Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক ::‌ আমাদের অনেকেরই সমজাতীয় রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার বন্ধু আবু নোমান খান মারা গেছেন। মারা গেছেন গত মে মাসে। অথচ খবর পেলাম তিন দিন আগে। তার পরিবারের কেউ এ খবর দেয়নি। খবরটা ভিন্ন সূত্রে জানতে পারলাম। আরও জানলাম, নোমান খানের স্ত্রীও গত বছর কোভিডে ভুগে মারা গেছেন।

আশ্চর্য এক সময়ে আমরা দিন পার করছি। অতিমারির ভয়ে আমরা অনেকেই কুঁকড়ে থাকি। বিশেষ করে বয়স্করা। সামনাসামনি কারও সঙ্গে কারও দেখা সাক্ষাৎ নেই। টেলিফোনে খবর রাখা যায়, এমনকি চাইলে ছবিও দেখতে পারি। সেটাও সবাই করি বলে মনে হয় না।

নোমান খান শুরুতে এক ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি হিসাবে উত্তরাঞ্চলে কাজ করতেন। পরে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করে সবশেষে দৈনিক নিউ এজের বার্তা বিভাগে ছিলেন। পেশা সাংবাদিকতা হলেও তার আসল আকর্ষণ ছিল রাজনীতির প্রতি। তাই বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির কৃষক সংগঠনে কাজ শুরু করেছিলেন।

একপর্যায়ে পার্টিতে ভাঙন এলে তিনি কমিউনিস্ট নেতা আবদুল মতিনের সাথী হয়ে বের হয়ে আসেন। যতদূর জানি, এরপর কোনো দলের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল না। তিনি প্রবলভাবে বিশ্বাস করতেন, প্রচলিত বাম রাজনীতি সমাজে পরিবর্তন আনতে পারছে না। তাই নতুন বাম রাজনীতির সন্ধানে তিনি এককভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে কৃষককর্মীদের মধ্যে কাজ করতে চাইতেন। এ ক্ষেত্রে প্রতিকূলতার মুখোমুখি হচ্ছিলেন বলে আমাকে জানিয়েছিলেন। থানা পুলিশ, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী, এমনকি বাম রাজনৈতিক দলের হুমকি-ধমকি ও সমালোচনা মোকাবিলা করতে হচ্ছিল তাকে।

গত শতাব্দীর শেষদিকে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পরিষদ গঠনসূত্রে নোমানের সঙ্গে পরিচয়। সে বছর প্রধানত কমিউনিস্ট নেতা টিপু বিশ্বাসের উদ্যোগে ১৭ নভেম্বর মওলানার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয়েছিল। সেদিন পল্টনের মোড়ের একপাশে মঞ্চ করে একটা বড় সভা করা হয়েছিল। সে সভার ধারাবাহিকতায় ভাসানী পরিষদ গঠন করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।

প্রস্তুতিমূলক অনেক বৈঠক করে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতায় প্রেস ক্লাবে সম্মেলনের মাধ্যমে আবদুল মতিনকে সভাপতি ও প্রগতিশীল চিকিৎসক ডা. টি আলীকে সাধারণ সম্পাদক করে এক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। নোমান খানকে করা হয়েছিল যুগ্ম সম্পাদক।

কাজের সূত্রে তার সঙ্গে আমার পরিচয় বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছিল। আমরা দুজন সমাজে এক মৌলিক পরিবর্তনে বিশ্বাসী ছিলাম বলে আমাদের ঘনিষ্ঠতা হতে দেরি হয়নি। এ ব্যাপারে আমি তার ভেতর কোনো ভণ্ডামি লক্ষ করিনি। যদিও রাজনৈতিক দল গঠনের ব্যাপারে আমার কোনো সমর্থন ছিল না। আমরা প্রায় সময় আমার বাসা অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার অফিস কক্ষে রাজনীতি নিয়ে কথা বলতাম।

এ ছাড়া ভাসানী পরিষদের অফিসে প্রতি সপ্তাহে আমাদের দেখা হতো। মতিন ভাই, ডাক্তার টি আলী ভাই, শহীদুল্লাহ ভাই, টিপু ভাই, মহসীন শস্ত্রপাণি, প্রকৌশলী ম ইনামুল হক ও অন্য অনেককে নিয়ে ভাসানী পরিষদ তখন প্রাণবন্ত এক সংগঠন হয়ে উঠেছিল। নিয়মিত রাজনৈতিক আলোচনা, বিষয়ভিত্তিক সেমিনার- এসবকে কেন্দ্র করে তর্ক-বিতর্কের স্থান হয়ে উঠেছিল। বাম রাজনৈতিক নেতারা অনেকে আসতেন।

একবার একটা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল, যাতে প্রতি সপ্তাহে একজন করে রাজনৈতিক নেতা তার সাংগঠনিক রাজনীতি নিয়ে কথা বলবেন। ডা. টি আলি ও ম ইনামুল হককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বাম ঐক্যের সন্ধানে দলগুলোর সঙ্গে ক্রমাগত সংলাপ করতে। পরিষদের তরফ থেকে মহসীন শস্ত্রপাণির সম্পাদনায় ২০০২ সালে ‘মজলুম জননেতা’ নামে ৩৭৪ পৃষ্ঠার এক সংকলন গ্রন্থ বের করা হয়েছিল।

মতিন ভাই আগে গেলেন, তারপর গেলেন ডাক্তার ভাই। এবার আবু নোমান। আগের দু’জন পরপর সভাপতি হয়েছিলেন। কিন্তু মূল কাজটা করতেন আবু নোমান খান। প্রথমে যুগ্ম সম্পাদক ও পরে সাধারণ সম্পাদক হিসাবে অফিস সামলানো, রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা, ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকীতে কাগমারি যাওয়ার গাড়ি জোগাড় করা, মাজারে দেওয়ার জন্য ফুলের মালা তৈরি করা, চিত্র প্রদর্শনীর ছবিগুলো ঠিক করা- সব কিছুতেই নোমান।

পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষকদের সমস্যা সমাধান কীভাবে করা যায় তাও তার চিন্তার কেন্দ্রস্থলে ছিল। ডাক্তার টি আলী মৃত্যুর আগে এ নিয়ে একটা লেখার খসড়া তৈরি করছিলেন। নোমান তার সহযোগীর ভূমিকায় ছিলেন। আসলে নোমান আপাদমস্তক এক রাজনৈতিক মানুষ ছিলেন। প্রতিদিন নিয়ম করে তিনি বিভিন্ন বাম রাজনৈতিক দলের অফিসে যেয়ে তাদের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বামমনস্ক তরুণ শিক্ষকদের মধ্যে সংগঠন করার জন্য তাগিদ দিতেন।

২০১৭ সালে কাঁটাবনে এক দুর্ঘটনায় বাম পায়ের হাঁটুর নিচে হাড় ভেঙে যাওয়ার পর থেকে নোমান ভুগছিলেন। তখন তার কাছে গিয়েছি অনেক বার। তার বাসা ও হাসপাতালে গিয়েছি। তার চিকিৎসায় তহবিল সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছি। আমার সঙ্গে প্রকৌশলী বি ডি রহমতুল্লাহও উদ্যোগ নিয়েছিলেন। নোমান খান এরপরও কয়েকবার অসুস্থ হয়েছিলেন।

এদিকে কোভিড শুরু হওয়ায় ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। ফোন বন্ধ পেতাম। অন্য কোনোভাবেও যোগাযোগ করতে পারিনি। এখন মনে হয় শেষ সময়টা তিনি পরিবারের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন বলে বন্ধুদের পক্ষে তার সঙ্গে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

কোভিড আমাদের অনেক পরিচিত মুখকে কেড়ে নিয়ে গেল। যাদের যাওয়ার কথা নয়, তারাও হঠাৎ করে চলে গেলেন। রাজনৈতিকভাবে নিবেদিত একজন মানুষ আবু নোমান খানের চলে যাওয়া একেবারে অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত। দুঃখের ব্যাপার, আবু নোমান খান যে স্মৃতি হয়ে গেছেন, তাও সময়মতো তার বন্ধুরা জানতে পারেনি।

ড. আকমল হোসেন : সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; সভাপতি, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পরিষদ

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ১৭ অক্টোবর  ২০২১ /এমএম

 


Array