– আবেদ খান
শনিবার বিকেলে যখন জানতে পারলাম প্রিয়জন মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলা হয়েছে, তখন যেন ভূমিকম্প খেলে গেল আমার পায়ের তলায়। মনে হলো, পেছন থেকে যেন কোনো এক অদৃশ্য আততায়ী এসে ছুরি দিয়ে আঘাত করেছে আমার গলা, বুক ও মাথায়! যেন রক্ত সরে যাচ্ছে আমার মুখমণ্ডল
থেকে, জাফর ইকবালকে নয়, ফ্যাকাশে করে দিচ্ছে আমাকে।
আমি তো কেবল আমি নই, জাফর ইকবাল তো কেবল সাধারণ একজন শিক্ষক বা লেখক নয়, আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সরব, মুক্তচিন্তার পক্ষে সোচ্চার, ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে একতাবদ্ধ, অসম্প্রদায়িকতার পক্ষে আপসহীন- তারা সবাই তো একাত্তরের পরাজিত পক্ষের কোনো না কোনো আততায়ীর চাপাতির ছায়ায় চলাফেরা করছি।
আজ বেঁচে যাচ্ছি আততায়ীর কোনোপ্রকার সুযোগের অভাবে, কিন্তু আগামীকাল যে আমরা অন্য যে- কেউ আঘাতের শিকার হবো না- তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? নিশ্চয়তা যে নেই, তার নিদর্শন জাফর ইকবালের ওপর এই আঘাতের ঘটনা। একইভাবে প্রায় দেড় দশক আগে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ছুরির আঘাতে-আঘাতে বিধ্বস্ত হয়েছিলেন হুমায়ুন আজাদ। কোনোরকমে সুস্থ হয়ে ফিরে এসেও কদিন পর চলে গিয়েছিলেন না ফেরার দেশে। সেইসব আততায়ীর হাত এখন যেন আরো লম্বা হয়ে গেছে! তা না হলে একটি অনুষ্ঠানের মঞ্চে, চারিদিকের কথিত নিরাপত্তা বেষ্টনির মধ্যে কী করে ঢুকে পড়ে ছদ্মবেশি আততায়ী?
কী কারণে জাফর ইকবালের ওপর এই হামলা হয়েছে, সে বিষয়ে কিছু তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি বটে। তবে জাফর ইকবালের প্রতি হুমকি তো নতুন নয়। সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে স্পষ্টভাষী জাফর ইকবাল বিভিন্ন সময়ে জঙ্গিদের হুমকি পেয়েছেন। প্রায় তিন বছর ধরে তাঁর নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। তাদের পাহারার মধ্যেই গতকাল শনিবার বিকেলে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যা¤পাসে এক অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থী ও পুলিশের উপস্থিতিতেই হামলার শিকার হলেন জাফর ইকবাল।
তাহলে নিরাপত্তাবেষ্টনি ভেদ করা কোনো ব্যাপারই নয় পায়ে পায়ে ছায়ার মতো লেগে থাকা আততায়ীর জন্য? গত বছর পারেনি, গত মাসে পারেনি, গত পরশু পারেনি, কিন্তু গতকাল ঠিকই আঘাতের সুযোগ তৈরি করে নিল কোনো এক আততায়ী।
এটা লিখতে লিখতে জানা গেল যে, জাফর ইকবাল শঙ্কামুক্ত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডা. এহতেশামুল হক দুলাল একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে অধ্যাপক জাফর ইকবালের ক্ষত স্থান পরিষ্কার করা হয়েছে। জখম ততটা গভীর নয়। তিনি এখন আশঙ্কামুক্ত।
কিন্তু আমরা তো শঙ্কামুক্ত হতে পারছি না। বরং নতুন এক শঙ্কা বুকে চেপে বসছে যে, একাত্তরের পরাজিত শক্তি নতুন উদ্যমে আবার ঝাঁপিয়ে পড়তে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাই, নতুন জাগরণে জেগে ওঠার সময় এটা। এটা আদর্শের লড়াই। একাত্তরের পরাশক্তি বনাম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লড়াই, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই। সৈয়দ শামসুল হকের নুরলদীনের কণ্ঠস্বর আবার কাঁপাক আমাদের-জাগো বাহে, কোনঠে সবাই।