Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক ::‌ ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’, নাকি ‘বোঝার উপর শাকের আঁটি’ অথবা ‘গোদের উপর বিষফোঁড়া’? বিদ্যুতের সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধিকে কী বলে আখ্যায়িত করা যায় সেটাই ভাবছিলাম। উল্লিখিত তিনটি প্রবচন বা বাগ্ধারার মর্মার্থ আসলে একই-দুর্ভোগের ওপর আরও দুর্ভোগ।

প্রায় তিন বছর ধরে করোনা মহামারি মানুষের অর্থনৈতিক জীবনধারাকে বিপর্যস্ত করেছে। মধ্যবিত্ত হয়েছে নিম্নবিত্ত। আর নিম্নবিত্ত হয়েছে দরিদ্র। উচ্চবিত্তদের সমস্যা হয়নি, তাদের টাকার জোর আছে। অল্পসংখ্যক উচ্চবিত্তকে বাদ দিলে দেশের সবকটি পরিবার ও মানুষ অর্থনৈতিক সমস্যায় বিপর্যস্ত।

করোনা মহামারির কামড় যখন আলগা হতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই আঘাত হানল ডেঙ্গি মহামারি। চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৫৪ হাজার ডেঙ্গি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এ রোগে মৃতের সংখ্যা সারা দেশে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত ২৩৭। ডেঙ্গির এমন ব্যাপক বিস্তার আগে কখনো দেখা যায়নি। জনগণ এখন একই সঙ্গে করোনা ও ডেঙ্গির কারণে দিশেহারা।

মহামারি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনগণের যখন নাভিশ্বাস উঠেছে, ঠিক তখনই আরেকটি ‘শুভ সংবাদ’ পাওয়া গেল! সরকারের জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি সংস্থা (বিইআরসি) জানাল, বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য বাড়ানো হয়েছে। বৃদ্ধির হার প্রায় ২০ শতাংশ। ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম ৫ টাকা ১৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ২০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন দাম ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হবে বলা হয়েছে। এ মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তে সবাই উদ্বিগ্ন। বিদ্যুতের দাম বাড়লে খরচ বাড়বে কৃষি, শিল্প উৎপাদন ও সেবা খাতে। এর ফলে ইতোমধ্যে বর্ধিত দ্রব্যমূল্য আরেক দফা বাড়বে।

করোনা মহামারি চলাকালেই এ বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, যা এখনো চলছে। এ যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া পড়েছে বিশ্বের সর্বত্র। সব দেশের অর্থনীতি কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশও বাদ যায়নি। যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে দেশের শিল্প খাতে। এর ফল ভোগ করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষ তথা ভোক্তা-গ্রাহকদের। করোনা ও যুদ্ধ-এ দুই কারণে আমদানি করা ও দেশে উৎপাদিত সব পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। বহু পণ্য নিম্নআয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে।

বেঁচে থাকার জন্য মানুষের প্রধান প্রয়োজন খাদ্য-চাল, ডাল, তেল, সবজি। এসব পণ্য যারা ক্রয় করেন, তারা জানেন বাজারের অবস্থা কী। নিম্ন আয়ের মানুষকে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার জন্য সরকার ওএমএস (খোলাবাজারে বিক্রি) চালু করেছে। এতে ক্রেতারা কম দামে চাল, ডাল, আটা কিনতে পারেন। ওএমএস ট্রাকের পেছনে মানুষের যে দীর্ঘ লাইন দেখা যায়, তা থেকেই বোঝা যায় পরিস্থিতি কেমন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও ক্রেতাদের অনেকেই তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহ করতে পারেন না। কাঁচাবাজারে শাকসবজির অভাব নেই, কিন্তু দাম এখনো নিম্ন আয়ের মানুষের নাগালে আসেনি। মাছ-মাংস সম্পর্কে বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা বলেছে, এসব আমিষ খাদ্যের দাম এতটাই বেড়েছে যে বহু পরিবার মাছ-মাংস কেনা বন্ধ করেছে।

জীবনযাত্রায় সংকট বাড়বে

দ্রব্যমূল্যের এমন পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের দাম যদি আরও বাড়ে, তাহলে মানুষের জীবনযাত্রার সংকট আরও বাড়বে। বলা হচ্ছে, বিদ্যুতের দাম বাড়বে পাইকারি পর্যায়ে, গ্রাহক পর্যায়ে এখন বাড়বে না। এর অর্থ দাঁড়ায়, অদূরভবিষ্যতে গ্রাহক পর্যায়েও দাম বাড়বে। পাইকারি পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব গ্রাহক পর্যায়ে পড়তে বাধ্য। ইতোমধ্যেই বিতরণ কোম্পানিগুলো বিদ্যুতের খুচরা দাম ২০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে নিত্যপণ্যের আরেক দফা মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। তা-ই যদি হয়, সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়?

এ দেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো কোনো নতুন ঘটনা নয়। প্রায় প্রতি বছরই বাড়ানো হয়। এর কারণ হিসাবে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলে থাকে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে যা খরচ হয়, বিক্রয়মূল্য তার চেয়ে কম। এজন্য সরকারকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ভর্তুকি দিতে হয়। ভর্তুকি কমানোর উদ্দেশ্যেই বিক্রয়মূল্য বাড়াতে হয়।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ ও বিদ্যুৎ বিক্রি থেকে আয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে এটা সত্য। বিদ্যুৎ খাতে লোকসান হওয়ায় ভর্তুকি দিতে হয়, লোকসান কমানোর জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হয়। কিন্তু লোকসানের আসল কারণ সিস্টেম লস। উৎপাদিত বিদ্যুতের সিস্টেম লস বা অপচয় পর্যাপ্ত পরিমাণে কমাতে পারলে ভর্তুকিও অনেক কমে আসবে। পাওয়ার প্ল্যান্টে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর তা সরবরাহের জন্য বিতরণকেন্দ্রে যায়, সেখান থেকে যায় গ্রাহকের কাছে।

উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিতরণকেন্দ্রে যাওয়ার পথে কারিগরি কারণে কিছু অপচয় হয়। গ্রাহকের কাছে সরবরাহের সময় আরও কিছু সিস্টেম লস হয় একই কারণে। কারিগরি ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এ সিস্টেম লস দূর করা সম্ভব। কর্তৃপক্ষ যদি এটা করতে পারে, তাহলে সিস্টেম লস সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে।

অবাধে বিদ্যুৎ চুরি

বিদ্যুৎ চুরি এ খাতে অপচয়ের বড় কারণ। অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে বিদ্যুৎ চুরি করা হয় এবং এ চুরিকে সিস্টেম লস বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। অবৈধ সংযোগ দেওয়ার কাজটা করে বিদ্যুৎ বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ঢাকা মহানগরীতে পাঁচ হাজারের বেশি বস্তি রয়েছে। বস্তিগুলোতে অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়। এজন্য বস্তিবাসীদের কাছ থেকে টাকাও নেওয়া হয়। এসব বস্তিতে বিদ্যুৎ গেলেও সরকার এক পয়সাও পায় না, ফলে বিপুল পরিমাণ লোকসান হয়।

ঢাকা নগরীতে যারা বসবাস করেন, তারা দেখেছেন ফুটপাতে হাজার হাজার হকার দোকান সাজিয়ে বসেন এবং সেগুলোতে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে। এখানেও অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়। এভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে অসাধু ব্যক্তিরা হকারদের কাছ থেকে টাকা নেয় ঠিকই, কিন্তু সরকার কিছু পায় না। ফুটপাতের হকার, বস্তি, বাজার, দোকানপাট ছাড়াও দেশের সর্বত্র অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে বিদ্যুৎ চুরি হচ্ছে। এতে সরকারের লোকসান বাড়ছে। এর মাশুল দিচ্ছেন বৈধভাবে বিদ্যুতের সংযোগ গ্রহণকারী গ্রাহকরা।

কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে বিদ্যুৎ চুরি বন্ধ করতে পারলে তথাকথিত সিস্টেম লস অনেক কমে যাবে। ভর্তুকি দেওয়ার প্রয়োজনও হয়তো হবে না। ভর্তুকি দিলেও তা অনেক কম হবে, সরকারের ক্ষতিও কমে আসবে। বিদ্যুতের দামও বাড়াতে হবে না।

বিদ্যুৎ খাতে বিশৃঙ্খলা, অব্যবস্থা

বিদ্যুৎ বিতরণ ও সরবরাহের ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থাপনার কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। গ্রাহকদের কাছ থেকে বিদ্যুতের মূল্য আদায়ের জন্য মিটারের ব্যবস্থা রয়েছে শুরু থেকেই। মিটার রিডারদের কারসাজিতে ও সহযোগিতায় এক সময় ব্যাপকভাবে বিদ্যুৎ চুরি হতো। মিটার পদ্ধতি আধুনিক করায় চুরি এখন অনেকটা কমেছে, কিন্তু বন্ধ হয়নি। দেশের সর্বত্র আধুনিক মিটার বসানোও যায়নি।

সম্প্রতি প্রিপেইড মিটার চালু হয়েছে ঢাকা মহানগরীর কিছু এলাকায়। এ পদ্ধতিতে মিটার কারচুপির সুযোগ থাকে না। মোবাইল ফোন রিচার্জের মতো বিদ্যুৎ গ্রাহকরা প্রিপেইড মিটারে আগেই টাকা জমা দেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী খরচ করেন। এক্ষেত্রে কারচুপি বা চুরির পথ নেই। প্রিপেইড মিটার সর্বত্র চালু করা গেলে সার্বিকভাবে বিদ্যুৎ বিক্রির ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা আসত, বিদ্যুৎ চুরি ও কারচুপি বন্ধ হতো।

অর্থনৈতিক কারণে দেশের মানুষ সংকটের মধ্যে আছেন। এ অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে সাধারণ মানুষের জীবন অসহনীয় অবস্থায় গিয়ে পড়বে। আশা করা যায়, সরকার পরিস্থিতি অনুধাবন করবে। বিদ্যুৎ খাতে বিশৃঙ্খলা, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি দূর করে লোকসানের পরিমাণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। ভর্তুকি কমানোর নামে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ দেওয়া উচিত হবে না।

চপল বাশার : সাংবাদিক, লেখক

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ২৮ নভেম্বর ২০২২ /এমএম