বাংলানিউজসিএ ডেস্ক ::পদ্মা সেতু আমাদের স্বপ্নের স্থাপনা, সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে চলছে বিরাট আয়োজন। স্বাভাবিকভাবে চ্যালেঞ্জটাও তাই বেশি। দেশি-বিদেশি গভীর ষড়যন্ত্র চলছে আমাদের এই স্বপ্নের অগ্রযাত্রা রুখতে এই কথা কে না জানে? সেই ষড়যন্ত্র নানান রূপে নানানভাবে আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হচ্ছে। কিন্তু এই বিশাল আয়োজনে সব প্রস্তুতি কি আমাদের আছে? বিশেষ করে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা মোকাবিলার। যে গুজবে আজকে সয়লাব বাংলাদেশ, তার শুরুটা তো হঠাৎ করে দুদিন ধরে হয় নাই। অনেকদিন ধরেই এটাকে নিয়ে হাস্যরস এবং নানান ধরনের মেমে সোশ্যাল মিডিয়াতে ঘুরপাক খাচ্ছে।
আমাদের গোয়েন্দা বাহিনী বা অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি এটাকে খুব সিরিয়াসলি নিয়েছিল? যদি নিত এত তাজা প্রাণ ঝরত না। আইন ও সালিশ কেন্দে র সূত্রমতে, এ বছর জানুয়ারি-জুন ৬ মাসে গণপিটুনিতে প্রাণ গেছে ৩৬ জনের। বিশ্বাস হয় এত প্রাণ এভাবে ঝরে গেছে আমরা কিছুই করতে পারিনি। করব কীভাবে, আমরাও ব্যস্ত অথবা নিজের কেউ আক্রান্ত হচ্ছে না বলে দায়সারা স্ট্যাটাস দিয়ে উটপাখির জীবনে ফিরে যাচ্ছি। কতদিন বাঁচব এভাবে, কতদিন এভাবে আড়াল করতে পারব নিজেকে বা নিজের প্রিয়জনদের কে? আমার মনে হয় খুব বেশি দিন না।
একবার বাড্ডার তাসলিমার জায়গায় নিজেকে রেখে ভেবেছেন? লাঠি, রডের বাড়ি, লাথি, ঘুষি দিয়ে একজন উচ্চশিক্ষিত সংগ্রামী মা যে তার ছোট্ট মেয়েটার জন্য স্কুল দেখতে গিয়েছিল, তাকে আমরা মেরে ফেললাম। শত শত মানুষের মধ্যে একজন মানুষও কি ছিল না যে তাকে আগলে পুলিশ বা নিরাপদ কোনো জায়গায় নিয়ে যেতে পারত। তাসলিমার মাথায় মুখে যখন আঘাতের পর আঘাত করা হয়েছে নিরপরাধ মানুষটার নিশ্চয়ই বার বার তার ছোট্ট মেয়েটার কথা মনে হয়েছে। ভিডিওটা যতবার আমার সামনে এসেছে আমি এড়িয়ে গেছি, আর অভিশাপ দিয়েছি নিজেকে, মানুষ হিসেবে অসহায় তাসলিমার জন্য কিছু করতে না পারার জন্য। কিছুদিন আগে মিয়ানমার সংঘাত নিয়ে জাতিসংঘের তদন্ত রিপোর্টে একটা মজার বিষয় উল্লেখ করা হয়েছিল আর সেটা হচ্ছে, যে সব দেশে ইন্টারনেট বলতে অধিকাংশ মানুষ ফেসবুককে বোঝে, সেসব দেশের উচিত ইন্টারনেটের ব্যবহারকে সীমিত করা।
আমার মনে হয়, আমাদের অবস্থা কোনো অংশে মিয়ানমারের থেকে কম নয়। কোথায় মানুষ এখন ইন্টারনেটকে বেসিক হিউম্যান রাইটস হিসেবে ঘোষণা করছে আর আমরা অবাধে পাওয়া ইন্টারনেট দিয়ে গুজব ছড়িয়ে বেড়াচ্ছি। কেড়ে নিচ্ছি অন্যের মানবাধিকার। বাস্তবের ডিজিটাল দেশে এক মুহূর্ত ইন্টারনেট না থাকলে ঘটতে পারে ভয়াবহ বিপর্যয়। এই দিক দিয়ে এস্তোনিয়া উদাহরণ হিসেবে খুব ভালো দেশ, গুগল ক্রমে দেখে নিতে পারেন ছোট্ট একটা দেশ ইন্টারনেটের মাধ্যমে সেখানে কিনা করা যায়। তারা মনে করে, এক মুহূর্ত ইন্টারনেট না থাকা তার মানবাধিকারের লঙ্ঘন। আমরা, দেশ ডিজিটালাইজেশনে অনেক আগাতে পারি মানুষ হিসেবে পারিনি এটা নিশ্চিত।
একবার ভেবেছেন কি একটা সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। এই যে অফিসে বসে টাইপ করছি বার বার মনে হচ্ছে এখন তো দিনের বেলা এডিস মশা কামড়াচ্ছে না তো? পত্রিকা, টেলিভিশিন খুললেই খালি ভীতিকর খবর। ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কয়েক দিন আগে একজন সিভিল সার্জন মারা গেছেন ডেঙ্গুতে। এবার ডেঙ্গুর কি এক পরিবর্তিত রূপ স্বয়ং একজন ডাক্তার বুঝলেন না তার ডেঙ্গু হয়েছে। সারাক্ষণ কী এক দুশ্চিন্তা-বাসায় ছোট ছেলে বৃদ্ধ মা-বাবা সবাই ঝুঁকির মধ্যে। মেয়র মহোদয়রা ব্যস্ত সময় পার করছেন মশা মারার জন্য কিন্তু তাতে কী, আমরা তো বিপন্ন অসহায় বোধ থেকে মুক্তি পাচ্ছি না।
সোশ্যাল মিডিয়াতে গুজব সবার ভাইরাল হওয়ার নেশা। নেশা এতটাই প্রবল যে, অনেকে দুদিন আগে লাইভ করে মামলা করার বুকিং দেন যে মামলা করার এখতিয়ারই তার নেই। কী হাস্যকর? এই যে না জেনে আপনি বা আপনারা দেশদ্রোহিতার মামলা করে ভাইরাল হতে চাইলেন, আপনারদের তো কিছু হয় নাই কিন্তু এই নিয়ে বাজারে নতুন গুজব কিন্তু চলে এসেছে, অমুকের ইচ্ছায়, অমুক দেশের চাপে মামলা হয় নাই, আপনি দেশের ক্ষতি করলেন না উপকার করলেন?
মামলা হোক বা না হোক প্রিয়া সাহার মতো সাম্প্রদায়িক কুচক্রীদের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই। আর প্রিয়ার দোষে সব সনাতন ধর্মবিশ্বাসীকে দুষলে হবে না।
এই বাংলাদেশ সবার, সবার সমান অধিকার এখানে নিশ্চিত হতে হবে। কতটা বিপন্ন অসহায় আমরা! চোখের সামনে ঘটে যাওয়া স্বামীর নৃশংস খুনের পরও সেই নারীকে আইনজীবীহীন করে মামলায় ফাঁসানোর সব ব্যবস্থা করে ফেলছি। সে খুনে জড়িত কিনা জড়িত সে আলোচনায় আমি যাব না কিন্তু মামলায় আইনজীবী পাওয়া যে তার সাংবিধানিক অধিকার, মৌলিক অধিকার এবং সেটা যে একটা সংঘবদ্ধ চক্র কেড়ে নিচ্ছে তার জন্য এই দেশ, সমাজ, রাষ্ট্র কী করতে পেরেছে? মিন্নি চরিত্র হননই যেন আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। একবার মিন্নির জায়গায় নিজেকে নিয়ে ভাবুন কতটা অসহায় বিপন্ন সে। চোখের সামনে খুন হওয়া স্বামীর হত্যার দায়ে তাকে দায়ী করা হচ্ছে, যেখানে তাকে কোনো আইনগত প্রতিনিধি দেয়া হচ্ছে না পেশির জোরে।
অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বাংলাদেশ আজ অনেক বেশি বিপন্ন। কারণ এই বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়াতে চায়, সাম্প্রদায়িকতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাতে চায়। পরাজিত শক্তিরা কি ছেড়ে দেবে? অবশ্যই না। তারা গাড়িতে, বাসে পেট্রলবোমা মেরে মাসের পর মাস মানুষ মেরেছে, হঠাৎ করে সব উঁচু বিল্ডিংয়ে আগুন লাগিয়ে মানুষ মেরেছে আর এখন পদ্মা সেতু গুজব তুলে মানুষ মারছে। শুধু সরকারের একার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয় যতদিন আপনি আমি না এগিয়ে আসব, মোবাইল দিয়ে ছবি না তুলে একজন বিপন্ন মানুষের জীবন বাঁচাব। দায়সারা লোক দেখানো কাজ না করে সত্যিকারের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলব। আর সরকারের উচিত-বড় ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা নেয়া এবং গুরুত্ব দেয়া। – লেখক: সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা / ৩১ জুলাই ২০১৯/ এমএম