Menu

কেবল স্বার্থই অভিবাসীদের কাছে টানে

বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: দীর্ঘ ৪৪ বছর পর বহু প্রতীক্ষিত ক্রিকেট বিশ্বকাপে বিজয়ী হল ইংল্যান্ড। অনেক খেলার জন্মভূমি ইংল্যান্ড, খেলাগুলোর আসরও ইংল্যান্ডেই সবচেয়ে বেশি বসে। যদিও শিরোপা জয়ের রেকর্ড তাদের খুবই কম। ফুটবল, ব্যাডমিন্টনে কিছুটা অর্জন থাকলেও ইংল্যান্ডের ক্রিকেটে বড় অর্জন ছিল প্রায় অধরা।

২০১৯ সালে হয়ে গেল ক্রিকেট বিশ্বকাপের ১২তম আসর। এর আগে ক্রিকেটের জন্মদাতা দেশ ইংল্যান্ড ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তিনবার ফাইনাল খেললেও কোনো বারই শিরোপার দেখা পায়নি। ২০১৫ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ইংল্যান্ড ৪৭টি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ খেলে, যার মধ্যে ৩৪টিতেই জয় পায়।

এ অর্জনের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব দেয়া যায় এবারের ইংল্যান্ড দলটিকে। এমন একটি দল নিয়ে ইংল্যান্ড মাঠে খেলেছে যেখানে এশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ক্যারিবীয় অঞ্চলের খেলোয়াড়দের দেখা গেছে। আসলে এবারের বিশ্বকাপের ইংল্যান্ড দলটিকে বহুজাতিক, বহুদেশিক, বহুসাংস্কৃতিক দল বললেই ভালো হয়।

এ বহুমাত্রিক প্রতিভার ওপর ভর করেই ইংল্যান্ড ক্রিকেটে এবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হল, যে দলের সাত ক্রিকেটারই অভিবাসী। ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ইয়ান মরগান ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ডের হয়ে খেলেছিলেন। ২০০৯ সাল থেকে মরগান ইংল্যান্ডের হয়ে খেলা শুরু করেন।

লেগ স্পিনার আদিল রশিদ পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত। ২০০৯ সালে ইংল্যান্ডের হয়ে খেলা শুরু করেন তিনি। মইন আলির জন্ম ব্রিটেনে হলেও সে আসলে পাক বংশোদ্ভূত। ওপেনার জেসন রয়ের জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকায়। ২০১৪ সাল থেকে ইংল্যান্ডের হয়ে খেলছেন তিনি। বিশ্বকাপ ফাইনালের নায়ক বেন স্টোকস একজন কিউই। ২০১১ সাল থেকে ইংল্যান্ডের হয়ে নিয়মিত খেলছেন তিনি।

বিশ্বকাপ স্কোয়াডে থাকা অলরাউন্ডার টম কুরানের বাবা কেভিন কুরান খেলেছিলেন জিম্বাবুয়ের হয়ে। ফাইনালে সুপার ওভারের নায়ক জফরা আর্চার জন্মগতভাবে একজন জ্যামাইকান। চলতি বছরের মে মাসে আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের হয়ে প্রথম খেলেন আর্চার। একই চিত্র আমরা দেখি গত ফুটবল বিশ্বকাপেও। ২০১৮ ফুটবল বিশ্বকাপজয়ী ফ্রান্স দলের অধিকাংশ তারকা ছিলেন বিদেশি।

সেবার বিশ্বকাপজয়ী ফ্রান্স দলে আফ্রিকান খেলোয়াড়দের আধিক্যই দেখা গেছে। একেবারে প্রথম সারির তারকা পল পগবা, কিলিয়ান এমবাপ্পে, সামুয়েল উমতিতি, অলিভার জিরু, মাতুইদি, এনগোলো কন্তেরা- কেউই ফরাসি নন। পল পগবার জন্ম ফ্রান্সে হলেও তার বাবা-মা ছিলেন গিনির বাসিন্দা। এমবাপ্পের মা আলজেরিয়ার, বাবা ক্যামেরুনের। ডিফেন্ডার সামুয়েল উমতিতি জন্মেছেন ক্যামেরুনে। দ্বিতীয় গোলকিপার স্টিভ মন্দানা ছিলেন কঙ্গোর বাসিন্দা। মাতুইদির বাবা ছিলেন কঙ্গোর বাসিন্দা। কন্তের বাবা-মা ছিলেন মালির বাসিন্দা। এছাড়াও দলের একাধিক তারকা বিদেশি বংশোদ্ভূত। সেবার অনেকেই ফ্রান্স দলটিকে বলছিলেন আফ্রিকা একাদশ।

খেলাধুলার ক্ষেত্রে ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশেই এরকম চিত্র ধরা পড়ে, যে চিত্রটি বৈচিত্র্যপূর্ণ, পারস্পরিক সহাবস্থান, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের প্রতীক। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয়, এ ধরনের চিত্র খেলার মাঠে যতটা নিয়মিত দেখা যায়, মাঠের বাইরে ততটাই অনিয়মিত। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ বর্তমানে ইংল্যান্ড তথা ইউরোপের অন্যতম আলোচিত বিষয় অভিবাসী সমস্যা। ইউরোপে প্রায় প্রতিটি দেশ দল-মত নির্বিশেষে অভিবাসী ও শরণার্থীদের বিপক্ষে খড়গহস্ত।

অভিবাসীদের বিপক্ষে কঠোর আইন প্রণয়নসহ অমানবিক পদক্ষেপ নিয়েছে অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশ। অভিবাসীদের জন্য অস্ট্রিয়া সীমান্ত পারাপারের ট্রেন সার্ভিস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। হাঙ্গেরি সীমান্তে বেড়া দেয়া হয়েছে। অভিবাসীদের স্টেশনে না আনতে বিভিন্ন বাস কোম্পানি ও স্বেচ্ছাসেবীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপীয়রা। ফ্রান্স কঠোর অভিবাসী নীতি প্রণয়নের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নকে চাপ দিচ্ছে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো অভিবাসী নীতিতে অনমনীয় আছে। কয়েকদিন আগের এল সালভাদরের আলবার্তো মার্টিনেজ থেকে সিরিয়ার বালক আইলান কুর্দির সমুদ্রসৈকতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকার দৃশ্য তার প্রমাণ দেয়।

এখনও ইউরোপের কাঁটাতারে ঝুলে অথবা পানিতে ডুবে অভিবাসীদের মরার খবর পাওয়া যায়। ব্রিটেন-ফ্রান্স কেলাস সীমান্তে আফ্রিকা, এশিয়া থেকে অভিবাসন প্রত্যাশী অভিবাসীদের সঙ্গে চরম অবমাননাকর আচরণের খবর প্রকাশিত হয়।

সেখানে একবার ব্রিটেন তাদের ফ্রান্সের দিকে তাড়িয়ে দিচ্ছিল, আরেকবার ফ্রান্স তাদের ব্রিটেনের দিকে তাড়িয়ে দিচ্ছিল। এ ক্ষেত্রে ইংল্যান্ড সবাইকে ছাড়িয়ে ২০১৬ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যেটা বহুল আলোচিত ব্রেক্সিট। ব্রেক্সিট ইস্যুতে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ইউরোপজুড়ে সৃষ্ট অভিবাসী সমস্যা। ইংল্যান্ডের যুক্তি হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি সীমান্তবিহীন আঞ্চলিক সংগঠন, যাতে বিভিন্ন দেশের বৈধ-অবৈধ অভিবাসীরা প্রায় বিনা বাধায় ইংল্যান্ডে প্রবেশ করতে পারে।

যারা ইংল্যান্ডের অর্থনীতির জন্য অনেক বড় হুমকি। চাকরি, আবাসন ও নিরাপত্তার সঙ্গে অভিবাসীদের সংখ্যা অনেক গভীরভাবে জড়িত। আর এর কারণে ইংল্যান্ড চায় না সেখানে নতুন করে কোনো অভিবাসী আসুক বা থাকুক। শুধু ইংল্যান্ড নয়, এ শরণার্থী ও অভিবাসন প্রত্যাশীদের বিরুদ্ধে পৃথিবীর তথাকথিত উন্নত, আধুনিক দেশগুলোর অবস্থান সম্পূর্ণ অমানবিক ও কঠিন।

ক্ষমতায় আসার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিবাসীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। তার নির্দেশ, অবৈধ অভিবাসীদের সপরিবারে ‘ঘাড়ধাক্কা’ দিতে হবে। ট্রাম্পের স্পষ্ট হুশিয়ারি, ‘ওদের তাড়াতেই হবে’। মেক্সিকান অভিবাসীদের আটকাতে ডোনাল্ড ট্রাম্প মেক্সিকো-আমেরিকা সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের কাজ শুরু করছেন। আমেরিকার ভেতরে ডিটেনশন ক্যাম্প করে অভিবাসীদের তাদের পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হচ্ছে।

বিশেষ করে ধরপাকড়ে প্রচুর শিশু তাদের বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ইউরোপে সে চিত্র আরও ভয়াবহ। সেই মর্মান্তিক খেলায় অন্তত নয়জনের মৃত্যু ঘটেছিল। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব মাইগ্রেশনের (আইওএম) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বিশ্বে আন্তর্জাতিক অভিবাসীর সংখ্যা ছিল ২৪ কোটি ৪০ লাখ।

কেন এই অভিবাসী বা শরণার্থী সংকট? আর কেনই বা তাদের নিয়ে উন্নত বিশ্বের এত অনীহা? শরণার্থীরা বেঁচে থাকার সামান্য অধিকারটুকু খুঁজতে নিজের দেশ পাড়ি দেয় আর অভিবাসীরা উন্নত জীবনযাত্রার মানের প্রত্যাশায় জন্মভূমি ছেড়ে বিদেশে গমন করে। দুই ক্ষেত্রেই বিদেশ গমনের যে প্রক্রিয়া তা খুবই কঠিন, অমানবিক ও ঝুঁকিপূর্ণ। অভিবাসনের ক্ষেত্রে সাধারণ কারণগুলো অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক বা পরিবেশগত হতে পারে।

বিগত কয়েক বছর শরণার্থী ও অভিবাসী সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। এ ক্ষেত্রে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে চলতে থাকা রাজনৈতিক অস্থিরতা, গৃহযুদ্ধ ও যুদ্ধংদেহী পরিবেশ, আফগানিস্তানের তালেবান সৃষ্ট জটিলতা, আফ্রিকান দেশগুলোর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে লেগে থাকা যুদ্ধ ও অতিমাত্রায় দারিদ্র্য। এছাড়া পুঁজিবাদী অর্থনীতির কবলে পড়ে সম্পদের মালিক হয়ে উঠছে ব্যবসায়ীরা আর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সরকার ব্যয় সংকোচনের নামে জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো হরণ করে নিচ্ছে।

ফলে জীবনযাত্রার মান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করে অভিবাসীরা পাড়ি দিচ্ছে শ্বাপদসঙ্কুল পথ। অভিবাসনের পেছনে বিশ্বের আধুনিক সভ্য জাতিদের দায়ও কোনো অংশে কম নয়। পৃথিবীর ডেমোগ্রাফি অনুযায়ী, এশিয়া আর আফ্রিকাতে বাস করে পৃথিবীর প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ আর ২০ শতাংশ বাস করে পৃথিবীর বাকি অংশে। অর্থনৈতিকভাবে পৃথিবীর ওই ২০ শতাংশ মানুষের হাতেই আছে ৮০ শতাংশেও বেশি সম্পদ।

এ সম্পদের অসম মালিকানার ক্ষেত্রে গ্লোবালাইজেশন বিশাল ভূমিকা রেখেছে। বিশ্বগ্রাম ধারণার প্রবর্তন করে গ্লোবালাইজেশনকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে ওই ২০ শতাংশ সম্পদশালী দেশগুলোর প্রয়োজন পড়ে সম্পদহীন; কিন্তু জনঅধ্যুষিত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে। জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফ অ্যান্ড ট্রেড (গ্যাট) থেকে ডব্লিউটিওতে রূপান্তরের চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে যখন ফ্রি বা ওপেন মার্কেট ইকোনমির ধারণা চালু করা হয়, তখন সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত বিষয় ছিল ফ্রি মার্কেট ইকোনমির কারণে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগতভাবে সমৃদ্ধিশালী দেশগুলো তৃতীয় বিশ্বের বাজারগুলোকে দখল করে নিতে পারবে।

যার ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর পণ্য ও সেবার একচেটিয়া বাজারে পরিণত হবে। সেই সময় তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল উন্নত দেশগুলোর পণ্য ও সেবার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকার মতো পণ্য ও সেবা কোনোটিই তাদের নেই। তাদের যেটা আছে সেটা হচ্ছে অধিক জনসংখ্যা। তাই এ অধিক জনসংখ্যার জন্য উন্নত দেশগুলোর শ্রমবাজার উন্মুক্ত করতে হবে। এ দাবি অনেকটা নীরবেই অভিবাসন প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে।

পেরিয়ে গেছে অনেকটা সময়; কিন্তু এ দাবি এখনও অপূরণীয় আর প্রাপ্তি নেই তেমন একটা। জটিল ও কঠিন আইনের মারপ্যাঁচ আর দক্ষ-অদক্ষতার মাপকাঠিতে ফেলে তৃতীয় বিশ্বের জনগণের জন্য বিদেশি শ্রমবাজারকে অনেকটা ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখা হয়েছে। যারা অনেক বাধা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে উন্নত দেশগুলোতে শ্রমজীবী হিসেবে আছে তাদের সহ্য করতে হয় সীমাহীন বৈষম্য। যাবতীয় নিুমানের কাজ করানো এবং সেই তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য মজুরি দেয়া অনেকটা আইন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবে একটি বিষয়ে এ আধুনিক সভ্য দেশগুলোর আচরণ প্রায় এক। তা হল, সব দেশই চায় তৃতীয় বিশ্বের সর্বোচ্চ মেধা ও যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষগুলোকে প্রয়োজন মতো ব্যবহার করতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, হাসপাতালের ডাক্তার, রিসার্চ ল্যাবরেটরির গবেষক, ফুটবল থেকে ক্রিকেট মাঠ সব জায়গায়তেই আমরা দেখি অভিবাসীদের জয়জয়কার। আর সীমান্তে দেখি কখনও পুলিশের গুলিতে, কখনও নৌকাডুবিতে, কখনও না খেয়ে মারা যাওয়া অভিবাসীদের মিছিল। অভিবাসীদের নিয়ে আধুনিক উন্নত বিশ্বের এ এক দ্বিমুখী স্বার্থপরতার নীতি, যার পেছনে সম্পূর্ণরূপে অমানবিক ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে; যা এখন এক ধ্বংসাত্মক বিশ্বনীতিতে পরিণত হয়েছে।

বাংলানিউজসিএ/ঢাকা / ০৩ আগস্ট ২০১৯/ এমএম