বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: পুরান ঢাকার অধিবাসী মমতাজ শাহিন খান। তার পরিবারের এক সদস্য ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন। তিনি বাগানে কাজ করছিলেন। পরে তার অনেক জ্বর এবং পরে মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরীক্ষায় জানা গেছে তিনি ডেঙ্গু আক্রান্ত। এই রোগীর মতো রাজধানী ঢাকায় আরো ৭৩ জন গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে বলে গতকাল শনিবার স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে।
এ বছর এ পর্যন্ত মোট আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ২ হাজার ৫০০ মানুষ। এরই মধ্যে মারা গেছেন তিনজন। আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে এ রোগের প্রকোপ আরো বাড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সব মিলিয়ে ডেঙ্গু আতঙ্কে আছেন নগরবাসী।
যদিও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেছেন, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি।
ঢাকা নগরীতেই এ বছর ডেঙ্গুতে এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ; যা ছাড়িয়ে গেছে অতীতের সব রেকর্ড। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, জমে থাকা বৃষ্টির পানি, আবহাওয়ার ধরন এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের প্রধান কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এবার জুন থেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার জন; যা বিগত বছরের তুলনায় ৫গুণ বেশি। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে আক্রান্ত হয়েছে ৩৫৮ জন। চলতি সপ্তাহে এ সংখ্যা আরো বেড়েছে। প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। এ বছর এ রোগে এখন পর্যন্ত ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন চিকিৎসকও রয়েছেন। আগস্ট থেকে অক্টোবর এই তিন মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরো বাড়তে পারে, এমনই আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় এ সমস্যা বাড়ছে বলে মনে করছেন নগরবিদরা।
আইসডিআরবি পরিসংখ্যান বলছে, সব মিলিয়ে চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩ হাজার ৭২০ জনেরও বেশি। এর মধ্যে ঢাকার বাইরে ১৯ জনের আক্রান্ত হওয়ার খবর মিলেছে। যদিও আক্রান্তদের মধ্যে ২ হাজার ৯০০ জনই সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়ে গেছেন।
এটি নিয়ে এখনো খুব বেশি উদ্বিগ্ন হতে রাজি নন রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক মীরজাদী সাব্রিনা।
রোগতত্ত¡, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর সূত্রে জানা গেছে, এখন এডিস মশার প্রজনন মৌসুম। এখনই এই মশা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়বে। বর্তমান আবহাওয়াও এই মশা প্রজনন অনুক‚ল পরিবেশ তৈরি করছে। তবে সংস্থাটির মতে, এ থেকে রক্ষায় জ্বর হলেই সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হবে।
এদিকে মশার উপদ্রব ও ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় দুই মেয়রের উদাসীনতাকে দায়ী করে দুই কর্পোরেশনের ওপর ক্ষোভ জানিয়েছেন নগরবাসী। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা আব্দুস সালামের মতে, এ বছর মাত্রাতিরিক্ত হারে মশার উৎপাত বেড়েছে। কয়েল ও মশারিতেও কোনো কাজ হয় না। মশার কামড়ে টেকা দায়। অথচ টেলিভিশনের পর্দায় মশক নিধন ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বড় বড় কথা বলছেন কর্মকর্তারা। এসব বন্ধ করে তাদের উচিত দ্রæত নগরবাসীকে মশার হাত থেকে রক্ষার উপায় বের করা।
মালিবাগের গৃহিণী ঝর্ণা বেগম বলেন, মশার কামড়ে ঘরে থাকা মুশকিল। গত সপ্তাহে সিটি কর্পোরেশন থেকে মশার ওষুধ ছিটিয়ে গেলেও মশা কমেনি। উল্টো বৃষ্টি হওয়ায় মশার উপদ্রব বেড়েছে। ছেলেমেয়ে এরই মধ্যে পড়াশোনা করছে। প্রতিদিন যে হারে মশার কামড় খেতে হচ্ছে, তাতে ডেঙ্গু আতঙ্কে রয়েছেন তিনি।
মশার উপদ্রবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন গোপীবাগের বাসিন্দা সজল মাহমুদ, লিমন, আজিমপুরের বাসিন্দা শামীম, মোহাম্মদপুরের মেহেদী হাসান, রামপুরার হাবিবুর রহমান, দক্ষিণ বনশ্রীর তানভীর সৈকত। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা মেহেদী হাসান গত তিন দিন ধরে জরে আক্রান্ত। জ্বর কমা-বাড়ার মধ্যেই আছে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেলেও কমার কোনো লক্ষণ দেখছেন না।
এদিকে দীর্ঘ বছর ধরে মশক নিধনে ঢাকা-উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে যে ওষুধ ছিটানো হয়, তার খুব একটা কার্যকারিতা নেই। স¤প্রতি দুই মেয়র সাঈদ খোকন ও আতিকুল ইসলামও তা স্বীকার করেছেন। উত্তরে দীর্ঘদিন যাবৎ মশা নিধনের ওষুধ সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্তিও করা হয়েছে।
ঢাকা-উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান মামুন মানবকণ্ঠকে বলেন, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আমরা মশক নিধনের ওষুধ পরিবর্তনের দিকেই যাচ্ছি। তবে এজন্য বিভিন্ন গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ও গবেষক দিয়ে একটি কমিটি করেছি। তারা ওষুধ নিয়ে গবেষণা করার পর আমাদের ওষুধ পরিবর্তনের বিষয়ে যে পরামর্শ দেবেন, সেভাবেই কাজ করা হবে।
দুই সিটি কর্পোরেশন ও নগরীর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করেন বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল হাবিব। তিনি বলেন, ওষুধ কার্যকর হচ্ছে না, এটা এখন আর নতুন কোনো বিষয় নয়। রোগতত্ত¡, কীটতত্ত¡ বিভাগ ও আইসিডিডিআরবিসহ কিছু সংস্থা গত ৩ বছর ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এই বিষয়ে উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। দুই মেয়রের কাছে তারা তুলে ধরেছে, মশক নিধনের ওষুধ এখন আর কার্যকর নয়। তারপরও তিন বছরে বিকল্প ওষুধ বা বিদ্যমান ওষুধ কার্যকর আছে কিনা, তা অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে নগরবাসীকে রক্ষার বাস্তবিক প্রয়াস দুই মেয়র নেননি। তারা প্রচার-প্রচারণার মধ্যেই ডেঙ্গু ও মশকবিরোধী কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছেন।
‘বিদ্যমান ওষুধই ব্যবহার করতে হবে’ স¤প্রতি ডিএসসিসি মেয়রের এমন বক্তব্যের বিষয়ে তিনি বলেন, এমন বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। জনস্বার্থের হুমকির কোনো পরিস্থিতি যদি হয়ে থাকে, তিন সপ্তাহের মধ্যে নতুন ওষুধ বিদেশ থেকে এনে জরুরি অনুমোদন করে তা প্রয়োগের মাধ্যমে জনগণকে বাঁচানো পুরো দায়িত্ব মেয়র বা সরকারের রয়েছে। কিন্তু তারা সেটা করছেন না।
মশা নিয়ে গবেষণা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তার মতে, এবার সচেতন হওয়া বেশি জরুরি কারণ কয়েকটি কারণে এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি হওয়ার আশঙ্কা আছে। এবার ফেব্রুয়ারিতে বৃষ্টি হয়েছে। এডিস মশার ডিম ছয় মাস পর্যন্ত শুকনো স্থানে থাকলে বেঁচে থাকতে পারে। এবার আগে বৃষ্টির কারণে ও এখন থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে এডিস মশার ঘনত্ব বাড়ছে। আবার ঢাকাসহ সারাদেশে পানির স্বল্পতার কারণে মানুষ বালতি কিংবা ড্রামে পানি জমিয়ে রাখে। আর বিভিন্ন ধরনের নির্মাণ কাজের সাইটগুলোতে চৌবাচ্চা, ড্রাম এডিস মশার বিস্তারে প্রধান ভুমিকা পালন করছে।
সে কারণেই দেশজুড়ে জেলা-উপজেলা পর্যন্ত নির্মাণকাজ বেড়ে যাওয়ায় মি. বাশার মনে করছেন নির্মাণ সাইটগুলোতে পানি জমে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়িয়ে দিতে পারে। ঢাকায় ডেঙ্গু নিয়ে প্রচার-প্রচারণা কিছু চোখে পড়লেও ঢাকার বাইরে বিশেষ করে মফস্বল এলাকাগুলোতে এ নিয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই বললেই চলে।
কুষ্টিয়ার শিরিন সুলতানা টেলিফোনে মানবকণ্ঠের প্রতিবেদককে বলেছেন, তাদের এলাকায় প্রচুর মশা। কিন্তু মশা নিধনের কোনো ব্যবস্থা তিনি কখনো দেখেননি।
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা / ১৫ জুলাই ২০১৯/ এমএম