Menu

মুহম্মদ জাফর ইকবাল : আমি ইউনিভার্সিটিতে ছেলেমেয়েদের পড়াই, তারা পাশ করে চাকরি-বাকরি পাবে কী পাবে না সেটা নিয়ে কখনো মাথা ঘামাইনি। দেখেছি সবচেয়ে ফাঁকিবাজ ছেলে বা মেয়েটাও কোথাও না কোথাও ঢুকে পড়ছে। তাই দুর্ভাবনা করার কোনো কারণও ছিল না।

তবে ইদানিং সহকর্মীদের কেউ কেউ ছেলেমেয়েদের বিসিএস নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়া নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে শুরু করেছেন। তাদের মতে ক্লাশের লেখাপড়া নিয়ে তাদের মনোযোগ নেই, তারা নাকি দিন-রাত বিসিএস গাইড বই মুখস্ত করে! সত্য-মিথ্যা যাচাই করার কোনো উপায় নেই, তাই আমি সেটা নিয়ে মাথা ঘামাইনি। পত্র-পত্রিকায় দেখেছি, বিসিএস’র কোটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, বিষয়টির গভীরে ঢোকার চেষ্টা করিনি।

চারদিন আগে ভোরবেলা উঠে খবরে দেখলাম- আগের রাতে সরকারি চাকরির কোটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রীতিমত রণক্ষেত্র হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর মহোদয়ের এ ব্যাপারে কী করার আছে কে জানে? কিন্তু তার বাসাটা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়া হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই ডিপার্টমেন্টে সবাই বিষয়টা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেছে এবং আমার তরুণ সহকর্মীরা তখন আমাকে কোটা সংক্রান্ত জটিলতা বুঝিয়ে দিলো। মূল চাকরির ৫৬ শতাংশ নানা ধরণের কোটা থেকে আসে শুনে আমি বেশ অবাক হলাম, কেউ অস্বীকার করবে না সংখ্যাটা যথেষ্ট বেশি।

সেদিন দুপুর বেলা আমাকে একজন সাংবাদিক কোটা সংক্রান্ত বিষয়ে আমার কী ভাবনা জানতে চাইল। আমি মোটেও এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই, তারপরও আমার ভাবনাটুকু বললাম। আমার ধারণা ছাত্রছাত্রীদের কোটা সংস্কারের দাবি যৌক্তিক। তারপরই আমার কাছে যে কথাটি আরো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে সেটাও তাদের জানিয়ে দিলাম। আমি বললাম, যেহেতু এই কোটাগুলোর মাঝে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানসন্ততির জন্যে একটা অংশ আছে তাই আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে যেন কোনোভাবেই কোটা সংস্কারের দাবিতে ভুলেও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বিন্দুমাত্র অসম্মান প্রকাশিত না হয়। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ছেলেমেয়েরা চাকরি পাবে সেই আশায় মুক্তিযুদ্ধ করেননি, আমরা তাদের যথাযথ সম্মান দেইনি, তাদের সেভাবে সাহায্য করিনি। কাজেই কোনোভাবেই যেন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অসম্মান দেখানো না হয়।

পরদিন ক্লাস নিতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম ছাত্রছাত্রী বিশেষ নেই। এই সেমিস্টারে আমার অনেকগুলো কোর্স নিতে হচ্ছে, মাঝখানে পুরো এক মাস ক্লাস নিতে পারিনি। তাই ক্লাশ নেয়ার ভীষণ চাপ। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা জানালো তারা কোটা নিয়ে যে আন্দোলন হচ্ছে সেই আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে, তাই এখন ক্লাশ করবে না। আন্দোলন মানেই কাজকর্ম বন্ধ করে দেয়া, কাজেই মেনে নেয়া ছাড়া গতি কী? আন্দোলন শেষ হবার পর শুক্র, শনিবার বাড়তি ক্লাস নিয়ে কোর্স শেষ করতে হবে সেভাবে চিন্তা ভাবনা করছি। একটা যৌক্তিক দাবি নিয়ে ছেলেমেয়েরা যদি ক্লাশ পরীক্ষা বন্ধ করে আন্দোলন করতে চায় কে তাদের বাধা দেবে?

পরদিন খবর পেলাম পুরো ঢাকা শহর ছেলেমেয়েরা অচল করে দিয়েছে। একেকটা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিজেদের এলাকার রাস্তা ঘাট বন্ধ করে ফেলেছে। ঢাকা শহরের অবস্থা আমরা জানি, শহরের এক কোণায় কিছুক্ষণ ট্রাফিক বন্ধ থাকলেই কিছুক্ষণের মাঝে পুরো শহরে তার প্রভাব পড়ে। কাজেই শহরের বড় বড় ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরা সবাই যদি নিজেদের এলাকা অচল করে রাখে তার ফল কী ভয়াবহ হবে সেটা চিন্তা করা যায় না। এই পদ্ধতিটি নূতন নয়, এর আগে একবার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা একই পদ্ধতিতে তাদের দাবি আদায় করেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের সাত খুন মাফ- তারা যখন খুশি পুরো শহর, প্রয়োজন হলে পুরো দেশের মানুষকে জিম্মি করে ফেলতে পারে। তাদের কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। তাদের এই কর্মকাণ্ডে যে শিশুটি স্কুলে যেতে পারেনি, যে রোগীটি হাসপাতালে যেতে পারেনি, গার্মেন্টসের যে মেয়েটি কাজে যেতে পারেনি, যে রিকশাওয়ালা তার পরিবারের খাবার উপার্জন করতে পারেনি তাদের কারো জন্যে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের এই ছাত্রছাত্রীদের কোনো মায়া নেই। তাদের দাবিটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বা স্বৈরশাসকের পতনের মতো জাতীয় কোনো দাবি নয়, নিজেদের একটা চাকরি পাওয়ার সুযোগটা বাড়িয়ে দেওয়ার দাবি।

গ্রাম থেকে একটা মেয়ে যদি শহরে এসে গার্মেন্টসে একটা চাকরির চেষ্টা করতো, কিংবা কোনো একজন তার জমি বিক্রি করে মালয়েশিয়াতে চাকরি পাবার চেষ্টা করতো তাহলে তাদের পাশে দেশের সব বড় বড় অধ্যাপকেরা এসে দাঁড়াতেন না, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের পাশে তারা এসে দাঁড়িয়েছেন। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা কিন্তু তাদের পাশে যারা দাঁড়িয়েছেন তাদের সম্মানটুকু রক্ষা করেনি। তারা দেশের মানুষকে জিম্মি করে, যারা তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাদেরকেও অপরাধী করে দিয়েছে। যদি আমি জানতাম তারা এরকম করবে তাহলে তাদের দাবির বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে একশ হাত দূরে থাকতাম।

বিসিএস পরীক্ষায় কী প্রশ্ন করা হয় কিংবা ভাইভাতে কী জিজ্ঞেস করা হয় আমি জানি না। আমি যদি সেই পরীক্ষা নেয়ার দায়িত্বে থাকতাম তাহলে তাদের নিচের প্রশ্নটি করতাম: তোমার দাবি আদায় করার জন্যে তুমি কী সবাইকে নিয়ে রাস্তাঘাট বন্ধ করে পুরো শহরকে জিম্মি করে ফেলার বিষয়টি সমর্থন করো?

যারা এই দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি নেয়ার স্বপ্ন দেখছে তারা কী উত্তর দিতো?

আমার খুব এটি জানার ইচ্ছা।

লেখক: অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

বাংলাপ্রেস/ ২৪ এপ্রিল/ আর এল