Menu

‘বাঁশের চেয়ে জিংলা মোটা’ গ্রাম বাংলার এই প্রবাদটি আজকাল বড় বেশি মনে পড়ে। শৈশবে এর মর্ম বুঝতে বেশ খানিকটা সময় লেগেছিল। স্কুল ছাত্র থাকাকালীন আমার এক বাকপটু বন্ধু ছিল। সিনিয়র, জুনিয়র, সময়, পরিবেশে তার কথাবার্তা আচার আচরণে তেমন পার্থক্য হতো না। একবার এক গ্রামীণ সালিশে মুরব্বিদের সামনে এমন কথা বলে বসলেন, যার জন্য সালিশে বসা গ্রামীণ পঞ্চায়েতের সর্দাররা সবাই সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘বাঁশের চেয়ে জিংলা মোটা’। উপস্থিত মুরুব্বিরা তার ঔদ্ধত্যকে চরম বেয়াদবি হিসেবে আখ্যায়িত করলেন, সালিশের বিজ্ঞ সভাপতি ব্যাখা করে বুঝালেন বাঁশের চেয়ে কঞ্চি/জিংলা বা এর শাখা প্রশাকা বড় হলে সেই বাঁশ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, ভেঙে পড়ে। বন্ধুটির পিতাও সে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। ক্ষুব্ধ বিচারকগন বিব্রত পিতার কাছে বেয়াদব পুত্রের শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া অবধি শালিস মুলতবির ঘোষণা দিলেন। পিতা আমার বন্ধুটিকে আবাল বৃদ্ধ বনিতার সামনে বিশ বার কান ধরে ওঠবস করে সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনার নির্দেশ দিলেন। উপায় অন্তহীন বন্ধুটিকে সেদিন চরম লজ্জা আর বিব্রতকর পরিস্থিতিতে নির্দেশ টি মানতে হয়েছিল। আজও অনেক সময় গল্পছলে বন্ধুটি বলেন, সেদিনের একটি ঘটনা তার জীবনের মোড়কে ঘুরিয়ে দিয়েছে। চেইন অব কমান্ড শিক্ষা দিয়েছে। ‘ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেলে’ বা ‘ বাঁশের চেয়ে জিংলা মোটা’ হলে কি হতে পারে সেদিন আমার বন্ধুটিসহ উপস্থিত সবাই বুঝতে পেরেছিলাম। তবে আজকাল চারপাশের সব ঘটনা দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, ‘ শৈশবের সেই শিক্ষাটি কি ভুল ছিল?

উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুর সুদৃঢ় নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের পূর্বেই রাজধানী থেকে গ্রাম বাংলায় এর শাখা প্রশাখা বিস্তৃত হয়েছিল। প্রতিটি স্তরেই শক্তিশালী চেইন অব কমান্ডের কারণেই দলটির নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়েছিল। পঁচাত্তরের বিয়োগান্তক ঘটনার পর একুশ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকেও ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর অনেক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধু কন্যা দলটিতে চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বলেই সামরিক একনায়কদের হঠিয়ে আওয়ামী লীগ আজ রাষ্ট্র ক্ষমতায়। তবে গত একদশকে দলটিতে হঠাৎ করে গজিয়ে উঠা অসংখ্য আগাছা যেন আজ ভর করেছে। রাজধানী থেকে অজপাড়াগাঁয়ে সবখানেই আজ ‘বাঁশের চেয়ে জিংলা মোটা’ হয়ে যাচ্ছে!!

প্রিয় পাঠক রিজেন্টের প্রতারক সাহেদের কথা নিশ্চয় আপনারা ভূলে যাননি। কোট-টাই পরা সাহেদ বুদ্ধিজীবি সেজে আওয়ামী লীগের উপ কমিটির সদস্যের পরিচয়ে র‍্যাব প্রধান, পুলিশ প্রধান, গণভবন আর মিডিয়া সবাইকে বিভ্রান্ত করে কত বড় প্রভাবশালীই না হয়ে উঠেছিল! এক সময়ে মন্ত্রী সচিবও যেন তার হাতের পুতুল বনে গিয়েছিল। শেষ অবধি, এই ভন্ড কোভিডকালে সারা দুনিয়ায় প্রিয় বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিল। শেখ হাসিনা সজাগ না হলে, না জানি কত মন্ত্রী নেতা আজও তার তোয়াজ করেই বেড়াতো!! আর পাপিয়া কান্ডের সেই হেরেমখানা, সেটিও তো হঠাৎ গজিয়ে উঠা আওয়ামী নামেরই কলংক ছিল। শেখ হাসিনার দৃঢ়তা, সেক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগের ইজ্জত রক্ষার উপায় হয়ে উঠেছিল।

অতীতে দেখেছি ছাত্র নেতারা আন্দোলন সংগ্রাম করে জাতীয় পরিচিতি পেয়েছে, ছাত্রজীবন শেষে জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখে জাতীয় পর্যায়ে পরিচিতি অর্জন করেছে। সুদীর্ঘ সাংগঠনিক জীবনে নিষ্ঠা, একাগ্রতা, আদর্শ, দেশপ্রেম আর নানা ক্যারিশমাটিক গুণাবলীর কারণে সারাদেশে অগনিত ভক্ত/ অনুসারীর সৃষ্টি হয়েছে। আর এসব নেতারাও সব সময় মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছে। আর আজকাল কোথা থেকে উড়ে এসে জোরে বসে কে যে কখন কিভাবে প্রভাবশালী হয়ে উঠে বুঝা বড়ো মুশকিল। যেনতেন উপায়ে অর্থ বিত্তের মালিক হয়ে এরাই যেন রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি হয়ে উঠে। শেখ হাসিনা সচল না হওয়া অবধি অনেক সুবিধাবাদী মন্ত্রী নেতারাও তাদের তোয়াজ করে।

হেলেনা জাহাঙ্গীর, আওয়ামী লীগের কোন এক উপ কমিটির সদস্য ছিলেন। এর আগে বিএনপি, জাতীয় পার্টিও করেছেন। ছলনে বলনে শেখ হাসিনা ছাড়া কাউকেই নেতা মানতেন না। জয়যাত্রার নামে বিশ্বব্যাপি নেটওয়ার্ক তৈরীতে লিপ্ত ছিলেন। বর্তমান কেবিনেটের বয়োজ্যেষ্ঠ এক মন্ত্রীকে সামনে রেখেই জয়যাত্রা টেলিভিশনের প্রচার প্রসার চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কানাডার কেলগেরীতে জয়যাত্রাকে কেন্দ্র করে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্কও গড়ে উঠেছিল। আলবার্টা আওয়ামীলীগের অনেক প্রভাবশালীরাও হেলেনা জাহাঙ্গীরের ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন। কেউ কেউ জয়যাত্রা টেলিভিশনকে একটি প্রভাবশালী মিডিয়া হিসেবেও ভাবতে শুরু করেছিলেন। লাফিয়ে লাফিয়ে ভক্ত অনুসারীর সংখ্যাও বাড়ছিলো।

হঠাৎ বিনা মেঘেই বজ্রপাত। হেলেনা জাহাঙ্গীর র‍্যাবের হাতে গ্রেফতার। আদালতে তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর। তার বিরুদ্ধে চাকুরীজীবি লীগ আর সিনিয়র জাতীয় নেতৃবৃন্দের প্রতি অবজ্ঞাসূচক আচরণ ব্যতিত আর কি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে তা এখনো আমার কাছে সুস্পষ্ট নয়। তবে সরকারি ভাষায় জয়যাত্রা একটি অনুমোদনহীন টেলিভিশন মিডিয়া!! যদি তাই হয় তবে একজন কেবিনেট মন্ত্রী কি করে অগনিতবার এই গণমাধ্যমটির অনুষ্ঠানে হাজির হন? জয়যাত্রা মন্ত্রী মহোদয়কে কখনোবা টেলিভিশনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক, কখনো চেয়ারম্যান আবার কখনো বা প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। উপস্থিত মহোদয়ের হাস্যবদনে এর স্বীকৃতিও মেলে। তাহলে বঙ্গবন্ধুর অনুসারী কেউ যদি আজ বলে বসে পতাকাধারী অনেকেই আজ আইন-কানুন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করেন না, সেটি খুবই অন্যায় হবে কি?

আমি হেলেনা জাহাঙ্গীরকে আওয়ামী লীগের একজন উপকমিটির সদস্য হিসেবেই জানতাম। কখনো ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ করেছেন এমন তথ্য আমার জানা নেই। আন্দোলন, সংগ্রামে রাজপথে থেকেছেন এমন তথ্যটিও আমার কাছে অজ্ঞাত। এর বাহিরে তিনি একজন ব্যবসায়ী সেটিও জানতাম। তবে জয়যাত্রার শক্তিশালী নেটওয়ার্কের সুবাদে কেলগেরী শহরে তিনি বেশ পরিচিত ছিলেন। প্রায়শই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উনাকে দেখেছি। মন্ত্রী নেতাদের সামনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দর্শক শ্রোতারা তাকে শেখ হাসিনার কাছের মানুষ হিসেবেই মনে করতেন। তবে যতবারই তাকে দেখেছি, তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ আর ভাষাশৈলী আমাকে সেই শৈশবের গ্রামীণ সালিশের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। ‘বাঁশের চেয়ে জিংলা মোটা’ এটি ভেবে আতংকিত হয়েছি। জানিনা আজকের আওয়ামী লীগে এমন জিংলার সংখ্যা কত? তবে এমন কঞ্চির সংখ্যা বেড়ে গেলে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাতে সংশয় কোথায়?

লেখক: কলামিস্ট, উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ০৩ আগস্ট ২০২১ /এমএম