রাজনীতির মূলমন্ত্র দেশপ্রেম। যে রাজনীতিতে দেশপ্রেম নেই, সেই রাজনীতি অন্তসার শূন্য। শুধুমাত্র ক্ষমতা প্রাপ্তির আকাঙ্খা থাকলে জনতার ভালোবাসা পাওয়া যায় না। আর গণমানুষের ভালোবাসা ছাড়া প্রতিহিংসার বিস্তৃতি ঘটিয়ে সাময়িক তৃপ্তি পাওয়া যায় বটে, তবে চুড়াবালির মতো অল্প স্রোতেই তা ভেসে যায়।
বাংলাদেশ তার জন্মলগ্ন থেকেই দুটি ধারায় বিভক্ত ছিল। দেশের অভ্যন্তরে থাকা পরাজিত শক্তি যেমন কোনদিনই বাংলাদেশ কে মেনে নিতে পারেনি ঠিক তেমনি ৭১এ আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের যে সকল শক্তি হায়েনাদের রসদ যুগিয়েছিল, তারাও কোনদিন বাংলাদেশের প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠেনি। তাইতো স্বাধীনতার মাত্র তিন বছরের মাথায় জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর শাসনামল কে অস্থিতিশীল করে তুলতে দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্রকারীরা আদা-জল খেয়েই মাঠে নেমেছিল। কৃত্রিম দুর্ভিক্ষাবস্থা তৈরি করে বঙ্গবন্ধুর শাসনামল কে কলংকিত করেছিল। শেষাবধি দেশি-বিদেশি সকল অপশক্তির সম্মিলিত দুরভিসন্ধিতে ৭৫এর ১৫ই আগষ্ট ইতিহাসের নিকৃষ্টতম ঘটনার মধ্যদিয়ে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েছিল। কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুসহ ১৫ই আগষ্টে নিহতদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে খুনিদের নিরাপত্তার সর্বোচ্চ ব্যবস্থা টি বাস্তবায়ন করেছিলো।
১৯৭৫ থেকে ৯৫, উল্টো ধারায় চলেছিল প্রিয় স্বদেশ । যে বীর মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে দেশটিকে স্বাধীন করেছিল, সেই বীর সন্তানেরা জীবদ্দশায়ই প্রত্যক্ষ করেছে রক্তস্নাত বাংলাদেশে এমপি থেকে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত পরাজিত শক্তিরই আস্ফালন!! পতাকা উড়েছে চিহ্নিত রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসদের গাড়িতে। সেনা ছাউনিতে ক্যাংগারু আদালত বানিয়ে দলে দলে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের ফাঁসি দেয়া হয়েছিল।
সম্প্রতি বিশ্ব মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার লংঘনের দায়ে বাংলাদেশের সফল চৌকস বাহিনী র্যাব কর্মকর্তাদের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, টেকনাফের এক জনপ্রতিনিধির হত্যাকাণ্ডসহ কিছু ঘটনার দায়ে র্যাবকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। কেউ কেউ আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গনতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশ কে আমন্ত্রণ না জানানোর জন্যও বর্তমান সরকারকে দায়ী করে চলেছেন। আমি বিনয়ের সঙ্গে মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের কাছে জানতে চাই- ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট শিশু রাসেল আর সন্তান সম্ভবা নারীসহ জাতির জনকের নির্মম বিয়োগাত্মক ঘটনার সময় আপনাদের মানবাধিকার কোথায় ছিল?
সারিবদ্ধভাবে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের যখন ফাঁসি দেয়া হয়েছিল তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি মার্কিনী অব্যাহত সমর্থন কিসের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ছিল? ৯১ নির্বাচন পরবর্তী সময়ে সারা দেশে সংখ্যা লঘুদের উপর বর্বর নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ডের সময় মার্কিন সরকার কি মানবাধিকার লুকিয়ে রেখেছিলেন? ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে একুশ বছর বিচারের পথকে যারা রুদ্ধ করে রেখেছিল- তাদের সংগে সখ্যতা রক্ষা করে কোন মানবাধিকারের নীতি অবলম্বন করেছিল বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র? ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর দু,লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত লুন্ঠনকারীদের প্রচলিত আইনে বিচার করে শেখ হাসিনা যখন কলংক মুক্তির পথে, মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যার উপর চাপ প্রয়োগ করে সেদিন কোন মানবাধিকারের নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন?
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে বার বার দেশটি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। আজ যারা মানবাধিকারের শ্লোগান তুলছেন, একুশ বছর সামরিক স্বৈরাচারদের রসদ যুগিয়ে এরাই গনতন্ত্র হত্যাকারীদের ঠিকিয়ে রেখেছিলেন। ষড়যন্ত্র আজও চলমান। এটি ঐতিহাসিক সত্য, উন্নয়নের পথে একটি দেশকে নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। পরনির্ভরশীলতা কাটিয়ে বাংলাদেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে, ষড়যন্ত্রের নীলনকশা যেন আন্তর্জাতিক রুপ লাভ করছে। রাজনীতিতে ভিন্নমত কোন অস্বাভাবিক বিষয় নয়, কিন্তু রাষ্ট্রটিকে অকার্যকর প্রমাণে যখন কোন গোষ্ঠী মরিয়া হয়ে উঠে, তখন এটি মোটেও রাজনৈতিক বিরোধিতার পর্যায়ে পড়ে না, এটি নিতান্তই প্রতিহিংসাপরায়ণ দেশদ্রোহীতা।
আজ যারা বিদেশে বসে লবিষ্ঠ নিয়োগ করে রাষ্ট্রকে অকার্যকর প্রমানে মরিয়া হয়ে উঠেছেন, আল জাজিরায় বানোয়াট প্রতিবেদন প্রচার করে সারভৌম বাংলাদেশের সেনাবাহিনী কে বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছেন, ইউটিউব, ফেসবুকে শেখ হাসিনা আর বাংলাদেশ কে নিয়ে অনবরত গোয়েবলসীয় কায়দায় মিথ্যার বেসাতি করছেন-এরা কোনভাবেই শুধুমাত্র রাজনৈতিক ভিন্নমতের অধিকারী নয়। বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু আর জাতীয় পতাকায় এদের কোন আনুগত্য নেই। এরা একাত্তরের পরাজিত শক্তির দোসর, পঁচাত্তরের বেনিফিসিয়ারী, যুদ্ধাপরাধীদের নিয়মিত পেইড এজেন্ট। এদের কে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে বিবেচনা না করে মতাদর্শগত বিরোধ হিসেবে দেখলে, এর কঠিন মূল্য শুধুই হবে সময়ের অপেক্ষা!!
ডেভিড বার্গম্যান, তাসনিম খলিল, ইলিয়াস, ক্যাপ্টেন তাজ সহ যারা প্রবাসে বসে প্রপাগাণ্ডায় নিয়োজিত- এরা কি শুধুই ব্যক্তি কয়েক গোষ্ঠীর সমষ্টি? ইউটিউব আর ফেসবুকেই কি তাদের কর্মকান্ড সীমাবদ্ধ? মোটেও তা নয়। প্রবাসে বিভিন্ন কমিউনিটি সংগঠন, মসজিদসহ নানা ধর্মীয় সংগঠনের আড়ালে এদের ক্রমাগত বিস্তৃতি রীতিমতো উদ্বেগজনক। বাংলাদেশের নাগরিক হয়েও এরা যখন জাতীয় পতাকাকে প্রকাশ্যে অবমাননা করে, তারপরও কি কেউ বলবেন- এরা শুধুই সরকার বিরোধী? এর চেয়েও দুঃখজনক, প্রবাসের আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু পরিষদ আর তথাকথিত প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তি এসব জেনেও যখন নীরবতাকেই উৎকৃষ্ট পন্থা বলে মেনে নেয়!! এমন নীরবতা আত্নঘাতি, উন্নয়নের পথে উদীয়মান একটি দেশের প্রতি উদাসীনতা। মানবাধিকারের নামে আজকের নানা বিধিনিষেধ, প্রবাসে বসবাসকারী দায়িত্বশীলদের উদাসীনতার ফসল নয় কি?
বঙ্গবন্ধু আজীবন আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন, অসহযোগ করেছেন। স্বাধীনতার পরেও গনতন্ত্রের পূনরুজ্জীবনে দেশে আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে। তবে কোনকালেই ধর্মকে ব্যবহার করে, প্রবাসে লবিস্ট নিয়োগ করে দেশ বিরোধী কর্মকান্ড পরিচালিত হয়নি। জন সম্পৃক্ততা আর জনগণের ভালোবাসা ছাড়া পটপরিবর্তনের প্রত্যাশা গনতন্ত্রে বেমানান, দেশদ্রোহীতারই নামান্তর। প্রবাসের দেশে দেশে আমাদের কুটনীতিক মিশনসমুহের পাশাপাশি দেশপ্রেমে উদ্বেলিত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শাখা-প্রশাখাও আছে। রাজনৈতিক বিরোধিতার নামে প্রকারান্তরে দেশদ্রোহীতার যে আলামত দৃশ্যমান হচ্ছে তা প্রতিরোধে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ সময়ের দাবি।
আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দল। বিএনপিও তৃণমূলে বিস্তৃত একটি রাজনৈতিক সংগঠন। এ দলটিতেও দেশপ্রেমে সমৃদ্ধ সার্বভৌমত্বে অনুগত অনেক রাজনীতিবিদ আছেন। দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় এঁরাও আনন্দিত হন বলেই আমজনতা বিশ্বাস করে। যদি তাই হয়, দাবি দাওয়া নিয়ে দেশের রাজপথের পরিবর্তে মিথ্যার বেসাতি নিয়ে বিদেশে লবিস্ট কেন? জন্মলগ্ন থেকেই যারা বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার চিরশত্রু, তাদের উপর ভর করে দু’চারটা নিষেধাজ্ঞা-কি পটপরিবর্তন নিয়ে আসবে? বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, শেখ হাসিনাও দেশপ্রেম বিবর্জিত কোন রাজনৈতিক নেতা নন। পরিবর্তন চাইলে জনতাকেই সংগে নিতে হবে, ইংল্যান্ড, ইউরোপ, আমেরিকার মতো দেশে বসে গোয়েবলসীয় মিথ্যাচার শুধু জনবিচ্ছিন্নতাকেই বাড়াবে। দেশদ্রোহীতা দিয়ে রাজনীতি হয় না, দেশপ্রেমে সমৃদ্ধ হয়ে গণআস্থার রাজনীতিতে এগিয়ে না আসলে মুসলিম লীগের মতো একদিন হারিয়ে যাওয়াই হবে ইতিহাসের শিক্ষা।
লেখকঃ কলামিস্ট, উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক





