Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক ::‌  বাচ্চাটা রোজ কাঁদতে কাঁদতে স্কুলে যায় মায়ের সঙ্গে। দেখে নানা কথা ভাবি। কখনো মনে হয়, হয়তো স্কুল ভালো লাগে না তার। কখনো মনে হয়, হয়তো সকালে ঘুম ভাঙে না। আরেকটু ঘুমোতে চায়। হয়তো কখনো শরীরও খারাপ লাগতে পারে। ভালো করে হয়তো বলতেও পারে না। বললেও মা মনে করেন, সবটাই স্কুলে না যাওয়ার উছিলা। ওইটুকু ৪+ বয়সের বাচ্চার একটাই প্রতিবাদের ভাষা-কান্না। আর তার একটাই মানে-কাজটা তার পছন্দ নয়।

বিদেশে দেখেছি, স্কুলে যাওয়ার জন্য বাচ্চারা উদগ্রীব থাকে। স্কুল মানে কিন্ডারগার্টেনের কথা বলছি। ৩/৪+ থেকে শুরু হয় ওদের স্কুলিং। কী শেখে ওরা এইটুকু বয়সে? কী শেখানো উচিত? কেমন করে শেখানো উচিত? পুঁথি-পুস্তকের সাহায্যে, না খেলাধুলার মাধ্যমে? নাকি আঁকিবুঁকির মাধ্যমে? নাকি আকর্ষণীয় ও অর্থবহ রূপকথার গল্প বলার মাধ্যমে? আমরা তো সেটাই জানি না। আমরা জানি শিশুশিক্ষার নামে ওদের ঘাড়ে বিচিত্র বই চাপিয়ে প্রতিদিনের বিকাশমান জগৎকে জোরজবরদস্তির মাধ্যমে বিস্বাদ করে তুলতে। জানি ওদের বিমল শৈশবকে মূঢ়তার সঙ্গে অকাতরে তেতো করে দিতে। দেখেশুনেই বলছি।

কিছুকাল এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তখন দেখেছি, নার্সারি ক্লাসের ৩/৪ বছরের বাচ্চাদের রীতিমতো টেবিলে বসিয়ে মুখে মুখে ‘এ বি সি ডি’ পড়ানো হচ্ছে। ওরা এ বি সি ডি-র ছড়া মুখস্থ করছে সুর করে করে। তারপর শুরু হয় অক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে ফল, বল, পশুপ্রাণীর নাম শেখা ও চেনা। পাশাপাশি আছে ইংরেজি-বাংলা সংখ্যা গণনা শেখা এবং রাইম্স শেখা।

বছরের শেষদিকে একটু একটু অক্ষর লেখাও শুরু করা হয়। কচি কচি হাতে পেন্সিল ধরার কায়দা দেখলে মায়া লাগত। ঘণ্টা দুই তাদের ক্লাস। এ দুই ঘণ্টার মধ্যে তাদের উঠতে দেওয়া হয় না টেবিল থেকে। সেই যে বাড়ি থেকে এসে বসে, তারপর আঠার মতো লাগিয়ে রাখা হয় স্কুল বেঞ্চের সঙ্গে। টিচার ওদের নিয়ে টেবিলে গোল হয়ে বসেন কুঁচে মুরগির মতো।

অসহ্য মনে হতো আমার। একদিনের ঘটনা, একটা ফুটফুটে বাচ্চা মায়ের সঙ্গে স্কুলে এসে কিছুতেই মায়ের আঁচল ছাড়ে না। থাকবে না সে স্কুলে। ক্লাসে তো বসবেই না। মায়ের সঙ্গেই ফিরে যাবে বলে বায়না ধরে। মা যতই আঁচল ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন, ততই সে বাঁকা হয়ে মায়ের পেছনে লুকায়। প্রথম দিন বাচ্চাটা ফিরেই গেল। পরের দিনও। তৃতীয় দিনে অবশেষে ক্লাস টিচারকে ডেকে তার হাতে কান্নাতুর বাচ্চাটাকে দিয়ে চলে যান মা। বাচ্চাটা কাঁদতেই থাকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। আমি দেখলাম।

একদিন আমি তাকে মায়ের কাছ থেকে নিয়ে এলাম আমার ঘরে। স্কুলের আয়ারা হাঁ হাঁ করে উঠল। টিচার এলেন। সবাই বাচ্চাটাকে নিয়ে যেতে চায় ক্লাসে। কারও সঙ্গেই যাবে না সে। দিব্যি আমার ঘর, মানে প্রিন্সিপালের ঘরে গিয়ে বসল আমার চেয়ারেই। আয়াদের-টিচারদের চক্ষু ছানাবড়া। মনে হলো যেন দুনিয়া উলটে গেল। বারবার ওকে নিয়ে যেতে চাইল। বাচ্চাটা সেঁটে রইল আমার সঙ্গে। আমি বললাম, তোমরা সবাই যাও। আমার কাছেই থাক বাচ্চাটা।

দুটি ঘণ্টা বাচ্চাটা আমার চেয়ারে শেয়ার করে বসে থাকল। টেবিলের কলম নিয়ে আঁকিবুঁকি করল। কাগজ দিলাম একখণ্ড। আমার ইরেজার দিয়ে কী সব মোছামুছি করে। পানি খেতে চাইল। মা টিফিন দিয়েছিল। সেটা খাবে না। আমাকে দুটি বিস্কুট আর চা দিয়েছিল আয়া, সেটাই তার পছন্দ। বিস্কুট খেয়ে সে আবার ছবি আঁকায় মন দিল। আমি ক্লাস পরিদর্শনে গেলে আমার হাত ধরে সঙ্গে চলল। কিন্তু নিজের ক্লাসে সে বসবে না কিছুতেই।

সপ্তাহ পার হয়ে যায়। ওর অবস্থান নড়ে না। মা এসে স্কুলে পৌঁছে দেওয়ামাত্রই দৌড়ে গিয়ে সে আমার চেয়ারে বসে যেত। কয়েকদিন বাদে অ্যাসেম্বলিতে নিলাম হাত ধরে। তবে লাইনে দাঁড়াবে না সে। আমার হাত ধরেই থাকবে। একটু চিন্তিত হলাম। জানতে চাইলাম কেন ক্লাসে বসবে না। কিছু বলতে পারে না। ওর একটাই আবদার-প্রিন্সিপাল মিসের কাছেই সে বসবে।

অনেক গল্প শুনিয়ে, ছড়াগান শুনিয়ে, তার সঙ্গে ক্লাসে বসে অবশেষে তাকে ক্লাসে বসাতে পেরেছিলাম। আদর করে আমি সব বাচ্চাকে দাদু বলি। সেও আমাকে ‘দাদু’ বলত। আয়ারা ওকে ময়না পড়াত আমাকে ‘মিস’ বলার জন্য। কিন্তু সে আমাকে ‘দাদু’ই বলবে। কথা বলে বলে জানলাম, সকালে ঘুম থেকে উঠেই ওর খেতে ইচ্ছা করে না। আর মা তাকে স্কুলে আসার আগে খাওয়াবেনই। সে কারণে স্কুলে না এলেই তার ভালো। স্কুলে আসায় অনীহার একটা কারণ তাহলে পাওয়া গেল। শুনেছি, এমন অনেক বাচ্চা আছে, যাদের মর্নিং সিকনেস থাকে। কিন্তু অনেক মা-বাবা সেটা বুঝতেই চান না।

বোঝালাম, না খেলে বড় হওয়া যায় না। ঘোড়ায় চড়া যায় না। শিশু পার্কে গেলে মাথা ঘুরবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। মাকে বোঝালাম, ওর টিফিন দিয়ে দেবেন, আমরা স্কুলে খাওয়াব। প্রথমে রাজি হননি মা। পরে মেনে নিলেন। স্কুলে আসার ঘণ্টাখানেক পরে অন্য বাচ্চারা যখন ক্লাসে বসেই টিফিন খেত, তখন সে-ও স্বাভাবিকভাবে সবার সঙ্গে টিফিন খেত। ক্রমে সবই ঠিক হয়ে গেল। মানে বাচ্চাটার দরকার ছিল পরিস্থিতির সঙ্গে আরেকটু বোঝাপড়া। শুধু মা-বাবাই সেটা পারেন। হয়তো মা বাইরে কাজ করেন। বাচ্চাটা স্কুলে গেলে তিনি ঘণ্টা কয়েকের জন্য ফ্রি থাকেন। সেই আরামটুকুর জন্য বাচ্চাটাকে স্কুলে পাঠানো।

আমাদের কালে ৬/৭+ হলে স্কুলে দেওয়া হতো। এর আগে বাড়িতেই বাংলা অক্ষর চেনা ও লেখা, ছড়া শেখা ও বলা, সংখ্যা গোনা ও দশ পর্যন্ত লেখা, আঁকিবুঁকি করা হয়ে যেত। জোরাজুরি করে নয়, খেলাধুলার ফাঁকে ফাঁকে শেখা চলত। ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিবারে আরবি পড়ায় হাতেখড়ি হতো স্কুলে যাওয়ার আগেই। তবু পরিবারের ফুরফুরে আবহে শিশুটির প্রাণ তাজা থাকত। স্কুলে সেটা হয় কি একটা বাচ্চার? দিতে পারি আমরা তেমন আবহ স্কুলে?

আমাদের শৈশব কেটেছে মফস্বল শহরে। হয়তো অপু ও দুর্গার মতো ছিল না আমাদের শিশুকাল। বুনো গাছপালার ঝোপঝাড়ে, কাশফুলের অলিগলিতে বা তালপুকুরে শাপলা তুলে খেলার সুযোগ ছিল না। কিন্তু ঘাস-পাতা, ফুলের পাপড়ি আর লতা কুঁড়ি দিয়ে পুতুল সংসারের রান্নাবান্না খেলা ছিল বেশুমার। ছেলেরা ফুটবল নিয়ে সারাদিন ছোটাছুটি করত। বল না পেলে লেবু, পিঠালু বা নিদেনপক্ষে কাপড়ের বল বানিয়ে খেলত। সরগরম করে রাখত বাড়ি।

আমি বলছি সাধারণ মধ্যবিত্তের সংসারের কথা, একটা বাড়িতে যেখানে ৫/৭/৮ জন ছেলেমেয়ে লেখাপড়া শিখত। শিক্ষা উপকরণ কী ছিল আজ তা মনেও নেই। আর বিশেষ খাওয়া, মানে গুনে গুনে পুষ্টিকর খাদ্য খাওয়াই বা কী ছিল? মনে পড়ে না। কিন্তু আদর-স্নেহ-ভালোবাসা ছিল অফুরান। তাতেই শিশুদের প্রাণ তাজা থাকত। লেখাপড়াতেও ভালো হতো তারা। ব্যতিক্রম তো থাকেই।

এখন প্রায় পাড়ায় পাড়ায়, কখনো বসতবাড়ির একটা ঘরে কিন্ডারগার্টেন হয়েছে। মায়েরা দিন গোনেন কখন শিশুটির তিন বছর পূর্ণ হবে। তারপর কোনো একটা শিশুকাননে তাকে ভর্তি করে দেবেন। কোথায় ঘাস-লতা-পাতা-ফুলের পাপড়ি বা কাপড়ের সাদামাটা পুতুল? মা-বিহীন অপরিচিত একটা পরিবেশে শুরু হয় কয়েক ঘণ্টার জন্য শিশুটির শিক্ষাজীবন। তার ভালো লাগা, না লাগার কোনো কথা নেই। তাকে সেখানেই থাকতে হবে কয়েক ঘণ্টা। কী শেখাই তাদের আমরা?

আমরা প্রাথমিকে ইশপের গল্প পড়েছি। সেগুলোর মোরাল নিয়ে আলোচনা করেছেন শিক্ষকরা। ক্লাস শেষে চেয়ার-বেঞ্চ সোজা সোজা করে রাখা শেখাতেন। বোর্ড মোছা শেখাতেন। ছুটির সময় লাইন করে একে একে বের হতে শেখাতেন। অ্যাসেম্বলিতে যেতে শেখাতেন। তারপর পিটি, মানে শরীরচর্চা ৫-৭ মিনিট। অবশ্য তখন শিশুরা ৬+ বছরের। এখনকার ৩/৪+ বাচ্চা এ পিটি করবে কীভাবে? ওরা এতই ছোটো, টলে টলে স্কুলে যে আসে, তাতেই মা-বাবা ও শিক্ষক খুশি। বাণিজ্যের কথা এখানে নাই বলি।

ফেবু-তে দেখি শিশুশিক্ষা নিয়ে মাঝেমধ্যে কথা হয়। আমার বক্তব্য হলো, শিশুদের আগে শৈশবটা দিতে হবে। এখন তো প্রায় সবারই একটি বা দুটি করে বাচ্চা। সব মা-ই যে চাকরি করেন তা-ও নয়। কিন্তু সবাই চান বাচ্চাকে কিন্ডারগার্টেনে দিতে। কিছুটা ফ্যাশনের মতো। এ চাহিদা থেকেই শিশুকাননের ছড়াছড়ি। বাস্তবতা যদি এ-ই হয়, তাহলে শিশুশিক্ষা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করতে হবে আমাদের। বিকল্প নেই কিছু।

ড. বেগম জাহান আরা : অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ /এমএম