প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: মানব সভ্যতার ইতিহাসে অনেক উদ্ভাবন, উন্নতি ও ভাল কাজের পাশাপাশি সভ্যতাকে ধ্বংস করার মত যে সকল কর্মকান্ড ঘটেছে তার মধ্যে একটি হল গনহত্যা। মানুষ হয়ে মানুষকে নির্মম ভাবে হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছে কিছু মানুষরূপী দানব। এই গনহত্যা কেবলমাত্র রাজনৈক কারণে সংঘঠিত হয় তা নয়, বরং ব্যক্তিগত স্বার্থ, লোভ, ক্ষমতা দখল, এবং মানসিক বিকৃতিও অন্যতম কারণ হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
মানসিক ভাবে বিকৃত মানুষগুলো নিজের দেশের, নিজের সম্প্রদায়ের লোকগুলোকে কখনো জাতীয়তার, কখনো সম্প্রদায়ের অথবা কখনো ধর্মের দোহাই দিয়ে ঘটিয়েছে গনহত্যা। পাকিস্তানী সামরিক শাষক জাতীয়তার দোহাই দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মাসে ঘটিয়েছিল এক ভয়ংকর গণহত্যা।
২৫শে মার্চ জাতীয় গনহত্যা দিবস, মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি কলংকিত দিন। ২০১৭ সালের ১১ ই মার্চ জাতীয় সংসদে ২৫শে মার্চ “জাতীয় গনহত্যা দিবস” পালনের প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হওয়ার পর থেকে এ দিনটি “জাতীয় গণহত্যা দিবস” হিসেবে পালন করা হয়ে আসছে বাংলাদেশে।জাতীয় গণহত্যা দিবস বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ত্রিশ লক্ষ বাঙালির আত্মত্যাগের মহান স্বীকৃতির পাশাপাশি তৎকালীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম গণহত্যার বিরুদ্ধে চরম প্রতিবাদের প্রতীক।
১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত রেজুলেশন ২৬০ (৩,) এর অধীনে গনহত্যা বলতে বোঝানো হয়েছে এমন কর্মকান্ড যার মাধ্যমে একটি জাতি বা ধর্মীয় সম্প্রদায় বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে সম্পুর্ন বা আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে।
এই সংজ্ঞার আলোকে আমরা নিশ্চিত ভাবেই বলতে পারি ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ সামরিক শাসক ইহায়িয়ার নির্দেশে জেনারেল টিক্কা খানের নেতৃত্বে “অপারেশন সার্চলাইট ” নামের যে সামরিক অভিযানে সংগঠিত হয়েছিল সেটা ইতিহাসখ্যাত জঘন্যতম গণহত্যা।
ঐ রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঘুমন্ত, নিরস্ত্র মানুষের উপর। রাজধানী ঢাকায় প্রথমে তারা হামলা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মচারীদের আবাসে, পুলিশ ও সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী, ইপিয়ার এর সদর দপ্তর, ঢাকার বস্তি, বাজার, ও হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা সমুহ।
ঢাকা শহরের এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় প্রায় সকল শহরে। এই ধরনের ব্যাপক গনহত্যা চলেছিল পুরো নয় মাস জুড়ে।নির্বিচারে গণহত্যারর পাশাপাশি সনাক্তকরণের মাধ্যমে হত্যার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ২৫ শে মার্চ থেকেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হত্যার মাধ্যমে আরম্ভ হয়েছিল এই প্রক্রিয়া যার চুড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে মুক্তি যুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় লাভের পূর্ববর্তী কয়েক সপ্তাহে। বিশেষ করে ডিসেম্বর মাসের প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকিস্তানিরা পরাজয় অনিবার্য জেনে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, চিকিৎসক, আইনজীবী, প্রকৌশলী,ও বিজ্ঞানীদের তালিকা প্রস্তুত করে হত্যা করেছিল।
আর্চার ব্লান্ড এর লেখা ” দ্য ক্রয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ ” থেকে জানা যায় ২৫ শে মার্চ রাতে রোকেয়া হলে আগুন ধরানো হয়েছিল এবং ছাত্রীরা হল থেকে দৌড়ে বের হওয়ার সময় মেশিনগান দিয়ে গুলি করে তাদের হত্যা করা হয়। “গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস” এ বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞকে বিশ শতকের পাঁচটি ভয়ংকর গণহত্যার অন্যতম গণহত্যা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০০২ সালে যুক্ত্ররাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যাল্যের, ” নিরাপত্তা বিষয়ক আর্কাইভ ” অবমুক্তকৃত দলিল প্রকাশ করে। সেখানে বাংলাদেশের নারকীয় হত্যাকান্ডকে “জেনোসাইড” হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।
যুদ্ধের পুরোটা সময় জুড়ে বাঙালী সব ধর্মের নারীদের উপর যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ আর হত্যা করা – যা ছিল সুপরিকল্পিত ও ভয়াবহ। সুজান ব্রাউন মিলার তার “Against Our Will: Men,Women, and Rape” বইতে নারী নির্যাতনকে নানজিঙ্গে জাপানীদের দ্বারা রেপ ও রাশিয়াতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মানিদের দ্বারা রেপ এর সাথে তুলনা করেছেন।
এন্থনি মাসকারেনহাস তার ” দ্য রেপ অব বাংলাদেশ ” বইএর “গনহত্যা” অধ্যায়ে লিখেছেন “সারা প্রদেশজুড়ে হত্যাকান্ডের সুব্যবস্থার নমুনার সঙ্গে জেনোসাইড বা গনহত্যা শব্দটির অভিধানিক সংজ্ঞার হুবহু মিল রয়েছে”।
মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী বিদেশী সাংবাদিকদের একাধিক লেখায় পাকিস্তানীদের গনহত্যার বিষয়টি স্থান পাওয়ায় কেঁপে উঠে বিশ্ব বিবেক। জর্জ হ্যারিসন ও পণ্ডিত রবিশংকর “কনসার্ট ফর বাংলাদেশ” এর আয়োজন করেন। ফরাসী দার্শনিক আঁদ্রে মালরোর নেতৃত্বে গঠিত হয় ” আন্তর্জাতিক ব্রিগেড”।
বাংলাদেশে পাকিস্তানীদের দ্বারা সংঘটিত গনহত্যা ব্যাপক ও নিষ্ঠুরতার দলিল হিসেবে আজও বিশ্ব বিবেককে নাড়া দেয়। পাকিস্তানীদের আক্রমণ ও হত্যাকান্ড ফ্যাসিবাদীদের মত। তাই তারা পোষন করেছিল জাতী বা ধর্ম সম্প্রদায় বিদ্বেষ ; হত্যা করেছিল নিরীহ নিরাপরাধ জনসাধারণকে।
২৫শে মার্চ “জাতীয় গনহত্যা দিবস” হলো পৃথিবীর মানুষদের নির্মমভাবে হত্যার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বলিষ্ঠ কন্ঠ এবং এইরকম নৃসংশ হত্যাকাডের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভবিষ্যত প্রজন্মের একমাত্র ভরষার দিন। আশা করি এই মহান দিবসের চেতনা গনহত্যার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সহ পৃথিবীজুড়ে সকল বিবেকবান মানুষকে ঐক্যব্দধ করবে এবং ২৫শে মার্চ বিশ্বের দরবারে জাতীয় গনহত্যা দিবস হিসেবে মর্যাদা লাভ করবে।
লেখক: নীলুফা আলমগীর, কবি ও লেখক। ক্যালগেরি, কানাডা।
প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ২৩ মার্চ ২০২১ /এমএম






