তুষার আবদুল্লাহ :: অসুখে মুখের রুচি চলে যায়। মুখের রুচি হারিয়ে যাওয়াকে খুব ছোট অসুখ ভাবা ঠিক হবে না। কারণ, মুখে রুচি না ফেরা পর্যন্ত মানসিক ও শারীরিক দুই যন্ত্রণা একসঙ্গে চলে। শরীরে দেখা দেয় পুষ্টির ঘাটতি। তাই মুখে রুচি ফিরিয়ে আনা এক কঠিন লড়াই। নিজেকে এখন সেই লড়াইয়ের সৈনিক ভাবছি। এক অসম্ভব যন্ত্রণায় ছটফট করছি। ভেজালের সাম্রাজ্যে বসেও কষ্টে মুখের রুচি ধরে রাখছি। কিন্তু মন ও সংস্কৃতির রুচি ধরে রাখতে পারছি না। ক্রমশ অবনমন হচ্ছে। এই যে আমার রুচির অবনমন, এজন্য কি ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে দায়ী, নাকি সমাজ আমাকে রুচিহীনতার ডোবায় ছুড়ে দিচ্ছে?
সমাজ এক ধরনের প্রভাবক, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। সমাজের উসকে দেওয়ার বদ অভ্যাস আছে। যে যাপন ও বচনে অভ্যস্ত নই, সমাজ আমার মধ্যে ঈর্ষা, কৌতূহল তৈরি করে আমাকে সেই স্রোতে ভাসিয়ে নিতে পারে। আবার আমি নিজে থেকেও পিছিয়ে পড়ার শঙ্কা, সমাজে ভেসে থাকার আকাঙ্ক্ষা থেকে ওই রুচি শরীর ও মনে মেখে ফেলতে পারি। রুচি-অরুচির দ্বন্দ্ব চিরকালীন। কোনটি রুচিকর আর কোনটি অরুচিকর, সেই বিচার সালিশ অমীমাংসিত। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সনাতন দৃশ্যমাধ্যমে যা দৃশ্যমান হচ্ছে, তা দেখে নিজের রুচির অবনমন নিয়ে আর কোনও দ্বিধা থাকছে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারেও রুচিহীনতারই পরিচয় দিয়ে যাচ্ছি।
বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের মন ও ঘরের অন্দরকে যেভাবে উপস্থাপন করছি, দৃশ্যত ও বর্ণমালার মাধ্যমে তা কতটুকু সাধারণের চোখের কাছে সহনীয়। নিজেকে কতটা সস্তাভাবে উপস্থাপন করছি, তা বিবেচনায় আসছে না। যে কথাটি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বলতে গিয়েও জিভ কাটি, সেই কথা অবলীলায় লিখে ফেলছি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের টাইমলাইনে। বাড়ির যে ঘরটিতে পরিজনেরাও ভেবেচিন্তে উঁকি দেন গলা খাকারি দিয়ে, সেই ঘর আমি উন্মুক্ত করে দিলাম সামাজিক যোগাযোগের ময়দানে। এটি কিছুটা নিজের মনস্তাত্ত্বিক পুষ্টিহীনতা। অনেকটাই সমাজের প্ররোচণায়। অন্যরা এমনটা করছে, আমার করতে বাধা কথায়? এই যুক্তি অনেকটা নিজের কাছে নিজে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া বা মিথ্যা শুদ্ধ থাকার তুষ্টি। সামাজিক ময়দানে আমরা যারা চড়ে বেড়াচ্ছি, তারা সবাই রোগাক্রান্ত। পছন্দ, দেখা ও সংক্রমণ; এই তিন না হলে শরীরে অম্বল হচ্ছে। মনে বাড়ছে বিষণ্নতা।
এবার ঈদের মতো প্রতি ঈদেই আমরা দেখতে পাই কিছু চরিত্র নিয়ে বলি খেলা শুরু হয়ে যায়। কে কার সঙ্গে নাচবেন, কে শরীর ও সম্পদের শক্তিতে গান গাইবেন, এ নিয়ে জ্ঞাপন, বিজ্ঞাপন শুরু করে দেই আমরা নিজেরাই। বাস্তবতা হলো, আসলে এই চরিত্রদের ক’জনার অভিনয় আমরা দেখি? এত স্থূল অভিনয়-নাচের যদি সত্যি আমরা ভোক্তা হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের মনের লবণ ও খনিজের ভারসাম্য স্বাভাবিক অবস্থায় যে নেই, তার জন্য চিকিৎসকের কাছে দৌড়ানোর দরকার কী? কেউ একজন গান গাইবেন, গাইতে শুরু করলেন, এ নিয়ে বিজ্ঞাপনও করছি আবার তাকে গালমন্দ করছি। তিনি তার ক্ষমতা বলে আনন্দে গান করছেন করুন। আমি কেন ট্রল করে নিজের রুচিহীনতাকে প্রকাশ্যে আনছি। সত্যিই যদি আমজাদ হোসেনের জব্বার আলী নাটক দেখার মতো করে তার গান শোনার জন্য অপেক্ষা করে থাকি, তাহলে আমরা রুচির খাদের কোন কিনারে দাঁড়িয়ে আছি? দর্শনে ও শ্রবণে আমাদের রুচির যেমন আকাল, তেমনটা পাঠেও দৃশ্যমান। একুশের বইমেলা থেকে শুরু করে শ্রেণিকক্ষের পাশের বইমেলা থেকেও একই সংকেত পাচ্ছি।
কেন এই অবনমন? খুব জটিল প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন নেই। শুধু নিজের সংস্কৃতির প্রতি আস্থা রাখতে না পারাই আমাদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণ। যাপিত জীবনের সবকিছুতেই আমরা জলদি খাবার সংস্কৃতিকে বেছে নিয়েছি। সহজভাবে সবকিছু চাইছি। নিজের জীবন কেমন করে সাজাবো, তার জন্য অন্যের ব্যবস্থাপত্র থেকে প্রেরণা চাইছি। নিজের শক্তির ওপর বিন্দুমাত্র আস্থা নেই। নিজের ওপর আস্থা রাখার ক্ষেত্রে আমরা নিম্নচাপে আছি। এই নিম্নচাপ থেকে বেরিয়ে না আসতে পারলে মন ও শরীরের রুচিহীনতা আমাদের আরও ভোগাবে।
মনে রাখা দরকার, রুচির দরিদ্রতায় ভোগে যে জাতি, তাদের সংস্কৃতিতে কখনোই অহংয়ের পালক উড়বে না।
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি
সূত্র : বাংলাট্রিবিউন
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/০৮ জুন ২০১৯/ইএন