Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক ::‌  প্রতিবছরের মতো চলতি বছরেও বিশ্বের বসবাসযোগ্য শহরের র‌্যাংকিং প্রকাশ করেছে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)। ইআইইউ’র তালিকায় বাসযোগ্য শহরের তালিকায় তলানিতে রয়েছে আমাদের রাজধানী শহর ঢাকা। এ জাতীয় খবর ঢাকাবাসীসহ দেশের জনগণের জন্য উদ্বেগের ও নিরানন্দের। বিভিন্ন দেশের শহরের ওপর জরিপ চালিয়ে সম্প্রতি ১৪০টি শহরের র‌্যাংকিং প্রকাশ করা হয় এবং এ তালিকায় ঢাকার অবস্থান ১৩৭ নম্বরে।

নতুন এ জরিপ অনুসারে ২০২১ সালে বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড। আর দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে জাপানের ওসাকা। ইআইইউ ২০১৯ সালে সর্বশেষ যে র‌্যাংকিং প্রকাশ করেছিল, সেই তালিকায় বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরগুলোর তালিকায় ঢাকা ছিল তৃতীয় অবস্থানে। সেই হিসাবে এ বছরের র‌্যাংকিংয়ে এক ধাপ অগ্রগতি হয়েছে ঢাকার, যা মন্দের ভালো।

বসবাসের যোগ্যতার দিক থেকে শহরগুলোর মোট পাঁচটি বিষয়কে সূচকে আমলে নেওয়া হয় এবং এর জন্য মোট ১০০ নম্বর ঠিক করা হয়। এ বছর ঢাকা পেয়েছে ৩৩.৫ নম্বর। এর মধ্যে শহরের স্থিতিশীলতার দিক থেকে ৫৫, স্বাস্থ্যসেবায় ১৬.৭, সংস্কৃতি ও পরিবেশে ৩০.৮, শিক্ষায় ৩৩.৩ এবং অবকাঠামোতে ২৬.৮ নম্বর পেয়েছে ঢাকা।

২০১৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ১০টি স্বাস্থ্যঝুঁকি চিহ্নিত করে। এর মধ্যে এক নম্বর ঝুঁকি হচ্ছে বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন। আর ২০১৮ সালে সংস্থাটির হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা ছিল তৃতীয়। ঢাকার বায়ুদূষণের এ চিত্র সরকারি সংস্থা পরিবেশ অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণেও উঠে এসেছে। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে ঢাকার বায়ুমান মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর। ঢাকা শহরের বায়ুতে যেসব ক্ষতিকর উপাদান আছে, তার মধ্যে মানবদেহের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক উপাদান হচ্ছে পিএম ২.৫।

ডব্লিউএইচও’র তথ্যানুসারে, পিএম ২.৫ শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে সহজেই শরীরে প্রবেশ করে তা শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগসহ হৃদরোগের পরিমাণ বাড়ায়। তাছাড়া পিএম ২.৫-এর কারণে অ্যাজমা ও ফুসফুসের ক্যানসারও হতে পারে। আর বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু হয়।

বলা হয়ে থাকে, বিপদ-আপদ, দুর্ঘটনা, ভূমিকম্প, সুনামির ওপর কারও হাত নেই; কিন্তু একটু সচেতন হলেই বায়ুদূষণ রোধ করা, জলাশয় ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণ, অপরিকল্পিত ফ্যাক্টরি-কারখানা নির্মাণ করে শহরের ওপর অত্যধিক চাপ সৃষ্টি করা, শহরকে জ্বলন্ত চুল্লিতে পরিণত করা, এক ঘণ্টার টানা বৃষ্টিতে পুরো একটি শহরকে পানির নিচে তলিয়ে দেওয়া, একই রাস্তা অসৎ উদ্দেশে বারবার খোঁড়াখুঁড়ি করে জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলা, যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলে দুর্গন্ধময় পরিবেশ সৃষ্টি করা, যানজট, ধুলাবালি, ধোঁয়া আর মশার উপদ্রবকে জনগণের নিত্যসঙ্গী বানানো এবং পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকটে শহরবাসীকে ভোগান্তির হাত থেকে অন্ততপক্ষে রক্ষা করা যেতে পারে।

ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে ঢাকা সিটি করপোরেশনের দুই মেয়র ও কাউন্সিলররা এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে নগরবাসীর প্রত্যাশা। ঢাকাকে আতঙ্কিত, অপরিকল্পিত ও অপ্রস্তুত শহর হিসাবে প্রায়ই উল্লেখ করা হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমেও এ বিষয়ে প্রায়ই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়; কিন্তু ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তোলা যেন কিছুতেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ ও যানজটমুক্ত করার ব্যাপারে নানা পরিকল্পনার কথা শোনা যায়।

ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নিত্যনতুন পরিকল্পনাও তৈরি হয়, সিটি করপোরেশনের মেয়র-কাউন্সিলরাও ভোটের আগে-পরে ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তোলার দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। আবার এসব নিয়ে প্রায়ই সভা-সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সেসব পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার কোনো উদ্যোগ তেমন একটা দেখা যায় না।

ইআইইউ-এর বিগত কয়েক বছরের জরিপ থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট, ঢাকাকেন্দ্রিক নগরায়ণ টেকসই নয়, যা প্রত্যেক নগরবাসীই উপলব্ধি করতে পারেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কেন এত পিছিয়ে? স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থা ভালোই বলতে হবে। ঢাকায় নেই কোনো সামরিক যুদ্ধের হুমকি বা বড় ধরনের সহিংস অপরাধের উপস্থিতি। নেই কোনো সাম্প্রদায়িক বা গোষ্ঠীগত সহিংসতায় হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর রেকর্ড। নেই পশ্চিমাদের ঢাকার প্রতি বিদ্বেষ। এখানে স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষাব্যবস্থা ধনী দেশগুলোর মতো না হলেও একবারে যে অপ্রতুল তা কিন্তু নয়।

কিন্তু পাবলিক পরিবহণ ব্যবস্থা বলতে যা বোঝায়, তা ঢাকায় নেই। প্রয়োজনের তুলনায় রাস্তার স্বল্পতা, ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত ট্রাফিক ব্যবস্থা, জনগণ কর্তৃক ট্রাফিক আইন না মানার পাশাপাশি সুষ্ঠু গণপরিবহণ ব্যবস্থার অভাবে ঢাকার রাস্তাঘাটে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। আর যানজটের কারণে মানুষের মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে কার্যক্ষমতা ও মনোযোগ। ঢাকা এমনই একটি শহর, যেখানে পথচারীদের চলাচলের জন্য সামান্যতম যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকা প্রয়োজন সেটুকুও নেই। যতটুকু আছে সেখানেও হকার, পুলিশ ও ক্ষমতাসীনদের ‘ম্যানেজ’ করে বসানো হয় দোকানপাট। একশ্রেণির মানুষের সীমাহীন অর্থলিন্সা রাজধানী ঢাকাকে ভয়াবহ ইট-কাঠের বস্তিতে পরিণত করছে।

ইতঃপূর্বে সংঘটিত পুরান ঢাকার নিমতলীতে বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারের বিস্ফোরণ কিছুতেই সর্বগ্রাসী নারকীয় অগ্নিকাণ্ড ঘটত না, যদি প্লাস্টিক ও রাসায়নিক দ্রবাদিসহ বিভিন্ন দাহ্য পদার্থের ফ্যাক্টরি ও কারখানা আবাসিক এলাকার দালানকোঠাকে বিপজ্জনক মৃত্যুপুরী না করে তুলত। অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় ঢাকায় বড় আকারের কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে যে পরিমাণ ক্ষতি হবে, তা হবে অকল্পনীয়।

শরীরের কোনো অংশে অস্বাভাবিক কোষ বৃদ্ধির কারণে ওই অংশে টিউমার, গোদ রোগ বা মরণব্যাধি ক্যানসারের সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে মানুষ যেমন তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারায়, ঠিক তেমনিভাবে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ওপর নানা দিক থেকে অস্বাভাবিক চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস এবং দেশের বিপুলসংখ্যক জনগণ কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে রাজধানীমুখী হওয়ায় এ সংখ্যা প্রতিদিনই অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। ঢাকার ওপর বর্তমানে জনসংখ্যার চাপ যে হারে বাড়ছে, তাতে করে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল যদি হয় ঢাকা এবং তার মাত্রা যদি রিখটার স্কেলে ৭ কিংবা তার একটু ওপরে হয়, তাহলে ঢাকা ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে।

ঢাকা শহরের ওপর চাপ কমানোর জন্য ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ এখন অত্যন্ত জরুরি বিষয় হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়নে ১৪-১৫টি শিল্পকারখানা আছে, যার অধিকাংশ সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগে। সুতরাং বিসিআইসি-এর হেড অফিস ঢাকার বাইরে সুবিধাজনক কোনো স্থানে করা যেতে পারে। বাংলাদেশ সুগার ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে ১৫টি ইন্ডাস্ট্রি আছে, যার ১০টি উত্তরবঙ্গে এবং তিনটি দক্ষিণবঙ্গে এবং অপর দুটি ফরিদপুর ও জামালপুরে।

সুতরাং বিএসএফআইসি-এর হেড অফিস রাজশাহী বা উত্তরবঙ্গের সুবিধাজনক কোনো স্থানে স্থানান্তর করা যেতে পারে। পাশাপাশি বড় একটি সেক্টর রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস শিল্প, যা দেশের সর্ববৃহৎ ও সর্বাধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী শিল্প। বিজিএমইএ’র তত্ত্বাবধায়নে পরিচালিত ঢাকা অঞ্চলে রয়েছে প্রায় ৩ হাজার ফ্যাক্টরি। এসব ফ্যাক্টরিতে লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। আর এসব ফ্যাক্টরির কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্য উভয়ের চলাচল হয় চট্টগ্রাম ও মোংলা পোর্ট দিয়ে।

অর্থনীতির পরিভাষায়, উৎপাদনের উপকরণ ও উৎপাদিত পণ্য নির্বিবাদে স্থানান্তরের সুযোগ থাকলে যে কোনো স্থানের বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত সুফল সংযুক্ত অন্যান্য এলাকাতেও পৌঁছানো যায়। তুলনামূলকভাবে পণ্য চলাচল সহজ ও সাশ্রয়ী হলে আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস পেতে পারে। এক্ষেত্রে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোর বিকেন্দ্রীকরণও অত্যন্ত জরুরি।

ঢাকা শহরকে পরিষ্কার রাখতে ঢাকা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ২০১৬ সালকে পরিচ্ছন্ন বছর হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল; কিন্তু বাস্তবে তা কতটুকু কার্যকর হয়েছে, সেই বিষয়ে সচেতন নগরবাসীই ভালো বলতে পারবেন। প্রতিবারই সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের সময় মেয়র ও কাউন্সিলর পদের প্রার্থীরা ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত কতটুকু বাস্তবায়িত হয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

এক্ষেত্রে সবার স্মরণে রাখা প্রয়োজন-ঢাকাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, বাসযোগ্য নগরী হিসাবে গড়ে তোলার কাজটি মেয়র ও কাউন্সিলরদের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের আন্তরিকতাসহ সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন। পাশাপাশি বিভিন্ন গণমাধ্যম, রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের অংশগ্রহণও আবশ্যক। সর্বোপরি, নগরবাসীকে এ ব্যাপারে সচেতন হয়ে মেয়র-কাউন্সিলরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে কাজ শুরু করতে হবে এখন থেকেই। যেন ঢাকা শহর আগামী দিনে সত্যিকার অর্থেই একটি বাসযোগ্য শহর হিসাবে গড়ে ওঠে, যে শহরের স্বপ্ন আমরা সবাই দেখি।

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; গ্রিনপিস ইন্টারন্যাশনালের ক্লাইমেট অ্যাক্টিভিস্ট

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ১৩ জুন ২০২১ /এমএম