বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজে শিশুদের মাথা লাগবে- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানাভাবে এমন গুজব ছড়িয়ে দিচ্ছে সংঘবদ্ধ চক্র। এ কারণে দেশজুড়ে ‘ছেলেধরা’ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। এ গুজবে দুই সপ্তাহ ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘ছেলেধরা’ ভেবে অপরিচিত কাউকে দেখলেই নৃশংস ও অমানুষিকভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত অন্তত ১০ জন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। কারা এমন গুজব ছড়িয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করছে, তাদের শনাক্তে মাঠে নেমেছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। একই সঙ্গে গণপিটুনির শিকারের প্রত্যেকটি ঘটনা আমলে নিয়ে তদন্তে নেমেছে পুলিশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মব সাইকোলজি, সামাজিক সচেতনতা ও শিক্ষার অভাব, বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জোরাল তৎপরতার অভাবে সমাজে এমন মর্মান্তিক ও জঘন্য ঘটনা ঘটতে পারে।
গুজবের বিষয়ে শনিবার পুলিশ সদরদফতর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে’ বলে একটি গুজব ছড়ানোকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মর্মান্তিকভাবে কয়েকজনের প্রাণহানি ঘটেছে। গুজব ছড়িয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা রাষ্ট্রবিরোধী কাজের শামিল ও গণপিটুনি দিয়ে নিরীহ মানুষকে হত্যা করা ফৌজদারি অপরাধ। নিজেরা আইন হাতে তুলে না নিয়ে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্ট থানায় হস্তান্তরের অনুরোধ জানানো হয়।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, শনিবার একদিনে ঢাকার বাড্ডায়, নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, গাজীপুর ও মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে নারীসহ পাঁচ ব্যক্তিকে ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর আগে ঢাকার মোহাম্মদপুরসহ আরো কয়েক জায়গায় একই ঘটনা ঘটেছে। সবশেষ রোববার সকালে নওগাঁর মান্দা উপজেলায় বুড়িদহ গ্রামে ছেলেধরা সন্দেহে ছয় ব্যক্তিকে গণপিটুনি দেয়া হয়। পরে পুলিশ ওই ছয় ব্যক্তিকে উদ্ধার করে থানা হেফাজতে নেয়। মান্দা থানার ওসি মোজাফফর হোসেন বলেন, পুকুরে মাছ ধরা নিয়ে দ্ব›েদ্বর জেরে গ্রামবাসী ‘ছেলেধরা’ গুজব রটিয়ে ছয় ব্যক্তিকে মারধর করেছেন। গত দুই সপ্তাহে সারাদেশে ২১টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। র্যাব সদরদফতরের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমরানুল হাসান বলেন, গুজব প্রতিরোধে র্যাব সব সময় তৎপর রয়েছে। মাথা কাটা গুজব প্রতিরোধেও কাজ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১২ জনকে আটক করেছে র্যাব। পুলিশের হাতেও আটক হয়েছে কয়েকজন। গুজব রটনাকারীদের গ্রেফতারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে র্যাব।
তিনি বলেন, যারা আটক হয়েছে তারা ফেসবুকে পেয়ে শেয়ার করেছে বলে জানিয়েছে। তবে এর পেছনে মূল হোতাদের গ্রেফতারের চেষ্টা করছি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছেলেধরা গুজবে সবচেয়ে বেশি বিপদের মধ্যে রয়েছে মানসিক প্রতিবন্ধী, পাগল, ভবঘুরে ও নারীরা। মানসিক প্রতিবন্ধী দেখলেই ছেলেধরা সন্দেহে গণধোলাই দেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় ছিন্নমূল, বাস্তুহারা, পাগল প্রকৃতির মানুষ দেখলেই তাদের ওপর চড়াও হয়ে ব্যাপক মারধর শুরু করছে স্থানীয় লোকজন। মানসিক প্রতিবন্ধী ও নারীরা আতঙ্কে নিজের পরিচয় সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারছে না। ফলে তারা ছেলেধরা সন্দেহে সবচেয়ে বেশি গণপিটুনিতে হত্যা ও মারধরের শিকার হচ্ছে। বিভ্রান্তিতে পড়ে অতি উৎসাহী মানুষ এ ধরনের অপরাধী জড়িয়ে পড়ছে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, যে কোনো উন্নয়নকে কেন্দ্র করে মানুষের রক্ত লাগে, শিশুদের মাথা লাগে’ এ ভ্রান্ত ধারণা মানুষের মনে যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে। উত্তরণের ব্যাপারে তিনি বলেন, পুলিশের পাশাপাশি এলাকার নির্বাচিত ও অনির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে একটি কমিটি হতে পারে। এলাকায় সন্দেহভাজন কাউকে দেখলে পুলিশ কিংবা জনপ্রতিনিধিদের কাছে সোপর্দ করতে পারে। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য বলছে, এমন গুজবের আতঙ্কে সন্তানদের স্কুলে পাঠানোও বন্ধ করে দিয়েছে কেউ কেউ। তবে তারা কেউ ছেলেধরা কিংবা গলা কাটার ঘটনা দেখেনি, একে অন্যের কাছে শুনেছে বলে জানিয়েছেন। এ গুজবেই ছেলেধরা সন্দেহে প্রায় প্রতিদিন এক বা একাধিক মানুষকে পিটিয়ে মারা হচ্ছে। নিছক গুজবের ওপর ভর করে নিরীহ সাধারণ মানুষ হত্যাকাণ্ড কিংবা মারপিটের শিকার হচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে কোনো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে না।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) সোহেল রানা বলেন, ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হয়ে এ পর্যন্ত যত নিহতের ঘটনা ঘটেছে পুলিশ প্রত্যেকটি ঘটনা আমলে নিয়ে তদন্তে নেমেছে। এসব ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। গুজবে বিভ্রান্ত হয়ে ছেলেধরা সন্দেহে কাউকে গণপিটুনি দিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানানো হচ্ছে। গুজব ছড়ানো এবং গুজবে কান দেয়া থেকে বিরত থাকুন। কাউকে ছেলেধরা সন্দেহ হলে গণপিটুনি না দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিন।
যে কারণে গণপিটুনিতে হতাহতের ঘটনাগুলো ঘটছে: মনোরোগবিদ ডা. মেহতাব খানম এই গণপিটুনির মানসিক প্রবণতাকে মব সাইকোলজি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার মতে, যখন একটি সমাজে নির্দিষ্ট কোনো বিষয় নিয়ে আতঙ্ক বা নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয় তখন তারা এক ধরনের মানসিক অবসাদে ভোগে। সেই থেকেই মানুষের মধ্যে এ ধরনের সহিংসতা দেখা দেয়। তিনি বলেন, মব সাইকোলজির বৈশিষ্ট্য হলো- নিছক সন্দেহবশত যারা গণপিটুনি দেয়, তাদের উচিত-অনুচিত বোঝার মতো বিবেক কাজ করে না। কেউ সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা করে না। তারা জানতেও চায় না কী কারণে মারামারি হচ্ছে। তারা তাৎক্ষণিক সেখানে অংশ নিয়ে তাদের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। অপরদিকে অপরাধ বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে এই গণপিটুনির পরিস্থিতিকে তিনটি উপাদানে ব্যাখ্যা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের শিক্ষক খন্দকার ফারহানা রহমান। তিনি বলেন, ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমের পুলিশ, আদালত ও কারাগার এই তিনটি উপাদান সমাজে অনুপস্থিতিকে এমন সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। এর পেছনে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য, মানসিক অস্থিরতা এবং মাদকাসক্তিসহ নানা কারণ জড়িত বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বর্তমানে ছেলেধরার যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে এবং এর জেরে একের পর এক গণপিটুনির ঘটনাকে উদ্বেগজনক বলে আখ্যা দিয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল হুদা। তিনি বলেন, আতঙ্ক তৈরি হলে আইনের দ্বারস্থ হতে পারে। কিন্তু শুধু সন্দেহের বশবর্তী হয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিজেদের হাতে তুলে নেয়া কোনো সময় সমর্থনযোগ্য নয়। সাবেক পুলিশপ্রধান বলেন, এমন অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরো তৎপর হয়ে কাজ করতে হবে। পুলিশ বাহিনীর কাজ হবে, এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে, এলাকা ভিত্তিতে তৎপর হয়ে কাজ করা, খোঁজখবর রাখা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া। পাশাপাশি এজন্য গোয়েন্দা ইউনিটের আরো সক্রিয় হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা / ২২ জুলাই ২০১৯/ এমএম





