Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক ::‌ সন্তান জন্মের পরই পিতা-মাতার মাথায় নানা স্বপ্ন আকুলি-বিকুলি করতে থাকে। মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রত্যেক পিতা-মাতা বিশেষ একটি বিষয়ের ওপর বেশি চিন্তিত থাকেন- আর তা হলো সন্তানের ভবিষ্যৎ। তাদের সন্তান ভালো স্কুলে পড়বে; ভালো বিদ্যালয় থেকে ভালো ডিগ্রি নিয়ে তাদের মুখ উজ্জ্বল করবে- এমন স্বপ্ন লালন করতে থাকেন সন্তান জন্মের পর থেকেই।

এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে চিন্তার অন্ত থাকে না বাবা-মায়ের। আর সন্তানের প্রি-স্কুল থেকেই শুরু হয় যুদ্ধ। ভালো স্কুলে ভর্তির যুদ্ধ; লেখাপড়ার জন্য ভালো মাস্টার খোঁজের যুদ্ধ। আর যুদ্ধক্ষেত্রের ক্রীড়নক হলো তাদের সন্তান। শহর ও গ্রামের মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা-মায়ের মধ্যে চিন্তা-চেতনার কিছুটা তফাত থাকলেও উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্য সবার একটাই। উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও ধনিক শ্রেণির পিতা-মাতা এত চিন্তিত না হলেও সন্তানের ভবিষ্যতের স্বপ্ন তারাও দেখেন।

এদিকে স্কুল-কলেজ শেষ। বাবা-মায়ের যুদ্ধের বিজয়ী সৈনিকরা যেন কিছুটা হাফ ছেড়ে বাঁচে। কিন্তু আসলেই কি যুদ্ধ শেষ? না, বরং চূড়ান্ত যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে তারা। এবার ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন দেখেন অভিভাবকরা; আর যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন সন্তানরা। অনেকেই ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেলেনও। কিন্তু তারপর…।

তারপর স্বপ্নজয়ী বাবা-মায়ের মনে জন্মাতে থাকে ভয়; সন্তানের নিরাপত্তার ভয়। যারা একদিন সন্তানদের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর স্বপ্ন দেখতেন তারাই এখন ভয়ে কুঁকড়ে থাকেন। সন্তানের ভবিষ্যত নয়, সন্তানের নিরাপত্তার ভয়! তাদের মনে সব সময় একটা প্রশ্নই জাগতে থাকে- ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সন্তানরা নিরাপদ তো?’ এই প্রশ্নটা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সব সন্তানদের বাবা-মায়ের।

বর্তমান সময়ে এ প্রশ্ন জন্মানোটা স্বাভাবিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় র‌্যাগিং। এই শুরু র‌্যাগিং মাঝে মাঝে মারাত্মক ভয়াবহ হয়ে ওঠে। আনন্দের আতিশয্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘোর অমানিশা নেমে আসে কথিত ‘বড় ভাই’দের পরিচিতি পর্বে অর্থাৎ র‌্যাগিংয়ের মাধ্যমে। এই র‌্যাগিং যে কত ভয়াবহ- তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বলতে পারবে না। উচ্চশিক্ষার জীবনে প্রথম পদক্ষেপেই মন ভেঙে যায় তাদের। আর এই ভাঙা মন নিয়েই চলতে হয় সারা জীবন।

শুধু র‌্যাগিং নয়; হোস্টেলে থাকতে হলে সিট-বাণিজ্যের চাঁদাবাজি, ছাত্র রাজনীতির দলন-পীড়ন, পদে পদে কথিত ‘বড় ভাই’দের চোখ রাঙানিতে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন তারা; কিন্তু কিছুই করার থাকে না। নিজের মধ্যে সব কষ্ট জমা করে রাখে তারা। বাবা-মা চিন্তা করবে ভেবে তাদের কিছুই জানান না; বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ভালো গল্পগুলো অবারিত হলেও র‌্যাগিং নামক যন্ত্রণা, চাঁদাবাজি মনের ঘরে অর্গল লাগানোই থাকে।

র‌্যাগিং সব সময় খারাপ না। ভালো উদ্দেশ্য নিয়েই শুরু হয়েছিল র‌্যাগ দেওয়া। এক কথায় র‌্যাগিং (Ragging) অর্থ পরিচিত হওয়া বা পরিচয় পর্ব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুরাতন শিক্ষার্থীদের একটা সখ্যতা গড়ে তোলার জন্য যে পরিচিতি প্রথা সেটাকে র‌্যাগিং বলে অভিহিত করা হয়। এতে সবার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো হয়। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে র‌্যাগিংয়ে অপব্যবহারে এটি এখন ভীতিকর অবস্থানে পৌঁছে গেছে।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ছাত্ররা নতুন ছাত্রদের কাছে নিজেদের বড়াই করার জন্য অত্যন্ত অবমাননাকর আচরণ করে, অশ্লীল কাজ এবং অশালীন পদ্ধতির প্রদর্শন করতে বলে। তাদের কথা মতো না চললে এটি কখনো কখনো ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। নতুন ছাত্ররা মানসিক বা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। আর এর প্রভাব পড়ে শিক্ষাজীবনে। অনেকে হতাশ হয়ে পড়েন। আবার অনেক সময় এমন কিছু ঘটে যা সারাজীবন মানসিক অস্থিরতায় ভুগতে হয়। এই র‌্যাগিংয়ের কারণে ভারতের এক মেডিকেল কলেজছাত্রী আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্র রাজনীতি, সিট বাণিজ্য, চাঁদাবাজি তো আছেই। ছাত্র রাজনীতির কারণে বাংলাদেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে জীবন দিতে হয়েছে। সারা রাত নির্যাতনের পর পিটিয়ে হত্যা করা হয় তাকে। এছাড়া প্রতিনিয়তই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রদের নির্যাতনের কথা শোনা যায়। মাঝে মাঝে এমন ঘটনা ঘটে, যা শুনলে ভয়ে শিউরে উঠতে হয়।

সম্প্রতি দেশের একটি নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষার্থীর কাছে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। চাঁদা দিতে দেরি করায় ফোন দিয়ে হলের কক্ষে ডেকে নিয়ে লোহার রড এবং স্ট্যাম্প দিয়ে ৩ ঘণ্টা ধরে পেটান ছাত্র রাজনীতির নেতারা। এছাড়া ওই ছাত্রের কাছ থেকে জোরপূর্বক কেড়ে নেওয়া হয় ২০ হাজার টাকা। আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক প্রোগ্রামে না যাওয়াকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থী ও সাংবাদিককে মারধরের হুমকির পর হলের সিট থেকে বিছানা ফেলে দেওয়া হয়। এমনকি থাপ্পড় দিয়ে কান ফাটাতে চান নেতারা। এমন হাজারও উদাহরণ আছে।

দেশের নামকরা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন ঘটনা প্রতিনিয়তই আমাদের সামনে আসছে। এতে সাধারণ মানুষও বিচলিত হয়ে পড়েন। আর যাদের সন্তানরা সেখানে পড়াশোনা করেন, তাদের মনের ওপর কত প্রভাব পড়ে সেটা অবশ্যই অনুমেয়। আর স্বাভাবিকভাবেই তাদের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে- ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সন্তানরা নিরাপদ তো!?’

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ২৭ আগস্ট ২০২২ /এমএম