Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক ::‌ পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতার প্রারম্ভে নারী ছিল পরিবারের প্রধান কর্তা। পশুপালন ও কৃষিকাজে লিপ্ত থাকতেন নারীরা, আর পুরুষেরা থাকতেন গৃহকর্মে। তার পর সভ্যতার ক্রমবিকাশে অদলবদল হতে থাকে নারী-পুরুষের এ অবস্থান। প্রাচীন ভারতে নারীর সামাজিক অবস্থান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বৈদিক যুগে নারীর স্বাধীনতা ছিল অনেক বেশি। ঋগ্বেদের প্রাচীন অংশে আমরা দেখি, গ্রামকেন্দ্ৰিক যাযাবর পিতৃতান্ত্রিক সমাজে যতটুকু প্ৰত্যাশা করা যায়, নারী সেই মাত্রাতেই স্বাধীনতা ভোগ করেছে। প্রাচীন বৈদিক যুগে নারীর কিছুটা সাম্য ভোগ করার সাক্ষ্য মেলে। দেবগণ ও পিতৃগণকে দৈনন্দিন জল দেওয়ার প্রসঙ্গে এমন তিন নারীর নাম পাওয়া যায় যাদের উদ্দেশ্যেও জল দেওয়া হতো। তারা হলেন গার্গী বাচক্লবী, বাড়বা আত্ৰেয়ী এবং সুলভ মৈত্রী।

প্রাচীন গ্রিক সভ্যতায় যে নারী শিক্ষা গ্রহণ করত সে ছিল এক বিশাল হাস্যরসের পাত্র। কিন্তু এর ব্যতিক্রম ছিলেন স্পার্টান নারীরা। স্পার্টান নগরীতে যে নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, সেখানে নারীদের অবদান ছিল অপরিসীম। সভ্যতার চরম শিখরে পৌঁছে যাওয়া স্পার্টান নগরীতে নারীরা পুরুষদের সঙ্গে সমানতালে কাজ করতেন ঘরে-বাইরে। অধিকাংশ স্পার্টান নারীরা ছিলেন শিক্ষিত। সংগীত, কাব্য-দর্শন ও বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনায় নারীরা যুক্ত থাকতেন। সেই সভ্যতায় নারীরা জমির মালিক হতেন ও তাদের ইচ্ছেমতো জমিতে কী করবেন তা সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রাখতেন। শোনা যায়, পুরো স্পার্টান নগরীর ৪০ শতাংশ জমির মালিক ছিলেন নারীরা। নারীদের খেলাধুলা ও রণক্ষেত্রে অংশগ্রহণ ও স্বাধীন মতামতের সমঅধিকার ছিল। স্পার্টানরা বিশ্বাস করত, নারীকে যথাযথ সম্মানের মাধ্যমে তার ঘরে একজন সামর্থ্যবান পুরুষের জন্ম হয়।

আইয়ামে জাহিলিয়াত বা প্রাক-ইসলামি আরবীয় যুগে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির নারীদের অধিকার না থাকলেও আরবের উচ্চ-বিত্ত শ্রেণির নারীদের অধিকার ছিল ধারণারও অধিক। ন্যাটিডম বা ধর্মযাজিকা যারা হতেন তারা উত্তরাধিকারী ও সম্পত্তির মালিক হতে পারতেন। যদিও উঁচু বংশের নারীদের সংখ্যা ছিল নিতান্ত কম।

আসলে বিপত্তিটা ঘটতে থাকে মধ্যযুগ থেকে। প্রাচীন বাইবেল অনুসারে নারীর সামাজিক অবস্থান নির্ণীত হয়। আদমের পাজর থেকে তৈরি হয়েছিলেন ইভ। আর সেই ইভ প্রাকৃতিক নিয়মে হবেন দুর্বল। তারা গৃহে অবস্থান করবেন। স্বামীর ও সংসারের কাজে সহায়তা করবেন। বাইবেল অনুসারে, মধ্যযুগীয় পরিবারগুলো ছিল পিতৃতান্ত্রিক। একমাত্র কুমারী মাতা মেরী ছাড়া অন্যসব নারী থাকবেন স্বামীর আজ্ঞাবহ। মেরী ছিলেন পরম পূজনীয় ও শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিত্ব।

আমাদের এই আধুনিক যুগেও অনেক সম্প্রদায়ের মধ্যে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয়। গত বছর বিবিসির একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়, যেখানে দেখা যায়— চীনের ইউনান প্রদেশের পাহাড়ের কোলে মসুও সম্প্রদায়ের সমাজে নারীদের রাজত্ব। যেখানে পুরুষের কাজ নারীর শয্যাসঙ্গী হওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। বাংলাদেশেও কিছু উপজাতি জনগোষ্ঠী আছে, যাদের সমাজে পরিবারের প্রধান নারীরা। এর মধ্যে মুরং সম্প্রদায়ের নাম উল্লেখ করা যায়।

প্রাচীন যুগ থেকে আজকের যুগ পর্যন্ত আমরা নারীর সুউচ্চ সামাজিক অবস্থান সম্পর্কিত কিছু উদাহরণ দেখে হয়তো অনেকে মুগ্ধতার চরমে পৌঁছাবেন। আল্ট্রা মডার্ন সভ্যতায় ফ্যামিনিজমের মন্ত্র জপে এগিয়ে যাচ্ছেন নারীরা। নারীদের সরব উপস্থিতি আজ সর্বত্র। দ্রোহে নয়, নারী আজ বিদ্রোহে। বিগ্রহে নয়, নারী আজ আগ্রহে। কিন্তু কোথায় যেন একটু খাদ মেশানো। নারী স্বাধীনতা কোনো এক ফটকে আটক। সেই ফটকের পাহারাদার মুখে ‘আউরাত কী আজাদি’ এর কথা বললেও নারী স্বাধীনতার মুলা ঝুলিয়ে সেই অদৃশ্য পাহারাদার বিদ্রূপের হাসি হাসে।

এ প্রসঙ্গে, চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াস নারীকে ভয়াবহভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। কনফুসিয়াস নারীকে দেখেছেন দেহসর্বস্ব এক প্রাণীরূপে। তার মতে, নারীর কোনো আত্মা নেই, নারী কেবলই এক দেহমাত্র। আর গ্রিক দার্শনিক প্লেটো যা বলেছিলেন তা তো আরও ভয়াবহ। তিনি বলেছিলেন- ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তিনি আমাকে এথেন্সবাসী করেছেন; বর্বর করেননি, ক্রীতদাস বা স্ত্রীলোক করেননি।’ এসব মনীষী কেন নারীর প্রতি সংকীর্ণমনা হয়ে বিষোদগার করেছেন তা আজও ভাবনার অন্তরালে এক রহস্যময় স্তর। নারীর প্রতি বৈষম্য এসব কটূক্তিতে আটকে থাকবে না। তবে নারীর প্রতি স্বগোতক্তি করার মতো মহাজ্ঞানী মহাজনদেরও অভাব নেই। নজরুলের সেই বিখ্যাত কবিতা তো অনেকেরই জানার কথা।

সমাজে বিভেদ, বিভাজন, বৈষম্য ভুলে পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মাঝে নারীতত্ত্বের প্রকৃত প্রকাশ ঘটে। সমাজ-সভ্যতার অনুকূলতা বা প্রতিকূলতার ধাপে ধাপে নারী জ্বলে উঠেছে বহ্নিশিখার মতো। নারীত্বের গুরুত্ব বুঝতে হবে পুরুষকে। পুরুষ যদি হয় শক্তিতে বলিয়ান, নারী হয় মাতৃত্বে মহীয়ান। মানব সৃষ্টির ধারা সুসংহত রাখতে নারী ছাড়া আছে কি কোনো বিকল্প? এটাই তো নারীর শক্তির মূল উৎস।

তবে, নারীবাদীত্বের নামে কতিপয় নারীর কিছু অযৌক্তিক ও উদ্ভ্রান্ত কর্মকাণ্ডে মন খুব পীড়া দেয়। কিছু উদাহরণ দিই—

১. সারোগেসি বেবি: নিজ ফার্টাইলিটি বিদ্যমান থাকতে মাতৃত্বের স্বাদ না নিয়ে অন্য নারীর গর্ভ ভাড়া করে বাচ্চা জন্মদান কি উত্তমপন্থা? এটা কষ্ট ছাড়া কেষ্ট পাওয়ার শামিল। এভাবে মাতৃত্বের স্বাদ কি একজন নারী উপলব্ধি করতে পারে?

২. ভ্রূণহত্যা: ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ভ্রূণহত্যা এক জঘন্য অপরাধ। কিন্তু কিছু ক্যারিয়ার সচেতন বা ফিগার সচেতন নারীর কোনো কমপ্লিকেসি বা যথাযথ কারণ ছাড়া এবরসন কিংবা মিসকারেজ একটি গর্হিত কাজ। আমার মতে, এটি স্রষ্টার সৃষ্টিকে উপেক্ষার নামান্তর।

একজন নারী বিধাতা প্রদত্ত সৃষ্টির উৎস। ফারটাইলিটি হলো নারীর অর্গানিক সিম্বল। আর এটিকে প্রযুক্তির অপব্যবহারে প্রাকৃতিক ব্যাপারটিকে কৃত্রিমতার মিশ্রণে সৃষ্টির আসল রূপকে বিকৃত করে ফেলছি। আমি পৃথিবীর সব নারীকে সম্মানপূর্বক কথাগুলো বলছি। এটি শুধু তাদেরই বলা, যারা উপরোক্ত বিষয়গুলো করেছেন।এবার আসা যাক বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীর সামাজিক অবস্থান।

বাংলাদেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্যে নারী উন্নয়নের সূচক অন্যান্য উন্নত দেশের চাইতে ভালো হলেও নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য বা মেন্টাল হেলথের ক্রমানবতি আশংকাজনকভাবে বেড়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগেও নারীদের সামাজিক নিরাপত্তা, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এখনো আশাব্যঞ্জক নয়। একজন নারী এখনো তার খুব প্রয়োজনীয় স্যানিটারি ন্যাপকিন বা বার্থ কন্ট্রোল পিল সে সরাসরি কোনো ওষুধের দোকানে গিয়ে চাইতে পারে না। পাছে কোনো পুরুষ যদি আড় চোখে তাকায়। অনেক নারী তার জরায়ুর সমস্যার ব্যাপারে তার পরিবারের কাছেই শেয়ার করতে পারে না। এতে নারীর মনে সংসার ভাঙার ভয় কাজ করে। এসব বিষয়ে লোকলজ্জার ভয় নারীর মধ্যে কাজ করে। এসব কিনতে তার স্বামী, ভাই বা বাবার সাহায্য নিতে হয়। এই সমস্যাটা সমাজের নিম্ন বা উচ্চ সব শ্রেনীর নারীর মধ্যে ঘটে। যে দেশ আগামী এক দশকে রকেট উৎক্ষেপণের স্বপ্ন দেখে, যে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর অবদান পুরুষের চাইতেও বেশী, সে দেশের নারীরা তার অতিপ্রয়োজনীয় স্যানিটারি ন্যাপকিন দোকানে গিয়ে চাইতে কুণ্ঠাবোধ করে। এটার জন্য পুরুষেরই অগ্রগামী ভূমিকা পালন করতে হবে। পুরুষকেই নারীর সম্মানের জায়গাটা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

ভারতের মুম্বাইসহ বিভিন্ন শহরে একটি বিশেষ পার্টির প্রচলন আছে। এটির নাম ‘কিটি পার্টি’। সমাজের উচ্চশ্রেণির নারীরা সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে একত্র হয়ে আনন্দ করে। সেখানে সংগীত, নৃত্য, ভোজন বিলাসসহ সব ধরনের আনন্দ উপভোগে ব্যস্ত থাকে। কিটি পার্টিতে তারা তাদের সব দুঃখ ভুলে সারাদিন তাদের নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে। মজার ব্যাপার হলো— এই কিটি পার্টিতে কোনো পুরুষ এলাউড না। নারীরা এসব পার্টিতে তাদের নিজেদের নিজেরা সময় দিতে আসে। জীবনের সকল ব্যস্ততা ও কঠিন মুহুর্ত গুলোকে পাশ কাটিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেই বোধ হয় কিটিপার্টির আয়োজন।

আজ ৮ই মার্চ। বিশ্ব নারী দিবস। এই দিবসটি যেন একদিনের কিটিপার্টি না হয়। নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। নারীপুরুষের একসঙ্গে পৃথিবীতে আগমণের হেতু কি তার নিগুঢ় রহস্য উদ্ঘাটন করতে হবে। নারী হোক পুরুষের পরিপূরক। তবেই বছরের প্রতিটি দিন হবে নারীর দিন।

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ০৯ মার্চ ২০২৩ /এমএম