Menu

এরশাদকে ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস অসম্পূর্ণ থাকবে

বাংলানিউজসিএ ডেস্ক ::  ভালো মন্দ, ভুলত্রুটি মিশিয়েই মানুষ। ইহলোক ত্যাগ করা সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও এর ব্যতিক্রম নন। ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক বিষয়ে ছিল তার হাজারো সীমাবদ্ধতা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার আলোচিত-সমালোচিত অবস্থার বিশ্লেষণ ভবিষ্যৎ অবশ্যই বলবে। ঘনিষ্ঠজনেরা তাকে একজন ‘আপাদমস্তক ভদ্রলোক, সজ্জন ও অমায়িক হিসেবে জানেন।

চরম বিরুদ্ধ মত ও সমালোচনা সহ্যের ক্ষমতা তার অন্যসব দুর্বলতাকে চাপা দিতে সক্ষম। ভালো দিকগুলোর কথা উল্লেখ না করলে তার প্রতি অবিচার হবে। আবার মন্দ ও ভুলগুলোও নিশ্চয়ই উঠে আসবে ইতিহাসে। যে যেভাবেই ভাবুক, বিশ্লেষণ করুক কিন্তু এরশাদকে ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস অসম্পূর্ণ থাকবে।

একাদশ জাতীয় নির্বাচনের কিছুদিন আগ থেকে নানা অসুখে ভুগতে শুরু করেন এইচএম এরশাদ। ক্রমশই খারাপ হয়ে পড়ে শারীরিক অবস্থা। নির্বাচনের মাঠেও সেভাবে থাকতে পারেননি। ছিলেন অনেকটাই নিস্তব্ধ, একাকী। বাসভবন প্রেসিডেন্ট পার্ক আর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালই হয়ে ওঠে তার রুটিনওয়ার্ক। শারীরিক দুর্বলতার কারণে নেতাকর্মীদেরও তেমন একটা সাক্ষাৎ দিতেন না। প্রধান বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্ব পালনে সংসদে যাওয়ার সুযোগও হয়নি তেমন। সিএমএইচে দুই সপ্তাহের বেশি সময় চিকিৎসা শেষে রবিবার সকালে না ফেরার দেশ পাড়ি দেন সেনাপ্রধান থেকে রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া এবং রাজনীতিতে পল্লীবন্ধু খেতাবভূষিত এরশাদ।

তাকে কাছ থেকে দেখে শুরু থেকেই আমি অবাক হতাম। উৎসুক হতাম। ব্যক্তিগতভাবে তার স্নেহ পেয়েছি। তিনি কাঁধে হাত দিয়ে পরম স্বজনের মতো কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন। এমন হৃদয়বান রাজনীতিক বাংলাদেশে বিরল, এ কথা বলতেই হবে। হাজারো বিব্রতকর প্রশ্নে তিনি কখনো চটেছেন, বিরক্ত হয়েছেন-কোনো গণমাধ্যমকর্মী এমন অভিযাগ করতে পারবেন না। সবার সব প্রশ্নের উত্তর দিতেন শালীন ভাষায়। দলীয় বা রাজনৈতিক বিষয়েও তাকে কখনো রাগতে দেখিনি। রাজনীতি ও ব্যক্তিগত হাজারো সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এরশাদের এই গুণ অনেকের মাঝে নেই। বরং এরশাদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেছেন অনেকে। তবুও তিনি সেসব নিয়ে উচ্চবাচ্য করেননি।

এরশাদের রাজনীতি বাংলাদেশের রাজনীতির বাঁক বদলে দিয়েছে। ভাঙন ধরিয়েছে এ দেশের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে। বিএনপির ব্যর্থতার সুযোগেই তার ক্ষমতারোহণ। শুরুতে ওই বিএনপির আদর্শ সামনে রেখেই দাঁড় করান সমান্তরাল জাতীয়তাবাদী দল জাতীয় পার্টি। পররাষ্ট্রনীতি ও সামরিক বিষয়ে জেনারেল জিয়ার দিকনির্দেশনাই অনুসরণ করেছেন এরশাদ। তাকে বাংলাদেশের জন্য কল্যাণকর কূটনীতির স্রষ্টা বলেন অনেকে। রাষ্ট্র ক্ষমতা থাকাকালীন একসঙ্গে ইউরোপ-আমেরিকার পাশাপাশি মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গেও ছিল তার সুসম্পর্ক। দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ কৌশলগত মিত্র চীনকে আস্থায় রাখা। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত বন্ধন। এমন কূটনীতি তাকে ছাড়া আর কাউকে দিয়ে সম্ভব কি-না, ভাবাও যায় না।

তার চীন, পাকিস্তান, তুরস্ক, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েতের মতো দেশগুলোর সঙ্গে নিবিড় সামরিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্যারিশমা সামরিক বিশ্লেষকদের জন্য গবেষণার বিষয়। তার দৃঢ় অবস্থানের কারণেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে যাওয়ার সুযোগ হয়। এ নিয়ে তখন বিএনপি-আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলো কত যে সমালোচনা করেছে তার কিন্তু পরবর্তীতে তারা দেশ শাসন করতে এসে সেটাই ধরে রাখার চেষ্টাই করেছেন।

কোনো নতুন মাত্রা দিতে পারেননি। প্রণোদনা দিয়ে গার্মেন্ট শিল্পকে এগিয়ে নেয়ার কৃতিত্বও একমাত্র রাষ্ট্রপতি এরশাদেরই। অনেক সমালোচনা-নিন্দামূলক পর্যবেক্ষণ-বিশ্লেষণের মধ্যে তার কীর্তিকে স্মরণ করতেই হবে। দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থা-সার্ক গঠনে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়ার উদ্যোগকে সামনে এগিয়ে নিয়েছেন তিনিই। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্পের বিরাষ্ট্রীয়করণ এবং দেশে ব্যক্তি খাতের বিকাশে তার বিভিন্ন পদক্ষেপ যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ছিল। সরকারি মালিকানাধীন উত্তরা, পূবালী ও রূপালী ব্যাংক বিরাষ্ট্রীয়করণের বিপরীতে দেশে প্রথমবারের মতো কয়েকটি বেসরকারি বাণ্যিজ্যিক ব্যাংক ও বীমা কোম্পানির অনুমোদনও পায় এইচ এম এরশাদের সময়ে।

দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুনর্গঠন ও সংস্কারে মহকুমাগুলোকে জেলায় উন্নীত করার মাধ্যমে দেশে জেলার সংখ্যা ৬৪ করা তার আরেক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এগুলোর অধীনে আবার ন্যস্ত করা হয় ৪৬০টি উপজেলাকে। দেশের সর্ব প্রথম বিরতিহীন আন্তঃনগর ট্রেন চালু, শিশুদের নিয়ে পথকলি ও নতুন কুঁড়ি গঠন, ঘূর্ণি উপদ্রুত এলাকাকে প্রথম শেলটার বাড়ি হিসেবে তৈরি, গুচ্ছ গ্রাম, পুরনো বিমানবন্দরে প্যারেড স্কয়ার, তিস্তা বাঁধ তৈরি, ত্রিমোহনী সেতু, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, মুজিব নগরে স্বাধীনতা সৌধ, বাংলাদেশে প্রথম আইএসডি টেলিফোন, রাজশাহী বিমানবন্দর, রাজধানীর ওয়ারীতে সুইপারদের জন্য বহুতল ভবন, মতিঝিলে সেনা কল্যাণ ভবন, রাজশাহীর বরেন্দ্র গবেষণা কেন্দ্র, ফার্মগেটে খামারবাড়ি, গাজীপুরে ধান ও চাল গবেষণা ইনস্টিটিউট, বুড়িগঙ্গা, কাঞ্চন, হালদা, মেঘনা-গোমতী, কর্ণফুলী, রূপসা, দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা, টঙ্গী ব্রিজসহ অসংখ্য কীর্তি এইচ এম এরশাদেরই সৃষ্টি। এর বাইরে উত্তরবঙ্গসহ সারাদেশে সড়ক তৈরি, বায়তুল মোকাররম মসজিদের বর্তমান চেহারা, পাকিস্তানের ফেলে যাওয়ার পর সংসদ ভবনের কাজ শেষ করা, ঢাকা বিমানবন্দরে ভিভিআইপি টার্মিনাল, সুপ্রিমকোর্ট মাঠে ঈদের জামাত চালু, ওসমানী মিলনায়তন, যাত্রাবাড়ী, সায়দাবাদ, গাবতলী ও মহাখালী বাস টার্মিনাল, ঢাকায় এক ডজনেরও বেশি শিশু পার্ক তৈরি, সারাদেশে ২৭৭টি রেল স্টেশন আধুনিকায়ন, শিশু শ্রেণিতে বিনামূল্যে বই দেয়া তারই প্রবর্তন।

এইচ এম এরশাদের ব্যক্তিগত, পেশাগত ও রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বর্ণাঢ্য, ঈর্ষণীয়ভাবে বেড়ে ওঠা। কখনো পিছু হটেননি। শুধু এগিয়েছেন। তার জন্ম ১৯৩০ সালের ২০ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহারে। কুচবিহার ও নিজ শহর রংপুরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা। এরপর ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি। বায়ান্নতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে অফিসার পদে নিয়োগ। ১৯৬০-৬২ সালে তিনি অ্যাডজুট্যান্ট ছিলেন চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে। ৬৬-তে পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটায় স্টাফ কলেজে স্টাফ কোর্স শেষ করে ৬৮-তে শিয়ালকোটে ৫৪তম ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতির পর ১৯৬৯-৭০ সালে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে এবং ১৯৭১-৭২ সালে সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অধিনায়কের দায়িত্ব পান এইচ এম এরশাদ।

পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৭৩ সালে এইচ এম এরশাদকে করা হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল। ওই বছরের ১২ ডিসেম্বর কর্নেল পদে এবং ১৯৭৫ সালের জুনে হন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। একই বছর তিনি ভারত যান ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে প্রতিরক্ষা কোর্সে। ওই বছরের আগস্ট মাসে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে তাকে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান নিয়োগ করা হয়। ১৯৭৮ সালে হন সেনাপ্রধান। ১৯৭৯ সালে পান লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদোন্নতি।

১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক-সিএমএলএ হিসেবে এবং ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করে দেশ পরিচালনা করে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন। এইচ এম এরশাদের ক্ষমতা থেকে প্রস্থান রাজনীতির আরেক বাঁক বদল ছিল। তিনি ও তার দল ক্ষমতার বাইরে থাকলেও ক্ষমতাসীন দলগুলোর ক্ষমতার স্বার্থে বার বার ব্যবহৃত হয়েছে। যার অনিবার্য পরিণতি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এরশাদের রাজনৈতিক অবস্থানকে কেবল অস্পষ্ট-অপরিচ্ছন্ন করেছে। তার চিরবিদায় তার প্রতিষ্ঠিত দল জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎকে কোন বাঁকে নেয়, সেটা দেখার অপেক্ষা রাজনৈতিক মহলে।

বাংলানিউজসিএ/ঢাকা / ১৯ জুলাই ২০১৯/ এমএম