ফারুক ওয়াহিদ
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণটি বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য(ওয়ার্ল্ডস ডক্যুমেন্টরি হেরিটেজ) হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে। ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা ৩০ অক্টোবর ২০১৭ সোমবার প্যারিসে ইউনেস্কোর হেডকোয়ার্টারে এ ঐতিহাসিক
ঘোষণাটি দেন। আন্তর্জাতিক তাৎপর্য রয়েছে এমন বিষয়গুলোকে বিশ্ব আন্তর্জাতিক রেজিস্টারের মেমোরিতে তালিকাভুক্ত করা হয়- সেই হিসেবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব আন্তর্জাতিক রেজিস্টারের মেমোরিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আন্তর্জাতিক দলিলে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে তালিকাভুক্ত ঐতিহ্যের সংখ্যা দাঁড়ালো সারা পৃথিবীতে মাত্র ৪২৭টি। এ সংক্রান্ত তালিকাভুক্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি (আইএসি)। ২৪ অক্টোবর ২০১৭ থেকে ২৭ অক্টোবর ২০১৭ পর্যন্ত বৈঠক করে ৭ মার্চের ভাষণকে ইউনেস্কো স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় আইএসি কমিটি।
রক্তঝরা অগ্নিঝরা রোদন ভরা বসন্তের উত্তপ্ত ফাল্গুনের অপরূপ অপরাহ্ণে ঢাকার রমনার সবুজ প্রান্তর রেসকোর্স ময়দানের জনমহাসমুদ্রে ৭ মার্চ বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা পৃথিবী কাঁপানো ভাষণের টগবগে রক্তে আগুন জ্বলা বজ্রকণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” মাত্র ১৯ মিনিটের এই পৃথিবী কাঁপানো বজ্রকণ্ঠের ঐতিহাসিক জ্বালাময়ী ভাষণ ছিল বাঙালির হাজার বছরের আবেগ, হাজার বছরের স্বপ্নের বাণী, হাজার বছরের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন- যা ছিল বাঙালিকে মুক্ত করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। দীপ্ত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করলেন, “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো, এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ্।” এই ঐতিহাসিক ভাষণই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে-নির্দেশে মুক্তিপাগল বাঙালি জাতিকে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মহান মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং এই ভাষণের মধ্য দিয়েই বাঙালির ভবিষ্যত ভাগ্য স্পষ্ট নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল।
স্মৃতির মণিকোঠায় ৭ মার্চ: একাত্তরের অগ্নিগর্ভ ৭ মার্চ ঢাকা ছিল লাখো মানুষের পদচারণায় উত্তপ্ত শ্লোগানের নগরী- ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ ‘জয়বাংলা, জয়বাংলা’ -এসব লাখো মানুষের শ্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল ঢাকা মহানগরী। স্মৃতিময় ঐতিহাসিক সেই দিনের ঘটনার ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে এখনো আমার স্মৃতির মণিকোঠায় জ্বলজ্বল করছে! লক্ষ কণ্ঠের শ্লোগানে শ্লোগানে মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবী প্রকম্পিত হচ্ছে! বাঙালিদের সবচেয়ে ঘৃণিত শ্লোগান ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ তথা পাকিস্তানিদের তথাকথিত শ্লোগান ‘জিন্দাবাদ’-কে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির রণহুঙ্কার হয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘জয়বাংলা’। প্রচুর দেশি-বিদেশি সাংবাদিক উপস্থিত। জনসমুদ্রের মাঝখানে একটি হলুদ রঙের অনেক উঁচু একটি ক্রেনের মধ্যেও ক্যামেরা এবং টেলিভিশন ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলছেন সাংবাদিকগণ। রেসকোর্সের জনসমুদ্রের উপর দিয়ে একটি হেলিকপ্টর উড়ে যায়। বিকেল ৩টা ১৫ মিনিটে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি আর কালো মুজিব কোট পরিহিত বঙ্গবন্ধু যখন মঞ্চে ওঠে এলেন- তখন বাংলার উপস্থিত ১০ লক্ষাধিক বীর জনতা বজ্র নির্ঘোষে করতালি ও গগনবিদারী শ্লোগানের মধ্যে তাদের প্রিয় নেতাকে অভিনন্দন জানান- ‘বাঁশের লাঠি তৈরি কর- বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ- বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘পিন্ডি না ঢাকা- ঢাকা ঢাকা’, ‘জয়বাংলা- জয়বাংলা’, ‘জাগো জাগো, বাঙালি জাগো’, ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, সোনার বাংলা মুক্ত করো’, ‘পাঞ্জাব না বাংলা, বাংলা-বাংলা’, ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘স্বাধীন করো স্বাধীন করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ও ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা করলেন, “আজ বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়। …প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু- আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো, এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয়বাংলা।”
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে সরাসরি প্রচার হওয়ার কথা থাকলেও পাকিস্তান সরকারের হস্তেক্ষেপে তা সেদিন প্রচারিত হতে পারেনি। তাৎক্ষণিক ধর্মঘটে স্তব্ধ হয়ে যায় ঢাকা বেতার কেন্দ্র। পরে বাধ্য হয়ে পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ পরের দিন সকালে বঙ্গবন্ধুর রেকর্ডকৃত ভাষণ প্রচার করে। এই ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে যা নির্দেশ প্রদান করেছিলেন আমরা তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে ঘরে ফিরি। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ আমাদের প্রেরণার চিরন্তন উৎস হয়ে থাকবে।
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ এবং বিশ্ব ইতিহাসের সেরা ভাষণের একটি। বাঙালির দিকনির্দেশনামূলক এই ভাষণটি ছিল একটি নতুন দেশের অভ্যুদয়বার্তা। ইউনেস্কোর স্বীকৃতি ছাড়াও একটি ব্রিটিশ প্রকাশনা সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত ‘The speeches that inspired history’ বইতে বিশ্বের সেরা ভাষণগুলোর একটি ভাষণ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ৭ মার্চ ’৭১ রবিবার রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে উপস্থিত থাকা ১০ লক্ষ লোকের মধ্যে এখনও অনেকেই বেঁচে আছেন- যেমন আমি এখনো বেঁচে আছি- যা আমার স্মৃতির মণিকোঠায় আজও চিরস্মরণীয় হয়ে জ্বলজ্বল করছে।