Menu

প্রধানমন্ত্রীকে ডুবাচ্ছে, না ভাসাচ্ছে?

বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: লন্ডন থেকেও নিয়মিত দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার পাশাপাশি ডেঙ্গুসহ অন্যান্য বিষয়ে নজর রাখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। লন্ডনের ওয়েস্ট মিনিস্টার এলাকায় সেন্ট্রাল হলে নাগরিক সভায় তিনি নিজেই জানালেন এ কথা। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, চোখের চিকিৎসার জন্য লন্ডনে থাকলেও তিনি প্রতি মুহূর্তেই দেশের খবর রাখছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতির সার্বক্ষণিক খোঁজ নিচ্ছেন। তথ্যটির সঙ্গে কারো দ্বিমত বা ভিন্নমত থাকার কথা নয়।

বরাবর তিনি এমনই। দেশ-বিদেশে যেখানেই থাকেন সবদিকের তথ্যে আপডেট থাকেন। নজর রাখেন। এ বাস্তবতায় ধারণা করা হয় ডেঙ্গু নিয়ে দুই মেয়র ও কয়েক মন্ত্রীর ফ্রিস্টাইল গলাবাজি, ঝাড়ুবাজির ফটোসেশনও তার নজরে পড়েছে। ডেঙ্গুর বিস্তার নিঃসন্দেহে জাতীয় বিপর্যয়। এটিকে পাশ কাটানো রাষ্ট্রের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের পক্ষে শুধু দায়িত্বহীনতা, কর্তব্যবোধহীনতার প্রমাণ দেয় না। তা পরিমিতি বোধহীনতাও বটে। বিষয়টি শুধু প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ারাধীন নয়, জনগণেরও। ডেঙ্গু নিয়ে উদ্বেগজনক সময়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সপরিবারে মালয়েশিয়া ভ্রমণ করেছেন। জনগণের মধ্যে যখন ডেঙ্গু নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তখন উপরের কিছু ব্যক্তি এটাকে গুজব দাবি করে এর গুরুত্ব খাটো করার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছেন। এগুলোও প্রধানমন্ত্রীর নজর না এড়ালে মানুষ বেশ খুশি হবে।

এদিকে, দিন কয়েক আগে ডেঙ্গু প্রতিরোধে পরিচ্ছন্নতা অভিযানে নেমেছে তার দল আওয়ামী লীগ। তিনদিনের দলীয় এ পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি ঘোষণার সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, লন্ডন থেকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই তাদের এ কর্মসূচি। ডেঙ্গু মোকাবেলায় কার্যকর ওষুধ ছিটাতে ঢাকার দুই সিটি মেয়র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন বলে তথ্যটাও জানিয়েছেন তিনি। এমন তথ্যের মধ্য দিয়ে কী বার্তা দিলেন তার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক? এমন দুর্যোগপূর্ণ সময়ে মশা মারার মতো একটি জরুরি কর্মসূচির জন্যও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ লাগে? প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ না আসায় এতদিন দেরি হয়েছে কর্মসূচিটি ঘোষণা করতে? এর সঙ্গে প্রাসঙ্গিকভাবে আরো কিছু প্রশ্ন এসে যায়।

প্রধানমন্ত্রী কি তবে কোনো কাজ করতে দেন না মন্ত্রী, আমলা, প্রশাসনকে? না-কি তাদের ওপর ভরসা নেই তার? সব কাজ প্রধানমন্ত্রীকেই করতে হলে তাদের কী কাজ? সব কিছুতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের জানান দিয়ে তাকে ডুবানো হচ্ছে, না ভাসানো হচ্ছে-এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বিভিন্ন মহলে। খুনের আসামিকে ধরতেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ প্রচারের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। সব কিছুতেই প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি লাগলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উজির-নাজিরদের কাজটা কি? কেবল আগডুম-বাগডুম বেফাঁস মন্তব্য করা? ফটোসেশন করা? কিছুদিন আগে ওবায়দুল কাদেরই জানিয়েছিলেন বরগুনার পান্ডা মিন্নির হত্যাকারী নয়ন বন্ডকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তার এমন জানান দেয়ার পরপরই নয়ন বন্ড ধরা পড়ে। পরে বন্দুকযুদ্ধে বা ক্রসফায়ারে তার মৃত্যুও হয়।

এভাবে সবকিছুতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের কথা বলে তাকে কোথায় নিয়ে ঠেকানো হচ্ছে- প্রশ্নটি এড়ানোর সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রী না বললে দেশে কোনো কাজ হবে না? তাহলে চুরি-চামারিগুলো হচ্ছে কার নির্দেশে? একদিন যে সেগুলোও তার নির্দেশের তালিকায় ফেলে দেয়া হবে না সেটার গ্যারান্টি কোথায়? সব কিছুতেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ দিতে হবে? জনগণ আর প্রধানমন্ত্রীর মাঝখানে কি কোনো প্রশাসন বা কোনো কর্তৃপক্ষ নেই? কিছুদিন আগে দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকেও প্রশ্ন ছোড়া হয়েছে সবকিছুতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ দেয়ার বিষয়ে। সেই ঘটনাটা ছিল আড়ংয়ে অভিযান পরিচালনাকারী ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের উপপরিচালক মোহাম্মদ শাহরিয়ারকে বন্ধের দিনে যেভাবে বদলি করা নিয়ে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পরে তার বদলি রদ হয়েছে।

কিন্তু, যারা বদলি করেছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ঘটনাটিকে লজ্জাজনক বলে মন্তব্য করেছে হাইকোর্ট। মন্তব্যে বলা হয়েছে, বন্ধের মধ্যে ওই কর্মকর্তাকে বদলির আদেশ স্থগিতে প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। যদি সব কিছুতেই প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়, তাহলে সচিবরা কেন আছেন? তারা কী ওদের পকেটে ঢুকে গেছেন? এ সময় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন একজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল। শুনানিতে আড়ং ইস্যুতে আদালত বলেন, “আড়ংয়ে অভিযান পরিচালনাকারী ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের উপপরিচালক মোহাম্মদ শাহরিয়ারকে বন্ধের দিনে যেভাবে বদলি করা হয়েছে সেটা লজ্জার। যারা বদলি করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এ ধরনের বদলির ফলে যারা সৎ অফিসার, তারা কাজ করতে নিরুৎসাহিত হন।

প্রধানমন্ত্রীর অধীনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় রয়েছে। তার বাইরে তাঁকে সারাদেশের হাজারো সমস্যা নিয়ে ভাবতে হয়, অন্যান্য মন্ত্রণালয়েরও তদারকি করতে হয়। আবার এ কথাও সত্য দলে, সরকারে, দেশে অনন্য উচ্চতায় চলে গেছেন শেখ হাসিনা। বলা হয়ে থাকে তিনি একাই একশ’। তার তুলনা তিনি নিজেই। তাকে ছাড়া এখানে কোনো কাজই হয় না। হচ্ছে না। সহযোগী বা সহকর্মীরা তাকে ছাড়া অকর্মা। তাই বলা হচ্ছে, জনগণের এত কষ্টের টাকায় উচ্চ বেতন-ভাতা, দামি গাড়ি-বাড়িসহ রাজকীয় সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কেন পুষবেন এই অকর্মাদের? শুধু পোষা নয়, এই পালের দায়ও নিতে হয় প্রধানমন্ত্রীকে। সব কাজের দায় প্রধানমন্ত্রীর ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেকে সাধু বানানোর এই প্রবণতা আমলাসহ অনেকেরই রয়েছে। এর একটা ভয়ানক খারাপ দিক আছে। এমন কিছু দায় বেগম খালেদা জিয়াসহ সাবেক ক্ষমতাধর অনেককেই নিতে হয়েছে। এক সময় মন্ত্রী-এমপিদের নির্দেশের নামে নানা অঘটন ঘটানো হতো। শোনা যেত প্রতারণার কথা।

সময়ের স্রোতে এবারের যাত্রায় সেটা মন্ত্রী-এমপিতে নেই। তা এসে ঠেকেছে প্রধানমন্ত্রীতে। যে যেখান দিয়ে পারছেন খুচরা দরেও বিক্রি করে দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীকে। শোনাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ, ডিজায়ারসহ নানা কিছিমের কাহিনী। তার নামে ধান্ধা ও ধরিবাজির বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা মাঝেমধ্যে গণমাধ্যমে আসছে। শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারের সদস্যদের নামে ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আদায়ে জড়িত একটি চক্রের কিছু সদস্য ধরাও পড়েছে। ‘বিষয়টি পিএমের নলেজে আছে’ এমন আওয়াজ দিয়ে বহু কর্ম সেরেছে তারা। পরে তাদের জনাকয়েক ধরা পড়লেও এর কোনো ফলোআপ খবর নেই। প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠানোর কথা বলে পটুয়াখালীর কুয়াকাটার পৌর মেয়রের টুরিস্ট পুলিশের কেনা দুটি কোরাল মাছ নিয়ে যাওয়ার খবরও এসেছে গণমাধ্যমে।

কুয়াকাটা টুরিস্ট পুলিশের উপ-পরিদর্শক মো. শাহ আলম তার ভাইয়ের মেয়ের বিয়ে অনুষ্ঠানের জন্য ১৫-২০ দিন ধরে খুঁজে ২২ হাজার টাকায় বড় সাইজের দুটি কোরাল মাছ জোগাড় করেছিলেন। মাছ দু’টি তিনি রেখেছিলেন স্থানীয় একটি মাছের আড়তে। ডেলিভারি নেয়ার আগে, হঠাৎ মাছের আড়ৎদার বশির ফোন দিয়ে জানান তার ফ্রিজে রাখা ওই কোরাল মাছ দুটি কুয়াকাটা পৌর মেয়র বারেক মোল্লা নিতে এসেছেন। তিনি বশিরের ফোন থেকেই মেয়রের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু মেয়র তাকে বলেন, এই মাছ প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠাতে হবে। আমি কুয়াকাটার মেয়র, আমি এত বড় মাছ পাই না আর তোমরা পুলিশ হইয়া এত বড় মাছ এখান থেকে নিবা? এসআই আক্ষেপ করে তখন স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আমরা পুলিশ অন্যায় করলে মিডিয়া বড় করে তুলে ধরে। আজ আমার সঙ্গে অন্যায় করছেন মেয়র সাহেব। তিনি ক্ষমতাধর বলে সেটা সাংবাদিকরা তুলে ধরবে না? এ ধরনের প্রবণতার সাহস কেন হচ্ছে-এ প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা হতে পারে।

সেদিকে না গিয়ে শুধু বলতে হয়, গোটা প্রেক্ষিতটা প্রধানমন্ত্রী নামক প্রতিষ্ঠানটির সম্মান ও গুরুত্বের জন্য অশনি সঙ্কেত। দেশের জন্য অমর্যাদাকর। বিবেকবান যে কারোরই তা বোধগম্য।

বাংলানিউজসিএ/ঢাকা / ০৬ আগস্ট ২০১৯/ এমএম


Array