Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক ::‌ বহুল আলোচিত ১৯৬৯ সালের সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার অন্যতম ছিল বাস-ট্রেন-লঞ্চে শিক্ষার্থীদের ‘হাফ ভাড়া’ নেয়ার দাবিটি। এরপর দেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীনতারও ৫০ বছর অতিবাহিত হলে গেলেও এখনো শিক্ষার্থীদের সেই দাবি বাস্তবে রূপ নেয়নি। সামরিক কিংবা গণতান্ত্রিক কোনো সরকারের আমলেই বিষয়টি গুরত্ব পায়নি। সম্প্রতি ব্যাপকহারে গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধির পর দাবিটি আবারো সামনে এসেছে।

গত এক সপ্তাহ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দাবি আদায়ের জন্য বিক্ষোভ ও যানবাহন চালকদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। দিনদিনই বাড়ছে আন্দোলনের পরিধি। তাই শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষাবিদ-রাজনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা।

এব্যাপারে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ (নিসচা)-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, পাকিস্তান আমলে আমরা হাফ ভাড়া দিতাম। তখন ঝগড়া হতো না। আইডি কার্ড দেখালেই হাফ ভাড়া নিত। তখন ছাত্র বললেই হাফ ভাড়া হতো। কিন্তু স্বাধীনতার পর সম্প্রতি কয়েক বছর অর্ধেক ভাড়া নিয়ে ঢাকার রাস্তায় দেখা যায় শিক্ষার্থী ও বাসচালকের সহকারীর তর্ক-হাতাহাতি।

দেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী এইচএসসি পাস করেছেন ১৯৭৭ সালে। শিক্ষার্থীদের গণপরিবহনে হাফ ভাড়া নিয়ে তখনকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, তখন কিন্তু বিষয়টা এরকম তীব্র ছিল না। সেই সময় ছাত্ররা আইডি কার্ড দেখালেই হাফ ভাড়া নিয়ে কোনো কথা হতো না। এখনকার মতো ভাড়া নিয়ে তর্কাতর্কি তখন দেখি নাই। ঢাকা শহরের এটি একটি প্রচলিত নিয়ম ছিল। অনেক সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আইডি কার্ড না থাকলেও বই-খাতা সঙ্গে দেখলেই হাফ ভাড়া নিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক তাসনিম আরেফা সিদ্দিকী বলেন, আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, তখন ঢাকার রাস্তায় ব্যক্তিগত গণপরিবহনের থেকে সরকারি গণপরিহনের সংখ্যা ছিল বেশি। সকল শিক্ষার্থীর আইডি কার্ড ছিল। আইডি কার্ড দেখালেই হাফ ভাড়া নেয়া হতো। এখনকার মতো হাফ ভাড়া নিয়ে কন্ডাক্টদের সঙ্গে এত গ্যাঞ্জাম করতে হতো না।

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের আরেক অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, আমার যতটুকু মনে পড়ে আমি যখন ছাত্র ছিলাম তখনো হাফ ভাড়া নেয়া হতো। তবে তখনো এই বিষয়টা খুব স্মুথ ছিল বলে আমার মনে পড়ে না। তখনো হাফ ভাড়া নিয়ে বাসের কন্ডাক্টরদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ধস্তাধ্বস্তির বিষয়টি শুনা যেত।

ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের হাত ধরে আসে ১১ দফা দাবি। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (রাশেদ খান মেনন), পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (বেগম মতিয়া চৌধুরী), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) আটজন ছাত্রনেতা সম্মিলিতভাবে গঠন করেন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের ঘোষিত এ ১১ দফা দাবির একটি ছিল শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়া রাখা। দাবির ১ (ঢ) দফা অনুসারে, ‘ট্রেনে, স্টিমারে ও লঞ্চে ছাত্রদের ‘আইডেন্টিটি কার্ড’ দেখাইয়া শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ‘কন্সেসনে’ (ছাড়ে) টিকিট দেয়ার ব্যবস্থা করিতে হইবে। মাসিক টিকিটেও ‘কন্সেসন’ দিতে হইবে।’

তখনকার সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা ও বর্তমানে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন গণমাধ্যমকে বলেন, তখন আমাদের আন্দোলনের পর ইয়াহিয়া খানের সামরিক আদেশে শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়া দেয়ার বিষয়টি বাস্তবায়ন হয়। অবশ্য এটা আইন দ্বারা হয়নি। এই ধারা স্বাধীনতার পরও বহু বছর চালু ছিল। সম্প্র্রতি দেখা যাচ্ছে অর্ধেক ভাড়ার বিষয়টি নেই। তিনি বলেন, এটা থাকা উচিত। শিক্ষার্থীদের পক্ষে এত ভাড়া দেয়া সম্ভব না। তাছাড়া হাঁটার পরিবেশ ঢাকা শহরে নেই। হাফ ভাড়ার বিষয়টি উঠে যাওয়া উচিত হয়নি।

এ ছাড়াও সা¤প্রতিক সবচেয়ে বড় আন্দোলনগুলোর একটি ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দাবি। তখন ঢাকা অবরোধ করা শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির ভেতরে অন্যতম ছিল, ‘শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’ শিক্ষার্থীদের নয় দিন ধরে চলা ২০১৮ সালের আন্দোলনের পর প্রণয়ন হয় সড়ক পরিবহন আইন। কিন্তু সেখানেও ৯ দফা একটি অর্ধেক ভাড়া সংক্রান্ত দাবি উপেক্ষা করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবারও এক সংবাদ সম্মেলনে যাত্রী কল্যাণ সমিতি ছাত্র-ছাত্রীদের হাফ ভাড়া নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ওই সংবাদ সম্মেলনে সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী যাত্রী প্রতিনিধি ছাড়া মালিক-সরকার মিলে একচেটিয়াভাবে যে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে তা বাতিলসহ ১৩ দফা দাবি জানিয়েছে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ধরেন রাজধানীর গুলিস্তান থেকে কাজলা এই সাত কিলোমিটার রাস্তার ভাড়া ১৫ টাকার জায়গায় আদায় করা হচ্ছে ২৫ টাকা। সেখানে ছাত্ররা যদি অর্ধেক ভাড়া দেয় তাহলেও ওরা মূল ভাড়ার থেকে খুব একটা কম দিচ্ছে না। হাফ পাস ছাত্রদের অধিকার। একই সঙ্গে বাসে যারা আসন না পেয়ে দাঁড়িয়ে যাতায়াত করেন, তাঁদের কাছ থেকেও অর্ধেক ভাড়া নেয়া উচিত।

সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন কয়েকবার। ২০১৫ সালের অক্টোবরে বিআরটিসির কার্যালয়ে বাস ডিপো ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে এক বৈঠকে আওয়ামী লীগের এই সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, ‘আমি এই মুহূর্ত থেকে নির্দেশ দিচ্ছি, রাজধানীতে চলাচলরত বিআরটিসির পাশাপাশি অন্যান্য পরিবহনেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নেবে। আর না নিলে দায়ী পরিবহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

নির্দেশনার পর ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়া নিয়ে পরিবহন মালিকদের কোনো আলোচনা হয়েছে কি না-এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি সংসদ সদস্য মশিউর রহমানকে। তিনি বলেন, তার ‘(ওবায়দুল কাদেরের) এমন কথার পর আমাদের সঙ্গে তাঁর এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। বিআরটিসি অর্ধেক ভাড়া চালু করতে পারে।’পরিবহন মালিকরা কোনো উদ্যোগ নিবেন কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা সরকারের বিষয়। আমাদের নয়। আমাদের না বললে যেঁচে গিয়ে সরকারের সঙ্গে বসব না। সরকার বলুক।’

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ২২ নভেম্বর  ২০২১ /এমএম