Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক ::‌ করোনায় শনাক্ত ও মৃত্যুর ঊর্ধ্বগতি আরো কয়েক সপ্তাহ অব্যাহত থাকতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য বিশেজ্ঞরা। তারা মনে করেন, গত তিন সপ্তাহ ধরে রোগী শনাক্ত যেভাবে বাড়ছে, তাতে করে সামনে মৃত্যু আরো বাড়বে।

এর কারণ হিসেবে তারা বলেন, করোনার সুপ্তিকাল (ইনকিউবিশন পিরিয়ড) ১৪ দিনের মধ্যে লক্ষণ উপসর্গ প্রকাশ পায়। আর লক্ষণ উপসর্গ প্রকাশ পাওয়া থেকে শুরু করে ১৫ দিনের পর থেকে রোগীদের অবস্থা জটিল হয়ে শেষে মৃত্যু হয়। যদিও মৃত্যু আরো আগে হতে পারে।

উল্লেখ্য, টানা ছয়দিন মৃত্যুর সংখ্যা শতাধিক। সর্বশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১৩২ জন। এর আগের দিন গত বৃহস্পতিবার মারা গেছেন ১৪৩ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয়েছেন ৮ হাজার ৪৮৩ জন। এ নিয়ে টানা তিন দিন ধরেই আট হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছেন।

শনাক্ত ও মৃত্যু আরো বাড়ছে উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, করোনার সুপ্তিকাল ১৪ দিনের মধ্যে লক্ষণ উপসর্গ প্রকাশ পায়। আর লক্ষণ উপসর্গ প্রকাশ পাওয়া থেকে শুরু করে ১৫ দিনের পর থেকে রোগীদের অবস্থা জটিল হয়ে শেষে মৃত্যু হয়। সে হিসেবে গত তিন সপ্তাহ থেকে রোগী শনাক্ত ধরে করোনায় আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু আরো বাড়বে।

যারা আক্রান্ত হয় তাদের মধ্যে এক দশমিক ৫ থেকে দুই শতাংশের মৃত্যু হয় জানিয়ে তিনি বলেন, তাহলে গত কয়েক সপ্তাহের প্রতিদিনের শনাক্তের ভেতর থেকেই মৃত্যু সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে এবং এটা অবধারিত। আমাদের মৃত্যু আগেরবারের চেয়ে আনুপাতিক হারে বেশি হবে এবং সেজন্যই গত বৃহস্পতিবারের রেকর্ড শেষ রেকর্ড নয়। আমাদের হয়তো আরো বেশকিছু দিন অধিকহারে মৃত্যু দেখতে হতে পারে।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, রোগী ম্যানেজমেন্ট খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। সঠিকভাবে রোগী ম্যানেজমেন্ট না করতে পারলে মৃত্যু বাড়বে। এখন সবচেয়ে জরুরি হলো মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা।

বেড়েছে অক্সিজেনের চাহিদা: ঢাকাসহ সারাদেশে করোনায় শনাক্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায় হাসপাতালগুলোতে বেড়েছে রোগীর চাপ। আসন সংকটের কারণে অনেক হাসপাতালে নতুন রোগী ভর্তি নেয়া হচ্ছে না। কোনো কোনো হাসপাতালে মেঝেতে রেখে চলছে চিকিৎসা। একই সঙ্গে দেখা দিয়েছে অক্সিজেন ও আইসিইউ সংকট। খোদ রাজধানীর সবচেয়ে বড় ৫টি হাসপাতালে খালি নেই কোনো আইসিইউ। আর শুক্রবার সকাল ৯টা পর্যন্ত মাত্র ১৩ ঘণ্টার ব্যবধানে হাই ফ্লো নজেল ক্যানোলার অভাবে বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিটে ভর্তি থাকা ৭ করোনা রোগী শ্বাসকষ্টে মারা গেছেন।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ‘সাধারণ সময়ের চেয়ে করোনায় মেডিক্যাল অক্সিজেনের চাহিদা ৪০ শতাংশ বেড়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে দেশীয় ছোট ছোট কম্পানিকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। বিদ্যমান কম্পানিগুলো এবং নতুনদের মাধ্যমে কিভাবে উৎপাদন বাড়ানো যায়, সেই চেষ্টা আমাদের আছে।’

একদিনে আরো ১৩২ মৃত্যু, শনাক্ত ৮ হাজার ৪৮৩: গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ১৩২ জনকে নিয়ে দেশে করোনায় এখন পর্যন্ত সরকারি হিসাবে মারা গেলেন ১৪ হাজার ৭৭৮ জন। এর আগে গত বৃহস্পতিবার করোনায় মারা যান সর্বোচ্চ ১৪৩ জন। তারও আগে গত ২৭ জুন সর্বোচ্চ ১১৯ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। এর আগে ৩০ জুন ১১৫ জন, ২৯ জুন ১১২ জন আর ২৮ জুন মারা যায় ১০৪ জন।

স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, এই একদিনে শনাক্ত হয়েছে আট হাজার ৪৮৩ জন, সুস্থ হয়েছেন ৪ হাজার ৫০৯ জন। সবমিলিয়ে এখন পর্যন্ত শনাক্ত হলেন ৯ লাখ ৩০ হাজার ৪২ জন আর সুস্থ হলেন আট লাখ ২৫ হাজার ৪২২ জন।

গত একদিনে করোনার নমুনা সংগৃহীত হয়েছে ৩০ হাজার ৩৮৫টি আর পরীক্ষা হয়েছে ৩০ হাজার ১২টি। নমুনা পরীক্ষার বিবেচনায় রোগী শনাক্তের হার ২৮ দশমিক ২৭ শতাংশ আর এখন পর্যন্ত ১৩ দশমিক ৯৪ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ আর মৃত্যুর হার এক দশমিক ৫৯ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ১৩২ জনের মধ্যে পুরুষ ৮১ জন আর নারী ৫১ জন। দেশে এখন পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়ে পুরুষ মারা গেলেন ১০ হাজার ৪৯৬ জন আর নারী চার হাজার ২৮২ জন।

মারা যাওয়া ১৩২ জনের মধ্যে ঢাকা বিভাগের ৩০ জন, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগের ২৪ জন করে, খুলনা বিভাগে ৩৫ জন, বরিশাল ও সিলেট বিভাগে দুইজন করে, রংপুর বিভাগে নয়জন আর ময়মনসিংহ বিভাগের রয়েছেন ছয়জন। তাদের মধ্যে সরকারি হাসপাতালে মারা গেছেন ৯৯ জন, বেসরকারি হাসপাতালে ২০ জন আর বাড়িতে ১৩ জন।

বেড়েছে অক্সিজেনের চাহিদা: দেশে বেড়েছে অক্সিজেনের চাহিদা। অক্সিজেনের স্থানীয়ভাবে কোনো উৎপাদন প্রতিষ্ঠান না থাকায় রাজধানীকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে ঢাকার বাইরের সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে। ঢাকায়ও করোনা সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়ছে। আর এতে রাজধানীতেও অক্সিজেনের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে উৎপাদন না বাড়ায় সামনের দিনগুলোতে সরবরাহ সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বিকল্প প্রস্তুতি না নিলে অক্সিজেন সংকট তীব্র হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে চারটি প্রতিষ্ঠান অক্সিজেন তৈরি করে। এগুলো হচ্ছে লিন্ডে বাংলাদেশ, স্পেক্ট্রা অক্সিজেন, ইসলাম অক্সিজেন ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্যাসেজ। করোনা মহামারীর আগে দেশে দৈনিক ১০০ টন মেডিক্যাল গ্রেড অক্সিজেনের চাহিদা ছিল। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সেই চাহিদা ৩০০ টন ছাড়িয়ে গেছে। এই চাহিদা আরো বাড়তে পারে।

যদিও সম্প্রতি সরকারিভাবে দেশে এই মুহূর্তে ৯০০ টন অক্সিজেন মজুদ আছে বলে সংসদে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি জানান, দেশের অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে আরো ৪৫০ টন অক্সিজেন মজুদ রয়েছে। জাহিদ মালেক বলেন, দেশে বর্তমানে সাধারণ ও কোভিড রোগী মিলে ৭০-৮০ টন অক্সিজেন প্রয়োজন। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের পিকের সময় সর্বোচ্চ অক্সিজেন চাহিদা ছিল ২১০ টন পর্যন্ত। এই মুহূর্তে দেশে দৈনিক অক্সিজেন উৎপাদনে সক্ষমতা রয়েছে ২২০ থেকে ২৩০ টন।

তিনি বলেন, আগামী মাসে একটি বেসরকারি সংস্থা ৪০ টন অক্সিজেন সরবরাহ করবে। জুলাই মাসে অন্য একটি বেসরকারি সংস্থা আরো ৪০ টন অক্সিজেন সরবরাহ করবে। ফলে দেশে কোভিডকালে তৃতীয় ঢেউয়ের মাত্রা স্বাভাবিক থাকলে তা মোকাবিলা করতে কোনো সমস্যা হবে না। করোনা চিকিৎসায় রোগীর খারাপ অবস্থা হলে তখন অক্সিজেন মূল ভূমিকা পালন করে। এ কারণে অতি দ্রুত দেশের সরকারি ১৩০টি হাসপাতালে এখন সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো) ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা বলেন, ‘সাধারণ সময়ের চেয়ে করোনায় মেডিক্যাল অক্সিজেনের চাহিদা ৪০ শতাংশ বেড়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে দেশীয় ছোট ছোট কোম্পানিকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। বিদ্যমান কোম্পানিগুলো এবং নতুনদের মাধ্যমে কিভাবে উৎপাদন বাড়ানো যায়, সেই চেষ্টা আমাদের আছে।’

ঢাকার ৫ বড় হাসপাতালে ফাঁকা নেই আইসিইউ: স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, রাজধানী ঢাকার অন্যতম পাঁচটি সরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) ফাঁকা নেই। এই পাঁচটি হাসপাতালের সবগুলো আইসিইউ বেডেই রোগী ভর্তি আছে।

শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদফতর করোনা বিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিটের ২৬ বেড, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের ১০ বেড, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২০ বেড, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২০ বেড এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ১০ বেডের সবগুলোতেই রোগী ভর্তি রয়েছে, কোনো বেডই ফাঁকা নেই।

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ০৩ জুলাই ২০২১ /এমএম