বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: ‘ও সকিনা গেসস কিনা ভুইল্লা আমারে। আমি অহন রিসকা চালাই, ঢাহা শহরে।’ শিল্পী ফকির আলমগীরের একটি তুমুল জনপ্রিয় গান। এই গানে উঠে এসেছে একজন প্রেমিকপুরুষের ঢাকা শহরে রিকশা চালানোর বিষয়টি। দীর্ঘ সময় পর এখন যদি কোনো শিল্পী এই গানটি নতুন করে গাইতে চান তবে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে গানের কথায়।
বিশেষ করে পুরো ঢাকা শহরে এখন কোনো রিকশাচালক ইচ্ছে করলে আর রিকশা চালাতে পারবেন না। ফলে নতুন করে কোনো শিল্পী রিমিক্স করে গাইতে চাইলে গানে নির্দিষ্ট করে কিছু জায়গার নাম উল্লেখ করতে হবে। রিকশা নিয়ে আরো একটি জনপ্রিয় গান রয়েছে আমাদের সংগীতাঙ্গনে। সঞ্জীব চৌধুরীর ‘রিকশা কেনো আস্তে চলে না’- প্রেমিকাকে রিকশায় এক পলক দেখা নিয়ে এই গান। রিকশা নিয়ে আরো গান রয়েছে। রয়েছে চলচ্চিত্রও। আমাদের গল্প, কবিতায়ও অসংখ্যবার উঠে এসেছে রিকশার বিষয়টি। কারণ ঢাকা শহরে প্রেমিক-প্রেমিকার প্রিয় যানবাহনটির নামও যে রিকশা!
রিকশা নিয়ে এত কথা বলার কারণটা নিশ্চয় এতক্ষণে পাঠকরা বুঝতে পেরেছেন। কারণ ‘রিকশা’ গত কয়েকদিন ধরে আমাদের কাছে আলোচিত বিষয়। আলোচিত হওয়ার কারণ, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে কুড়িল-রামপুরা-সায়েদাবাদ, গাবতলী-আসাদগেট-আজিমপুর ও সাইন্সল্যাব-শাহবাগ এ তিন প্রধান সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি জায়গা থেকে রিকশা চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আসায় রিকশাচালকরা ধর্মঘট করেছেন। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে অবরোধও করেছেন রিকশাচালকরা। রিকশাচালকদের এমন কর্মসূচিতে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন সাধারণ জনগণ। যদিও সরকারের আশ্বাসে এখন রিকশাচালকদের কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে।
একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক। গত দুই দশক ধরে ঢাকা শহর যেন যানজটের শহর। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই বিশেষ করে কিছু কিছু রাস্তায় রিকশার কারণে তীব্র যানজট তৈরি হয়। আর রিকশার কারণে একবার যানজট সৃষ্টি হলে দীর্ঘ সময় লাগে সেই যানজট শেষ হতে এবং গন্তব্যে পৌঁছাতে। তাই সিটি করপোরেশন প্রধান প্রধান সড়কে রিকশা বন্ধের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আপত দৃষ্টিতে এটা খুব ভালো উদ্যোগ। রিকশা বন্ধ হলে প্রধান সড়কগুলোতে যাতায়াতে অনেকটা স্বস্তি আসবে। এখন প্রশ্ন হলো-সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সেটা কতটা যৌক্তিক। এখানে দুই রকমের মতামত আসছে। অনেকে বলছেন, প্রধান সড়কে রিকশার প্রয়োজন আছে, কেউবা বলছেন প্রয়োজন নেই। বাস্তবতা হলো রিকশার বিকল্প নেই। তবে প্রশ্ন হলো সব রাস্তায় কি রিকশা চলবে নাকি নির্দিষ্ট কিছু রাস্তায় রিকশা চলাচল করবে? সিটি করপোরশেনের এমন সিদ্ধান্তের মূলে রয়েছে যানজট নিরসন। অতিরিক্ত রিকশার কারণে ঢাকার রাস্তায় যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তাই সিটি করপোরেশনের উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন উঠেছে-আগাম কোনো নোটিশ না দিয়ে, রিকশাচালকদের সঙ্গে কোনো প্রকার আলোচনা না করে এমন সিদ্ধান্ত নেয়ায়। তাই রিকশাচালকরা কর্মসূচি পালন করেছেন। যাতে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন সাধারণ জনগণ।
ঢাকার রাস্তায় অবশ্যই রিকশার প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে যাদের ব্যক্তিগত গাড়ি নেই তাদের অবশ্যই প্রয়োজন রিকশার। আবার যেসব রাস্তায় বাস চলাচল করতে পারে না সেসব রাস্তায়ও রিকশার প্রয়োজন। বিশেষ করে ছোট ছোট গলিতে রিকশার কোনো বিকল্প এখনো তৈরি হয়নি। বিশেষ করে রিকশাচালকরা মেইন সড়কগুলোতে রিকশা চালালে শৃঙ্খলা থাকে না। তিন লেনের রাস্তার দুই লেন থাকে রিকশার দখলে। এসব কারণে মূল সড়কগুলোতে যানজট সৃষ্টি হয়। রিকশাচালকরা তাদের ইচ্ছেমতো দাঁড়িয়ে যান, ডানে-বামে টার্ন নেন, ইচ্ছেমতো দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করান। এর ফলে একটা রিকশা সামনে থাকলে পেছনে থাকা সব গাড়ির গতি হয়ে যায় রিকশার সমান। জ্যামের ঢাকায় রিকশাগুলো এভাবে চলায় ভোগান্তির শিকার হচ্ছে কম-বেশি সবাই। তবে এটাও সত্যি, শুধু কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় রিকশা চলাচল বন্ধ করলেই যানজট কমে যাবে এটা ভাবাও সঠিক নয় বরং যানজট কমাতে হলে দীর্ঘ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে।
যানজট কমাতে শুধু রিকশা নয়, কিছু বড় গাড়ি চলাচলেও বিধি-নিষেধ আনতে হবে। আবার ছোট ছোট গলিতে প্রাইভেট কার চলাচলেও নিষেধাজ্ঞা দেয়া প্রয়োজন। কারণ প্রাইভেট কারের মালিকরা নিজেদের ইচ্ছেমতো যত্রতত্র গাড়ি ঢুকিয়ে যানজটের সৃষ্টি করেন। যেসব রাস্তায় পাশাপাশি রিকশা চলাচল করা কঠিন সেখানে গাড়ি প্রবেশ করে যানজটের সৃষ্টি করছে। আরো একটি তথ্য হলো-রিকশা ধীরগতির যান হওয়ার কারণে বিশ্বের যেসব দেশে রিকশা আছে সেসব দেশে মেইন সড়কে রিকশা চলাচল করে না। এমনকি আামাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের কলকাতা শহরের মেইন রাস্তায়ও রিকশা চলে না। শুধু আমাদের দেশেই রিকশা মেইন সড়কে উঠে যায় কোনো নিয়ম না মেনে। এটা অবশ্য ঢাকার ইতিহাসের শুরু থেকেই। তবে যেসব রাস্তায় পাবলিক পরিবহন নেই সেগুলোতে রিকশা রাখা প্রয়োজন। নগরীর এমন কিছু জায়গা রয়েছে যেখানে রিকশার বিকল্প ভাবা কঠিন। তাই কিছু জায়গায় বিশেষ বিবেচনায় রিকশা চলার অনুমতি
দেয়া প্রয়োজন।
সিটি কর্পোরেশন যে উদ্যোগ নিয়েছে তা প্রশংসনীয়। তবে রাজধানীর তিন প্রধান সড়কে রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও এ সিদ্ধান্ত অনুসারে রিকশা বন্ধ করার বিকল্প হিসেবে রাস্তায় পর্যাপ্ত গণপরিবহনের নিশ্চয়তাও দিতে হবে সিটি করপোরেশনকে। হঠাৎ রিকশা বন্ধে নোটিশ না দিয়ে এর আগে সিটি করপোরেশন আরো কিছু উদ্যোগ নিতে পারত। তাহলে এত আলোচনা হতো না। বিশেষ করে অবৈধ রিকশা উচ্ছেদের বিষয়টি। ঢাকা শহরে রিকশার সংখ্যা প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বর্তমানে ঢাকা শহরে প্রায় ৬ লাখ অবৈধ রিকশা চলাচল করে। ফলে যানজট বৃদ্ধির এটা বড় একটা কারণ কিন্তু সিটি করপোরেশন এই বিষয়ে মাঝে মধ্যে কিছু অভিযান পরিচালনা করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি বরং দিন দিন অবৈধ রিকশার সংখ্যা বাড়ছেই। পাশাপাশি অদক্ষ চালকদের সংখ্যাও এর সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রাম থেকে এসেই ধরছে রিকশার হ্যান্ডেল। এছাড়া রয়েছে আরো একটি সমস্যা। রিকশাচালকদের ইচ্ছেমতো ভাড়া চাওয়ার বিষয়টি। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট ভাড়ার কথা উল্লেখ না থাকায় চালকরা নিজের ইচ্ছেমতো ভাড়া চাচ্ছেন। ৫০ টাকার জায়গায় ১০০ টাকা নিচ্ছেন। অনেক সময় যাত্রীরা বাধ্য হয়ে বেশি ভাড়া দিয়ে রিকশায় উঠছেন। যা কোনোভাবে সমর্থন যোগ্য নয়। রিকশাচালকদের এমন আচরণ বন্ধ করতে হবে। রিকশাচালকরা এমনটা করছেন, কারণ কাগজপত্রে ভাড়ার বিষয়ে কিছু নিয়ম থাকলেও কার্যক্ষেত্রে নেই কোনো নিয়ম। এই সুযোগটাই নিচ্ছেন রিকশাচালকরা।
সিটির মেয়র রিকশায় কম চড়ে নাগরিকদের হাঁটার পরামর্শ দিয়েছেন। খুব ভালো পরামর্শ এটা। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে মানুষ প্রতিদিন মাইলকে মাইল হেঁটে চলে অথচ আমাদের দেশের মানুষ হাঁটতেই চায় না। সামান্য দূরত্বে রিকশায় চড়ে। এতে টাকার যেমন অপচয় হয় তেমনি স্বাস্থ্যের জন্যও রয়েছে ঝুঁকি বরং হাঁটলে অর্থের সাশ্রয় হয় আবার স্বাস্থ্যও ভালো থাকে। তাই মেয়রের এমন প্রস্তাব অবশ্যই সমর্থন যোগ্য। তবে আমাদের মেয়র মহোদয় নিশ্চয় জানেন, উন্নত দেশে ফুটপাতগুলোতে হকারদের দখলে থাকে না কিন্তু আমাদের দেশে ব্যতিক্রম। আমাদের দেশের ফুটপাতগুলো হকারদের দখলে থাকে। যেখানে হাঁটার কোনো সুযোগ নেই। তাই হাঁটার পরামর্শ দেয়া ভালো, তবে তার আগে ফুটপাতকে দখলমুক্ত রাখতে হবে। রিকশা উচ্ছেদের মতো ফুটপাত দখলমুক্ত করার দায়িত্বও মেয়রেরই। তাহলে মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে হাঁটতে পারবে আর স্বাগত জানাবে সব ইতিবাচক সিদ্ধান্তকে।
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা / ১৭ জুলাই ২০১৯/ এমএম