প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: ইউক্রেন ইস্যু ঘিরে ইউরোপে এ মুহূর্তে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। এ উত্তেজনার মধ্যেই পূর্ব ইউক্রেনের রুশপন্থি বিদ্রোহীদের দুটি অঞ্চল দোনেস্ক ও লহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছে রাশিয়া। একইসঙ্গে সেখানে ‘শান্তিরক্ষী’ পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ইতোমধ্যেই দোনেস্ক ও লহানস্কে ঢুকেছে রুশ সেনা ও সাঁজোয়া যান।
এ পরিপ্রেক্ষিতে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো রাশিয়ার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছে। তবে এর কোনো তোয়াক্কা করছেন না পুতিন। বরং উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যেই নানা ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ চালিয়েছে রাশিয়া, যার মধ্যে রয়েছে পারমাণবিক অস্ত্রবাহী ক্ষেপণাস্ত্রও। কিন্তু ইউক্রেনকে ঘিরে এত উত্তেজনা ও সংঘাত আসলে কেন?
এ প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে প্রথমে আমাদের দেখতে হবে প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনকে ঠিক কী চোখে দেখেন ক্রেমলিনপ্রধান পুতিন। ২০২১ সালের জুলাইতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে পুতিন লিখেছেন, ‘অস্ট্রিয়া ও জার্মানি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা কীভাবে একে অপরের পাশে থাকে, তা একবার দেখুন। জাতি, ভাষা ও সাংস্কৃতিক সাদৃশ্যের এই দেশগুলো স্বতন্ত্র স্বার্থ ও পৃথক বৈদেশিক নীতি রক্ষা করলেও তা মিত্রতার সম্পর্কে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।…ইউক্রেনে জন্মগ্রহণকারী লক্ষাধিক ব্যক্তি এখন রাশিয়ায় বসবাস করেন। আমরা তাদের নিজেদের কাছের মানুষ হিসাবেই দেখি।’
ঐতিহাসিক সম্পর্ক ছাড়াও আরও নানা কারণেই ইউক্রেনের পশ্চিমাকরণ ও ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণে প্রবল আপত্তি রাশিয়ার। মস্কো বিভিন্ন সময়ে ইউক্রেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও ন্যাটো জোটে যোগদানে বাধা দিয়েছে। বরং প্রেসিডেন্ট পুতিন চান, ইউক্রেন মস্কো নিয়ন্ত্রিত মুক্ত বাণিজ্য জোট ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়নে (ইএইইউ) যোগদান করুক। ইএইইউকে দেখা হয় সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরায় সক্রিয় করার প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে।
ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের অর্থ হলো রাশিয়ার ঘাড়ের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটোর নিঃশ্বাস ফেলা। অন্যদিকে, মস্কোর দুঃস্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পূর্ব ইউরোপের সাবেক কমিউনিস্ট দেশগুলোর মতো ইউক্রেনও সেদিকেই এগোচ্ছিল। ইউক্রেন সরকার বলছে, তারা ২০২৪ সাল নাগাদ ইইউ সদস্যপদের জন্য আবেদন করবে। এছাড়া দেশটির ন্যাটোতে যোগদানের উচ্চাকাঙ্ক্ষাও কারও অজানা নয়।
এদিকে ইইউ ও ন্যাটোর পক্ষে ইউক্রেনে জনমত বেশ প্রবল। দেশটিতে ২০০৫ ও ২০১৪ সালে ঘটে যাওয়া দুটি গণঅভ্যুত্থানেই বিক্ষোভকারীদের অন্যতম প্রধান দাবি ছিল রুশ বলয় থেকে বেরিয়ে ইইউ ও ন্যাটোতে যোগদান করার। ইইউর সদস্যপদ পাওয়ার প্রক্রিয়া থেকে সরে আসা এবং উলটো রাশিয়ার সঙ্গে বিনিয়োগ প্রস্তাব স্বাক্ষরই সর্বশেষ রুশপন্থি প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়াঙ্কোভিচের পতন ডেকে আনে। গণঅভ্যুত্থানের পর ক্ষমতা নেওয়া নতুন প্রেসিডেন্ট পেত্রো পোরশেঙ্কো ২০১৪ সালে ইইউতে যোগ দেওয়ার চুক্তি স্বাক্ষর করেন। তবে ক্রিমিয়া দখল করে শেষ হাসিটা পুতিনই হেসেছেন।
রাশিয়া যত বড় দেশ, তাদের সমস্যাও ঠিক তত বড়। সারা বছর সচল রাখা যায় উষ্ণ পানির এমন বন্দর রাশিয়ার নেই বললেই চলে। ক্রিমিয়ার সেভাস্তাপোলে রাশিয়ার যে নৌ-ঘাঁটি, সেটি কৌশলগত কারণে তাই মস্কোর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। সোভিয়েত আমল থেকে এই নৌঘাঁটির মাধ্যমে রাশিয়া পুরো কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে তার সামরিক প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে বিরাট সুবিধা পেয়ে আসছে।
ক্রিমিয়ার ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্য বিবেচনায় রাশিয়াও যেমন ছাড় দিতে নারাজ, সামরিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা ইউক্রেনও ক্রিমিয়া ফিরে পেতে মরিয়া। ক্রিমিয়া বাঁচাতে না পারলেও ইউক্রেন ঠিকই প্রতিশোধ নিয়েছে। তারা ক্রিমিয়ার পানিব্যবস্থার বড় উৎস দিনিপার নদীতে বাঁধ দিয়ে রেখেছে। পানির জন্য এখন গভীর সংকটে আছে ক্রিমিয়া। পাইপলাইন দিয়ে পানি সরবরাহ করতে ক্রেমলিনকে খরচ করতে হচ্ছে হাজার হাজার রুবল, খরায় পড়ে থমকে আছে সেখানকার কৃষি খাত।
রাশিয়ায় কোভিড টিকা কার্যক্রম এবং নিষেধাজ্ঞা ও মহামারিতে অর্থনৈতিক বেহাল দশার জের ধরে প্রেসিডেন্ট পুতিনের জনপ্রিয়তায় সম্প্রতি ভাটা পড়েছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ বাধিয়ে অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে চোখ ফেরাতে চাইছেন পুতিন, চাঙ্গা করতে চাইছেন জনপ্রিয়তা। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের পর পুতিনের জনপ্রিয়তা ৯০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল। অন্যদিকে ইউক্রেনকে জিম্মি করে আগের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার দাবিও করতে পারেন পুতিন।
সেনা বা পরমাণু অস্ত্রের কথা বাদ দিলে রাশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র তার বিপুল জ্বালানিভাণ্ডার। ইউরোপের মোট তেল ও গ্যাস সরবরাহের এক-চতুর্থাংশই আসে রাশিয়া থেকে। আর ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে ইউক্রেন হলো রাশিয়ার প্রবেশদ্বার। রাশিয়ার প্রায় ৪০ শতাংশ গ্যাসের সরবরাহ যায় এ পাইপলাইন দিয়ে। তবে ইউক্রেনকে পাশ কাটিয়ে রাশিয়া থেকে জার্মানিতে গ্যাস রফতানির লক্ষ্যে বাল্টিক সাগরের তলদেশ দিয়ে ১ হাজার ২২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন তৈরি করেছে মস্কো। এ পাইপলাইনের কাজ গত বছর সেপ্টেম্বরে শেষ হলেও তা এখনো চালু হয়নি। পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়ার সেনা মোতায়েনের পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার জার্মানি এ পাইপলাইন প্রকল্প চালুর অনুমোদন বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে।
কী ভাবছে বাংলাদেশ?
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের বহুমুখী সহযোগিতার কথা সবারই জানা। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে এবং দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করার কাজে যুক্ত হয়েছিল দেশটি। বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে রাশিয়ার পরমাণু শক্তি করপোরেশন ‘রোসাটম’। রোসাটমের অংশগ্রহণে পাবনা জেলায় নির্মীয়মাণ দেশের বৃহত্তম যৌথ প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। সেখানে দুটি ইউনিট থেকে মোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে।
এদিকে রাশিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য ক্রমেই বাড়ছে। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব সত্ত্বেও ২০২০ সালে বাংলাদেশ-রাশিয়া বাণিজ্য রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সমরসজ্জায় রাশিয়ার তৈরি সামরিক প্রযুক্তি সরঞ্জাম রয়েছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে রাশিয়া থেকে ইয়াক-১৩০ প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধবিমান, এমআই-১৭ ও এমআই-১৭১ হেলিকপ্টার, বিটিআর-৮০ আর্মড পারসোনাল ক্যারিয়ার, মিগ-২৯ জঙ্গিবিমান ও অন্যান্য বিশেষ সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করেছে।
ঢাকা-মস্কো সম্পর্কের মতো বহুমাত্রিক না হলেও ঢাকা-কিয়েভ সম্পর্কের সম্ভাবনাও অস্বীকার করা যায় না। বাংলাদেশ ইউক্রেনে মৎস্য, চামড়া, তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল, ভোজ্যতেল, সবজি, ওষুধ ও তামাক রপ্তানি করে। ইউক্রেন বাংলাদেশে প্রধানত খনিজ সামগ্রী, রাসায়নিক পদার্থ, যন্ত্রপাতি ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি রপ্তানি করে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ইউক্রেনের তৈরি ৬০০টি তুর-কে২ এবং ৮০টি তুর কে-৩ বহুমুখী সাঁজোয়া যান ক্রয়ের চুক্তি করে।
ইউক্রেন পরিস্থিতি আরও অশান্ত হলে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইউরোপের প্রায় ৪০ শতাংশ জ্বালানি তেল-গ্যাস সরবরাহ করে রাশিয়া। রাশিয়া যদি ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তাহলে ইউরোপ বিকল্প জ্বালানির জন্য ঝুঁকবে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে। আর বাংলাদেশ যেহেতু মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি আমদানি করে থাকে, সে কারণে সংকট দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত মূল্যে জ্বালানি তেল কেনা লাগতে পারে।
বাংলাদেশ সবসময় আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করে চলে। ইউক্রেন সংকট ঘনীভূত হলে সেটা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এক অগ্নিপরীক্ষার শামিল হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন পরিস্থিতি যেন যুদ্ধাবস্থায় না গড়ায় এটাই হবে বাংলাদেশের কাম্য। কারণ যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হলে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের অবস্থানের ওপর আমেরিকার সতর্ক দৃষ্টি থাকবে।
এমনিতেই সম্প্রতি বাইডেনের গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানানো এবং ৭ র্যাব কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে এক ধরনের টানাপোড়েন চলছে। বাংলাদেশের জন্য তাই একনিষ্ঠভাবে কোনো পক্ষ নেওয়ার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের সব বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগী-যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্য-ইউক্রেন ইস্যুতে সরাসরি জড়িত।
এই ইস্যুতে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অবস্থানও লক্ষণীয়। দেশটি একদিকে যেমন চীনকে ঠেকাতে আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কৌশলগত মিত্রতা রক্ষা করে চলেছে, অন্যদিকে রাশিয়ার সঙ্গে নিজের ঐতিহাসিক সম্পর্কেও চিড় ধরতে দেয়নি। সম্ভবত এ কারণেই ইউক্রেন নিয়ে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বিবৃতি দেওয়া হয়নি।
পরিশেষে বলা যায়, নয়া স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো, যারা ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি মেনে চলতে চায় এবং ভূ-রাজনীতি ও প্রভাব বিস্তারের রাজনীতির বদলে উন্নয়নকে প্রাধান্য দেয়, তাদের এক হওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। আর এমন উদ্যোগে পথ দেখাতে পারে বাংলাদেশ।
রানা সরদার : গবেষক
প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ /এমএম





