Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক ::‌  ঢাকা শহর কি আসলেই ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তর রয়েছে সরকার প্রণীত ভূমিকম্প ঝুঁকি নিরূপণ মানচিত্রে; যেখানে পুরো দেশকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তার মধ্যে উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন জেলাগুলো হচ্ছে সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর ও নেত্রকোনা। আর ঝুঁকি-২ বা মধ্যম ঝুঁকিতে রয়েছে চট্টগ্রাম ও পাবর্ত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা, রংপুর ও কুড়িগ্রাম। এর বাইরে দেশের অন্যান্য এলাকাগুলো কম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

১৯৮৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১২টি মাঝারি মানের ভূমিকম্প বাংলাদেশ ও এর আশপাশ অঞ্চলে হয়েছে, যার অধিকাংশেরই উৎপত্তিস্থল ছিল ভারত; বিশেষ করে ত্রিপুরা, আসাম ও মিজোরাম অঞ্চলে। ১৯৮৮ সালে ৫.৮ মাত্রার ভূমিকম্প সিলেট অঞ্চল বেশ জোরেশোরে কেঁপে উঠে, যার স্থায়িত্ব ছিল ৫০ সেকেন্ডেরও বেশি। আর এ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে এবং এর পরের বছর ১৯৮৯ সালে ফের সিলেট ও এর আশপাশ এলাকা প্রায় ৫.২ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠে। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এলাকাগুলোতে ৫.৩ মাত্রার ভূকম্পন সংঘটিত হয়। ২০০৩ সালে পার্বত্য অঞ্চলে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল, যার স্থায়িত্ব ছিল প্রায় ৪০ সেকেন্ডের মতো। সেসময় পুরো পার্বত্য এলাকাজুড়েই প্রচণ্ড ঝাঁকুনি হয়েছিল, যদিও তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ২০২১ সালে ২ ফেব্রুয়ারির সকাল ৬টায়, ৭ জুলাই বিকাল ৩টা ও অক্টোবর মাসের ২৪ তারিখে মোট তিনটি ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে, যার স্থায়িত্ব ছিল ৩০ থেকে ৫০ সেকেন্ডের মতো। ২০২২ সালে ৩০ অক্টোবর ৪.৩ মাত্রার একটি ৪০ সেকেন্ড স্থায়িত্বের ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১৮ সালে তিনবার, ২০১৯ সালে একবার, ২০২০ সালে দুবার, ২০২১ সালে তিনবার ও ২০২২ সালে একবার ভূকম্পন হয়েছে এ অঞ্চলে, যার গড় মাত্রা ছিল ৪.১ থেক ৫.৬ এর মধ্যে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ঢাকা শহরে যদি উচ্চ, মাঝারি বা বড় ধরনের ভূমকম্পন হয়, তাহলে এ শহর কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে? তুরস্ক ও সিরিয়ার সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের ফলে নগরবিদ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত ঢাকা শহরে ভূমিকম্পের আশঙ্কায় বেশ উদ্বিগ্ন। ভূতাত্ত্বিক গঠন অনুসারে ঢাকা শহর মধুপুর ফল্ট বা বিভাজনের মধ্যে অবস্থিত। এখানে প্রতিনিয়ত মাটির গভীরে টেকটোনিক প্রতিক্রিয়া বিরাজমান এবং ঢাকার বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদবেষ্টিত একটি শহর। এ দুটি নদীর সৃষ্টি হয়েছে মধুপুর টেকটোনিক বিভাজনের প্রতিক্রিয়ায়। প্রাকৃতিকভাবেই ঢাকা ও এর আশপাশ এলাকায় টেকটোনিক প্রতিক্রিয়া চলমান বা বিরাজমান থাকায় ভূমিকম্পের আশঙ্কা বহুলাংশে উসকে দেয়। আশঙ্কা করা হয়, যদি ৭ বা তার বেশি মাত্রায় ভূকম্পন হয় আর তার উৎপত্তি বাংলাদেশ বা ত্রিপুরা বা এর আশপাশে যে কোনো অঞ্চলেই হোক না কেন, এর প্রভাব বাংলাদেশ তথা ঢাকা শহরে প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হবে এবং ঢাকা শহর মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

গত কয়েক দশকে ঢাকার রূপের যে পরিবর্তন হয়েছে, তা যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে ঢাকা শহরে নগরায়ণ গত বিশ বছরে বেড়েছে ২৭ শতাংশ। ২০০১ সালে ঢাকার নগরায়ণ হয়েছিল ১১৯ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে, যা ২০২১ সালে এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০০ বর্গকিলোমিটার। একই সময়ে শহরের সবুজাংশ কমেছে প্রায় ২৯ শতাংশ। ২০০১ সালে ঢাকাজুড়ে ৩৫ শতাংশ জায়গা সবুজাবৃত ছিল, যা ২০২১ সালে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬ শতাংশে। ঢাকার জলাশয়ের আয়তনও কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। ঢাকা শহরে এক সময় উন্মুক্ত জায়গা ছিল ৩৩ শতাংশ, সেটা এখন কমে ১১ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে। উপরন্তু জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান হার যেমন-২০১১ সালে ঢাকা শহরে ১ কোটি ২০ লাখ লোকের বাসস্থান থাকলেও ২০২১ সালে এসে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গেল ১১ বছরে ঢাকা শহরে বহুতল ভবন বেড়েছে ২৫ শতাংশ হারে। ঢাকা শহর এখন আকাশমুখী ভবন নির্মাণে ধাবিত হচ্ছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, অত্যধিক জনসংখ্যার চাপ। রাজধানীকেন্দ্রিক মানুষের আগমন ঠেকানো যাচ্ছে না। এর মূলে রয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, কর্মসংস্থান ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ। বিশ্বব্যাংক বলছে, গেল বছর ঢাকার দেশজ প্রবৃদ্ধি ছিল ১৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা মোট দেশজ প্রবৃদ্ধির ৩৬ শতাংশ।

এখন যদি উচ্চ, মাঝারি বা বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়, তাহলে ঢাকা শহরের জলাশয় ভরাট করে যেসব দালানকোঠা তৈরি হয়েছে, অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে-সেসব এলাকা খুব মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যার মধ্যে বাসাবো, খিলক্ষেত, রামপুরা, আগারগাঁও, মিরপুর, ধানমণ্ডি, উত্তরা ও এর আশপাশ এলাকা ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। পুরান ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় মাঝারি মানের ভূমিকম্প হলেও অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর কারণ সরু রাস্তা ও জীর্ণশীর্ণ ভবন। মোহাম্মদপুর, বসিলা, আগারগাঁওয়ের মতো এলাকাগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জলাশয় ভরাট করে তৈরি করা হয়েছে। আগারগাঁওয়ের যেসব সরকারি অফিসপাড়া রয়েছে, এগুলোও জলাশয় ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে, যার কারণে এসব এলাকা উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। একমাত্র যেসব ভবন বিল্ডিং কোড অনুসরণ করে উপযুক্ত নির্মাণকৌশল, নকশা, গুণগতমান বজায় রেখে সঠিকভাবে নির্মাণ করা হয়েছে এবং ভবনের চারপাশে পর্যাপ্ত উন্মুক্ত জায়গা রয়েছে, সেসব ভবন অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং মানুষ নিরাপদে সেসব ভবন থেকে বের হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে আসতে পারবে। কিন্তু এর সংখ্যা কম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভবনের গায়ের সঙ্গে গা মিলিয়ে সারি সারি ভবন দাঁড়িয়ে আছে এ শহরের কোলজুড়ে; এ কারণে অপেক্ষাকৃত দুর্বল সক্ষমতার যেসব বিল্ডিং রয়েছে, সেগুলো যদি ভূমিকম্পে ধসে পড়ে তবে এর দেওয়ালজুড়ে যত ভালো মানের বিল্ডিংই করা হোক না কেন, তা আর টিকে থাকতে পারবে না।

ঢাকা শহরের মাটির গঠন-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ শহরে বেশিরভাগ অঞ্চলেই পাঁচতলার অধিক ভবন করার মতো অবস্থা নেই; অথচ সেসব জায়গায় সাত-আটতলা, দশতলা ভবনের নকশাও রাজউক থেকে অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে, যা ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বেড়ে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ হতে পারে। রাজউকের মতো একটি প্রতিষ্ঠানে প্রকৌশলী থাকলেও সেখানে কোনো ভূতাত্ত্বিক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয় না-এটিও একটি আশ্চর্যের বিষয়। অথচ এখানে ভূতাত্ত্বিক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার বহু কাজ রয়েছে। রাজউকের ঢাকা শহরের মাটির গঠন, প্রকৃতি, পানির উৎস ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা সেল থাকা দরকার, যারা অত্যন্ত সুবিবেচনাপ্রসূত হয়ে রাজউককে সঠিক পরামর্শ দেবে।

পরিশেষে বলব, ভূমিকম্প মোকাবিলায় সরকারকে এখনই সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে, বড় মাত্রার ভূকম্পন হওয়ার পর কংক্রিটের স্তূপ সরানোর জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করা, শহরের দুর্বল অবকাঠামোগুলোকে চিহ্নিত করে তা ভেঙে ফেলা বা রেক্ট্রোফিকেশন করা, নতুন ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড সঠিকভাবে মেনে চলা, রাজউককে শক্তিশালী করা, রাজউক থেকে দুর্নীতি নির্মূল করা, সঠিকভাবে ভবনের নকশা প্রণয়ন ও তা যাচাই করা, জায়গাভেদে চার-পাঁচতলার বেশি উচ্চভবন না করা, ক্লাস্টার হাউজিংয়ে নিরুৎসাহিত করা, জলাশয় ভরাট করে ভবন নির্মাণ না করা, জলাশয় ভরাট আইনত দণ্ডনীয় তা প্রতিপালন করা, শহরের খালগুলো পুনরুদ্ধার করা, নদীগুলো দূষণমুক্ত রাখা এবং সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের নিয়ে ভূমিকম্প সেল গঠন করা ইত্যাদি। ভূমিকম্পের ক্ষতি কমাতে জনসচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডে ভূমিকম্পবিষয়ক সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন করা, প্রতিটি অফিসে মাঝেমধ্যে ভূমিকম্প নিয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হলে তা ব্যাপকহারে শহরের মানুষদের উজ্জীবিত করবে এবং মানুষ ভূমিকম্পের সময়ে করণীয় সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন হবে।

হাসান কামরুল : জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ /এমএম