Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: রমজান আল্লাহর অশেষ নিয়ামতের একটি মাস। কুরআন-হাদিসে এর তাৎপর্য সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত আছি। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে রোজা আমাদের শরীরের কী উপকার করে এবং কীভাবে করে তা অনেকেরই অজানা। এক সময় অনেক তরুণ-তরুণী মনে করত রোজা রাখলে শরীর ভেঙে যাবে, চামড়া শুষ্ক হয়ে যাবে, চেহারা নষ্ট হয়ে যাবে ইত্যাদি। এখনো যারা এরকম মনে করে থাকেন, তাদের জন্য আমার এ লেখাটি রোজার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক হতে পারে।

রোজায় দীর্ঘ সময় অনাহারে থাকার ফলে রক্তে শর্করার পরিমাণ কমে যায়। ফলে বেড়ে যায় গ্রোথ হরমোনের নিঃসরণ। গ্রোথ হরমোন হচ্ছে এমন এক হরমোন, যা শরীরের বিভিন্ন অংশের চর্বি পোড়াতে কাজ করে, আমিষ নিঃসরণ করে এবং বয়স ধরে রাখতে সাহায্য করে। ফলে অনেকেই ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে গ্রোথ হরমোন গ্রহণ করেন। অনাহারের ১২ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে গ্রোথ হরমোন স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিঃসরণ শুরু হয়। এরপর থেকে ঘটতে থাকে চমৎকার কিছু ঘটনা।

সাধারণত আমাদের দেহকোষ প্রাণরাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে খাদ্যের পুষ্টি উপাদান ভেঙে প্রয়োজনীয় উপাদান তৈরি করে তার স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য। রোজা ব্যতীত অন্য সময় সারা দিন খাবারের কারণে দেহকোষের বিভিন্ন অঙ্গানু পুষ্টি উপাদান ভাঙার কাজ (যা তার জন্য বাধ্যতামূলক) নিয়েই প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকে। যখন প্রয়োজনীয় উপাদানের পাশাপাশি তৈরি হয় কিছু বর্জ্য।

এ ছাড়াও বিভিন্ন মানসিক চাপ, অস্বাস্থ্যকর খাদ্য/পরিবেশ ইত্যাদি কারণেও আমাদের মস্তিষ্ক ও শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে জমা হয় অসংখ্য অকার্যকরী উপাদান (এমইলয়েড)। রোজার সময় শরীরের কোষগুলো নতুন খাবার বা পুষ্টি উপাদান না-পেয়ে তার ভেতরে জমে থাকা ক্ষতিকর জীবাণু ও অকার্যকরী উপাদান, যা আমাদের শরীরে ক্যানসার, হৃদরোগ, মস্তিষ্কে অ্যালঝেইমার রোগ (স্মরণশক্তি কমে অমনোযোগী হয়ে যাওয়া ও অসামঞ্জস্যতা) ও টিউমারসহ নানাবিদ রোগ সৃষ্টি করে, সেগুলোকে অটোফ্যাজি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুনর্ব্যবহার করে নতুন কোষ বা আমিষ তৈরি করে। এর ফলে শরীরের ভেতরে সারা বছরে জমে থাকা ময়লা পরিষ্কার হয়ে থাকে।

বলতে পারেন, আপনার ঘরের ব্যবহার অনুপযোগী জিনিসপত্র, যা আপনার ঘরে পচে রোগজীবাণু ছড়াচ্ছে এবং আপনি আপনার বাধ্যতামূলক কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে ওইগুলোকে কাজে লাগাতে পারছেন না বা পরিষ্কার করতে পারছেন না। অটোফ্যাজি প্রক্রিয়া ১৪-১৮ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে বেশ কার্যকরী হয়। বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের (বিশেষ করে গ্লুকোজ ও অ্যামিনো এসিড) উপস্থিতি অটোফ্যাজি প্রক্রিয়ার অন্তরায় হিসাবে কাজ করে।

চিত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি অনাহার শুরু হওয়ার পর দুটি মেটাবলিক সেন্সর (AMPK এবং mTORC1) অটোফ্যাজি প্রক্রিয়ার জন্য নিয়োজিত প্রোটিন মলিকুলকে সংকেত দিচ্ছে এবং পুষ্টি উপাদানের অনুপস্থিতি বলে দিচ্ছে। যেখানে mTORC1 প্রোটিন ULK-কমপ্লেক্স থেকে আলাদা হয়ে অটোফ্যাজি প্রক্রিয়া শুরু হওয়াকে তরান্বিত করছে। তারপর সেই প্রোটিন মলিকুল অকার্যকরী কোষীয় উপাদানগুলোর চারদিকে একটি আবরণ তৈরি করে, যাকে ফ্যাগোফর বলা হয়। আবরণ তৈরি সম্পন্ন হওয়ার পর লাইসোসোম নামক একটি কোষীয় অঙ্গানু আবরণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অপ্রয়োজনীয় উপাদানগুলোকে গ্রহণ করে কোষের ভেতরে পরিষ্কার করে দিচ্ছে, যা নতুন কোষ তৈরিতে সহায়তা করে।

এ প্রক্রিয়া পুনরায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতে থাকে, যেটি আবিষ্কার করে নোবেল পুরস্কার পান একজন জাপানি বিজ্ঞানি ইওশিনোরি অহসুমি। নোবেল পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে ইওশিনোরি অহসুমিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কতদিন আমাদের উপবাস থাকা উচিত? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, বছরে ২০ থেকে ২৫ দিন কেউ যদি উপবাস থাকে, তাহলে তার শরীরে জমে থাকা অপ্রয়োজনীয় কোষীয় উপাদানগুলো পরিষ্কার হয়ে যায়।

আমাদের দেহ তার ভেতরে থাকা ইস্ট, মোল্ড, ফাঙাশ ও অন্যান্য ক্ষতিকর জীবাণু ধ্বংস করার জন্য সব সময় এক ধরনের অক্সিডেন্ট বা জারক (হাইড্রোজেন সালফাইট) নিঃসৃত করে। এর আধিক্য শরীরের জন্য ক্ষতিকর, তাই শরীরে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ওই নিঃসৃত অক্সিডেন্টকে নিরপেক্ষ করে। স্বাভাবিক সময়ে অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে শরীরও অতিরিক্ত পরিমাণে অক্সিডেন্ট নিঃসৃত করে। ফলে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অক্সিডেন্টের একটি অসমতা তৈরি হয়, যাকে বলে অক্সিডেটিভ চাপ, যা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধের বিরাট অন্তরায়।

কিন্তু রমজানে অটোফ্যাজির ফলে শরীরকে অতিরিক্ত অক্সিডেন্ট নিঃসৃত করতে হয় না। এর ফলে অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের একটি সমতা বজায় থাকে, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। অতএব, শরীরে কোভিড-১৯ ভাইরাসসহ বিভিন্ন ভাইরাল সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্যও রোজা বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে।

কারও মনে প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে কি যত বেশি সময় অনাহারে থাকব, তত বেশি সময় অটোফ্যাজি প্রক্রিয়া চলতে থাকবে? হ্যাঁ, অটোফ্যাজি প্রক্রিয়া চলবে কিন্তু পাশাপাশি কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া শুরু হবে, যা শরীরের গঠন ভেঙে দিতে পারে। গবেষণা বলছে, ৪৮ ঘণ্টা বা এর বেশি সময় কেউ যদি আহার না-করে তাহলে শরীরে উৎপন্ন হওয়া স্টেমসেল (অকার্যকর কোষ) উদ্দীপ্ত হয়। ফলে শরীরের টিউমার ও ক্যানসার কোষগুলো ভেঙে পুনর্গঠন হয়, যা বয়স ধরে রাখতে সাহায্য করে। গবেষণায় এটিও বলা হয়েছে, ১৮ ঘণ্টা অনাহার তারপর ৬ ঘণ্টা বিরতি, যা শরীরের জন্য উপকারী।

এখন ভেবে দেখুন, রোজা শুরু হয়েছে আজ থেকে শত শত বছর আগে। আমরাও রোজায় অনাহারে থাকছি প্রায় ১৪-১৮ ঘণ্টা, যেটা বৈজ্ঞানিকভাবেও উৎকৃষ্ট সময়। তবে কেউ যদি রোজার বাইরেও বেশি সময় অনাহার থাকতে চায়, তাহলে তিনি তা থাকতে পারেন, তবে তাকে পর্যাপ্ত পানি, ভিটামিন ও খনিজ চালিয়ে যেতে হবে শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রম ঠিক রাখার জন্য।

ড. মুহাম্মদ শফিউর রহমান : সহকারী অধ্যাপক, খাদ্য প্রকৌশল ও প্রযুক্তিবিদ্যা বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ২৪ এপ্রিল ২০২১ /এমএম


Array