণি। পাশাপাশি গরিব ১০ শতাংশের মালিকানা ছিল মোট সম্পদের মাত্র ২ দশমিক ৮ শতাংশের। ৫০ বছরে চিত্র অনেক পালটে গেছে। ২০২২ সালের পরিসংখ্যান বলছে, প্রথম ধাপের ১০ শতাংশ ধনী ব্যক্তির হাতে রয়েছে দেশের মোট সম্পদের ৪০ দশমিক ৯২ শতাংশ। এই বৃদ্ধির হার ৪৪ শতাংশ। বিপরীতভাবে গরিব ১০ শতাংশের মালিকানার পরিমাণ ৫৪ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৩১ শতাংশে।

আমরা যে উন্নয়নের গল্প শুনি এর অন্তর্নিহিত সত্য হলো, উন্নয়নের প্রায় সব সুবিধা ভোগ করছে ধনীরা আর দিনদিন বঞ্চিত হচ্ছে গরিবরা। এ প্রক্রিয়া ৫০ বছর ধরে চলছে। গবেষকরা আয় বা সম্পদের বৈষম্য পরিমাপ করার জন্য যে সূচকটি ব্যবহার করেন তার নাম ‘গিনি সহগ’। এর মান ০ থেকে ১ পর্যন্ত। যদি কোনো দেশের ক্ষেত্রে এর মান ০ হয়, তাহলে বুঝতে হবে সেখানে সম্পদ ষোলো আনা সমভাবে বণ্টিত। আর যদি মান ১ হয়, তাহলে বুঝতে হবে সেদেশের সব সম্পদ একজনের হাতে। বাস্তবে পৃথিবীর কোনো দেশই এ দুই চরম অবস্থানে নেই। বিশ্বের সব দেশেই এর মান ০-এর বেশি এবং ১-এর কম। ০ থেকে যতই ১-এর দিকে যাওয়া হবে, ধরে নিতে হবে আয়বৈষম্য ততই বাড়ছে।

বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে আয়বৈষম্যের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। সেদেশের গিনি সহগের মান ০.৬৭। আর সবচেয়ে কম বৈষম্যের দেশ স্লোভেনিয়া, যার গিনি সহগের মান ০.২৩। এছাড়া সুইডেন, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ডসহ ইউরোপের দেশেগুলোয় এর মান ০.৩০-এর কাছাকাছি। বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে গিনি সহগের মান ছিল ০.৩৬। ক্রমেই তা বেড়ে চলেছে। ১৯৮৮ সালে এসে এর মান দাঁড়ায় ০.৩৭-এ। এরপর থেকে বৈষম্য বড় আকারে বাড়তে থাকে এবং ২০১০ সালে গিনি সহগের মান দাঁড়ায় ০.৪৫৮-এ। আর ২০২২ সালে এর মান ছিল ০.৪৯৯। সাধারণত গিনি সহগের মান ০.৫০০ হলে তাকে উচ্চ বৈষম্যের অর্থনীতি বলা হয়। সেই নেতিবাচক অবস্থান থেকে আমরা কতখানি পিছিয়ে আছি? অতি সামান্য। বলা যায়, আমরা এখন উচ্চ বৈষম্যের দ্বারপ্রান্তে। উন্নয়নের গল্প শুনে আমাদের কী লাভ বলতে পারেন? দেশে যতই সম্পদ গড়ে উঠুক, তাতে গরিবের ভাগ তো দিনদিন কমছে!

বৈষম্য কেন বাড়ছে, তা বলেই আজকের লেখার ইতি টানব। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের বক্তব্য হলো : শহরের শ্রমিকদের আয় সেভাবে বাড়েনি। জমি ও সম্পদের মালিকরাই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল বেশি পাচ্ছেন। গত ছয় বছরে শিল্প খাতে কর্মসংস্থান কমেছে। অথচ এ সময়ে শিল্প খাতে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কর্মসংস্থানের পাশাপাশি মজুরিও বৃদ্ধি পাওয়ার কথা; কিন্তু তা পায়নি। এ প্রবৃদ্ধিতে মালিকদের আয় বেড়েছে। ঋণ নিয়ে খেলাপি হলেও তারা মাফ পেয়ে গেছেন। কর সুবিধা শিল্প মালিকরাই পেয়েছেন। সার্বিকভাবে সরকারি সুযোগ-সুবিধায় মালিকরা লাভবান হয়েছেন। কিন্তু শ্রমিকরা কিছু পাননি। তাদের কাছে প্রবৃদ্ধির কোনো সুফল যায়নি। এভাবেই বৈষম্য বেড়েছে।

পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে আয়বৈষম্য থাকবেই। কিন্তু তা সহনীয় মাত্রায় রাখার জন্য কল্যাণ রাষ্ট্রগুলো ধনিক শ্রেণির ওপর বড় ধরনের সম্পদ করারোপ করে তা গরিবদের সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করে থাকে। আমরা এরকম অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়ও বৈষম্য কমাতে পারি, যদি সরকার জনগণের সত্যিকার কল্যাণ চায়।

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

প্রবাস বাংলা ভয়েস / ঢাকা / ০২ জুন ২০২৩ /এমএম