আন্তর্জাতিক নারী দিবস এলে আজকাল আমার কাছে শঙ্খ ঘোষের অতিপরিচিত সেই কবিতার চরণটিই মনে ফিরে ফিরে আসে, ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদে নারী-পুরুষের সমতার কথা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করা হয়েছে৷ বাংলাদেশ সিইডিএডব্লিউ সনদে সই করেছে। কিন্তু আসলে বাস্তবতা কি?
বিশ্বে স্ত্রী নির্যাতনে বাংলাদেশ চতুর্থ। ২০২১ সালে নির্যাতনের শিকার ৩৭০৩ নারী ও শিশু, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে, স্ত্রী নির্যাতনের হারে বিশ্বে চতুর্থ স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে ৫০ শতাংশ নারী নির্যাতনের শিকার হন।বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়,বাংলাদেশে বালবিবাহের ব্যাপকতা বিশ্বে চতুর্থ সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। পুরুষঃ ৩.৭৯ কোটি,নারীঃ ১.৬২ কোটি ;২০১৯-২০ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল: ৩৭,৮৮২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার Iরপ্তানিতে পোশাক খাতের অবদান: ৮৩% (তৈরি পোশাক ৪১.৭%, নিটওয়্যার ৪১.৩%)
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ২০২০ সালের এক গবেষণায় বলা হয়, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান প্রায় ২০ শতাংশ৷ এর সঙ্গে সংসারের ভেতর ও বাইরের কাজের মূল্য ধরলে তাদের অবদান বেড়ে দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ৷ এর অর্থ হলো, দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারী-পুরুষের অবদান সমান সমান৷
বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি পোশাক শিল্পখাত থেকে আসে৷ মোট গার্মেন্টসকর্মীর প্রায় ৫৪ শতাংশ নারী৷ এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট (এসিডি)-র জরিপ অনুযায়ী দেশের মোট ৪২ লাখ ২০ হাজার পোশাকশ্রমিকের মধ্যে নারীর সংখ্যা ২৪ লাখ ৯৮ হাজার৷ এই খাতে নিয়োজিত নারী কর্মী দেশের শিল্পখাতে নিয়োজিত মোট নারী কর্মীর ৭০ ভাগ৷
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যে, ১৯৯১ সাল থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট ৯ লাখ ৩৫ হাজার ৪৬৬ জন নারী প্রবাসে কাজ করতে গেছেন৷ প্রবাসী আয় প্রাপ্তির দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম৷ প্রবাসে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ১ লাখ ২১ হাজার ৯২৫, যা মোট সংখ্যার ১২ দশমিক ৯ শতাংশ৷ তারা দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন৷
কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট কর্মক্ষম নারীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় কৃষিকাজে নিয়োজিত৷ নারী শ্রমশক্তির ৭১ দশমিক ৫ শতাংশ নিয়োজিত কৃষিকাজে৷ বিবিএসের ২০১৮ সালের তথ্য মতে, দেশের কৃষি খাতে নিয়োজিত আছে ৯০ লাখ ১১ হাজার নারী৷
চা শিল্প ৭০ ভাগই নারী৷,চা উৎপাদনের ১৬৬ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ চা উৎপাদনের রেকর্ড হয় ২০১৯ সালে৷ (সূত্র:প্রথম আলো, জুন ২০২০)
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, নার্সিং খাতে ৭ দশমিক ২ শতাংশ নারী অর্থাৎ সেবা খাতে ৩৭ লাখ নারী কর্মরত৷
২০১৮ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, কারখানায় ২১ লাখ ১ হাজার ৮৩০ জন নারী শ্রমিক রয়েছেন আর পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যা ১৯ লাখ ৯৫ হাজার ৫৫৭ জন।
কৃষি খাতে নারীর অংশগ্রহণ এখনো তুলনামূলক বেশি। বীজ সংরক্ষণ থেকে শুরু করে ফসল উৎপাদন, শস্য সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ এবং বিপণন পর্যন্ত প্রতি ধাপে রয়েছে নারীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ। বাংলাদেশ যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে এতে আমাদের গ্রামীণ নারীদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা। নারীরা শুধু শস্য উৎপাদন নয়, মাছ চাষ, পশুপালন এমনকি বাজারজাতের কাজেও সমানভাবে যুক্ত। তবে কৃষিতে নারীর এমন অংশগ্রহণের নাম দেওয়া হচ্ছে ‘পারিবারিক সাহায্য’। কৃষক হিসেবে পরিবার থেকে মূল্যায়ন,সরকারিভাবে স্বীকৃতি মিলছে না !
এবং তারপরও আবহমান কালের নারী রূপের প্রতিমূর্তিটি কল্পনা করলে যে রূপটি ভেসে উঠে তাতে অসহায় দৃষ্টি, পুষ্টিহীনতা ও ক্লান্তির ছাপ, অনিশ্চয়তা ও ভীতি যেন নারীটিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। বর্তমানে সরকারি চাকুরেদের মধ্যে নারী মাত্র ২৭ শতাংশ। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারী ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ।
একটা বছরে কত বিবাহবিচ্ছেদ মামলা,নারী নির্যাতন,ধর্ষণ মামলা আমাদের দেশের আদালতগুলোয় জমা পড়ে, মহিলা কমিশনগুলোতে জমা পড়ে— তার হিসাব কে রাখে! আর ‘নারীবাদ ‘ শব্দটি এখন অনেকটাই গালির পর্যায়ে চলে গিয়েছে। অথচ নারীবাদীরা খাদ্য,বস্র,বাসস্থান,চিকিৎসা,শিক্ষা প্রভৃতিতে নারীর সমান ভাগ,একই কাজের জন্য উভয়কে সমান পারিশ্রমিক দেওয়া,উভয়ের মত প্রকাশের অধিকার থাকা ইত্যাদি বিষয়গুলিই চাইছেন।
সত্যিকারের কথা বলতে গেলে দেশে মানুষ হিসেবে এখনও নারীর স্বীকৃতি মেলেনি। বিবাহিত নারীদের ৮২ শতাংশই স্বামীর হাতে কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। নারী শ্রমিকের বেতন বৈষম্য,যৌতুক প্রথা, বাল্যবিবাহ,ধর্মীয় কুসংস্কার, হত্যা, ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন, অ্যাসিড নিক্ষেপের,সাইবার বুলিইং,সম্পদে নারীর অসম অধিকার, প্রতিনিয়ত নারীকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। নগরে নেই নারীদের জন্য পর্যাপ্ত গণপরিবহণের ব্যবস্থা ,স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ পাবলিক টয়লেট।দেশের বিজ্ঞাপন, নাটক, সিনেমা,ওয়াজ মাহফিলে নারীকে অশ্লীল ও পণ্যরূপে উপস্থাপন করা চলছেই।
ভোগবাদী সংস্কৃতির কবলে নারী: নারীদের পরিণত করা হচ্ছে ভোগ্য পণ্যে,তাকে বানানো হচ্ছে যৌন সামগ্রী।গাড়ির সঙ্গে বিভিন্ন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় নারীদের। দেখে মনে হতেই পারে ‘গাড়ি কিনলে নারী ফ্রি’।
আগে ‘দর্শনধারী পরে গুণ বিচারী’ প্রবাদটি। বর পক্ষের পছন্দের উপর নির্ভর করতে হয় কনে পক্ষকে। এমন কি হয় ছেলেদের যোগ্যতা না দেখে শুধু তার বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখে তাকে বর হিসেবে নির্বাচন করা হয়? হয় না। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে তা অহরহ হচ্ছে। এথানেও অবমূল্যায়িত হচ্ছে নারী। একটা মেয়েকে তার পরিবারে সময় দিতে হবে,সন্তানের জন্য সময় দিতে হবে,শ্বশুরবাড়িতে সময় দিতে হবে এবং তারপর নিজের প্রফেশনে আসতে হবে। অথচ একটা ছেলে শুধু প্রফেশনে সময় দিলেই হয়।
দেশে মােট জনসংখ্যার ৪৯ ভাগ নারী। প্রধানমন্ত্রী নারী, স্পিকার নারী, সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা নারী, উপনেতা নারী, সিনিয়র সচিব নারী। বাংলাদেশে মেজর জেনারেল পদেও নারীরা আছেন।নারীরা এখন বিমান চালাচ্ছেন, মিশনেও নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বর্তমানে সচিব ও সমমর্যাদায় কর্মরত ১১, জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে ১০ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পদে ১৪৯ জন নারী কর্মরত আছেন।বিদেশে বাংলাদেশ চেনাচ্ছেন ৮ নারী দূত। কিন্তু উচ্চ পদে আসীন নারীরা পুরুষতন্ত্রকেই লালন করছেন। বিদেশের মাটিতে ফুটবল, সাঁতার, কাবাডি, শুটিং ও ভারোত্তোলনে স্বর্ণপদক জিতে বিদেশের মাটিতে জাতীয় সংগীত প্রচার করেছে এই নারী ক্রীড়াবিদরা।
এইবার দেখেন আমরা কতটা পশু হতে পারি ?? ২০২১ সালে নির্যাতনের শিকার ৩৭০৩ নারী ও শিশু,ধর্ষণের শিকার অন্তত ১৩২১ নারী!(ASK ) এর মধ্যে হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৪৪ জন। এছাড়া ৪২৭টি রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে এই বছরে।
শুধু তাই নয়,প্রতি চারজনের মধ্যে একজন নারী তার পরিচিতজনের দ্বারা নিপীড়নের শিকার হয় বলে জরিপে উঠে এসেছে। করোনাকালে দেশে ২৩ শতাংশ নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। মাত্র ৬ শতাংশ নারী নির্যাতনের বিষয়ে অভিযোগ করে থাকেন। সম্মানের কথা ভেবে বেশির ভাগই চুপ থাকেন। তাই নির্যাতনের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হবে বলেই ধারণা করা হয়। মানচিত্রের বিভিন্ন ভাঁজে ধর্ষিতা দেশের নারী সমাজ I বাংলাদেশে মেয়েদের ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ৬৬ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। এখনো বিয়ে না করলে,বিয়ে ভেঙে গেলে,বাবার বাড়ি থাকলে নারীকেই প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হয়। এখনো নারীর ঠিকানা হয় বাবার বাড়ি,না হয় শ্বশুরবাড়ি। তার নিজের ঠিকানা নেই।
রাষ্ট্রের কাঠামোতে নারীর অংশগ্রহণ এখনো অনেক কম ::::::
প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া ৪৮ সদস্যের মন্ত্রিসভায় নারী মন্ত্রী চার জন। ২৫ জন পূর্ণ মন্ত্রীর মধ্যে এক জন নারী, দু’জন প্রতিমন্ত্রী ও এক জন উপমন্ত্রী। স্থানীয় সরকারে ৪৬০টি উপজেলার মধ্যে ১৪৯টি উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান নারী। দেশে সচিব ও সচিব পদমর্যাদার ৭৭ জন কর্মকর্তার মধ্যে ১০ জন নারী, স্থানীয় প্রশাসনে দেশের ৬৪ জেলায় জেলা প্রশাসক পদে রয়েছেন ১০ নারী।বিচার বিভাগেও নারীদের সংখ্যা পুরুষের তুলনায় অনেক কম। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে কোনো নারী বিচারপতি নেই।বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশে কর্মরত নারী ১৫ হাজার ১৬৩ জন, যা মোট সদস্যের ৭ দশমিক ০৯ শতাংশ। শিক্ষা খাতে অনেক নারী নিয়োজিত থাকলেও শিক্ষা প্রশাসনে উপস্থিতি কম। প্রশাসন ক্যাডারে বর্তমানে ২৬ শতাংশ নারী৷ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চলতি বছরের হিসেব অনুযায়ী, ১৪৯ জন ইউএনও ছাড়াও বর্তমানে ১০ জন জেলা প্রশাসক (ডিসি), ৩৮ জন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) এবং ১৭৩ জন সহকারী কমিশনার (ভূমি) পদে নারী কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছেন৷ এছাড়া সচিবের মধ্যে ১১ জন নারী৷ ৫১১ জন অতিরিক্ত সচিবের মধ্যে নারী ৮৩ জন, ৬৩৬ জন যুগ্ম-সচিবের মধ্যে ৮১ জন নারী৷
বহু বছর আগে নারীদের দুর্দশা দেখে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, ‘যে দেশের পুরুষজাতির দয়া নাই, ধর্ম নাই, ন্যায়-অন্যায় বিচার নাই, হিতাহিত বোধ নাই, সদ্বিবেচনা নাই, কেবল লৌকিকতা রক্ষাই প্রধান কর্ম ও প্রধান ধর্ম, আর যেন সে দেশে হতভাগা অবলা জাতি জন্মগ্রহণ না করে।’আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা সেই আক্ষেপের জায়গাটি কী পরিবর্তন করতে পেরেছি?
লেখক: কানাডা প্রবাসী নারী সংগঠক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।
প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ০৭ মার্চ ২০২২ /এমএম





