প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: একটি বিষয় ইদানীং খুব খেয়াল করছি- নারী দিবসের দিনটিতে পৃথিবীজুড়ে মেয়েদের খুব আদর-যত্ন করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি আমাদের পরিবারগুলোতেও আজকাল নারীদের জন্য উপহার-উপঢৌকন পৌঁছে যায়। এছাড়া কর্মক্ষেত্রগুলোয়ও নারীদের জন্য খাতির-যত্নের পাশাপাশি নানা আয়োজন করা হয়। নারী দিবসকে কেন্দ্র করে আমাদের ফ্যাশন হাউজগুলোও জিন্স থেকে জামদানি- সর্বত্র বিশেষ ছাড়ের উদ্যোগ নেয়।
এমনিতে বছরজুড়ে নারী-অধিকার নিয়ে যেসব কর্মী গলা ফাটায়, তাদের এ সমাজে তেমন কেউ পাত্তা দেয় না। নারী অধিকারের প্রশ্ন তুলে যখনই তা আদায়ের লক্ষ্যে কর্মীরা আওয়াজ ওঠায়, তখন আমাদের ঘর থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত কেমন যেন নির্লিপ্ত হয়ে যায়! দাবি-দাওয়ার আওয়াজগুলো তাদের এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়। তবে ৮ মার্চ এলেই যেন নারীদের জয়জয়কার।
এদিন নারীদের অধিকার এমনভাবে সবাই অনুভব করতে শুরু করেন যে, সারা বছর আর তা মনে রাখার প্রয়োজন হয় না হয়তো। একমাত্র সেদিনই স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়- ‘নারী দিবস দিচ্ছে ডাক, পুরুষতন্ত্র নিপাত যাক।’ এসব স্লোগান আর অধিকার সংবলিত বক্তৃতা শুনে ‘সুখের ঘুম’ ঘুমায় নারীরা; আর পরদিন সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় টিপ্পনি কাটা বক্তব্য।
রাত পোহালে একদল পুরুষতন্ত্রের পূজারি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে পাড়ার বাড়িঘরের দেয়ালে লিখে যাবেন তাদের আকুতি- ‘নারীদের জন্য দিবস কেন পালন করতে হবে শুনি? সারাদিন সংসার, সমাজ, সংস্কৃতি কিংবা দেশের জন্য ছেলেরাই তো খেটে মরে। নারীদের দ্বারা উলটো কত ছেলে নির্যাতিত। শুধু লোকলজ্জার ভয়ে নীরবে সব মেনে বেঁচে আছে তারা। কই! পুরুষদের কথা তো কেউ ভাবে না?
পুরুষদের জন্য তো কোনো দিবসের চিন্তা আসে না?’ আমার কাছে মনে হয়- নারী দিবস আজকাল উৎসবমুখর; এটাই পুরুষের আক্ষেপের কারণ। তারা এ দিনের প্রাসঙ্গিকতা জানেও না এবং উৎসবের কাছে এ দিবসের প্রাসঙ্গিকতা ম্লান হয়ে যায় বলেই তারা এমন একটি উৎসবমুখর পুরুষ দিবস চায়। নারী দিবসে যেখানে হীরে-জহরতের বাজারে ছাড়ের উৎসব শুরু হয়ে যায়; সেখানে কেন হবে না একটি পুরুষ দিবসের জন্য আক্ষেপ!
নারী দিবসের ইতিহাস জানে না আজকালকার নারীরাও। অদ্ভুতভাবে দেখি- শাড়ি, চুড়ি আর রঙবেরঙের পোশাকে নিজেদের জড়িয়ে তারা নারী দিবস উদযাপন করে। মনের খেয়ালে দু-একজন নারী সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করেছি নারী দিবসের তাৎপর্যের কথা। না, তারা শুধু জানে নারীদের গুরুত্ব বাড়াতে একটা বিশেষ দিন হলো নারী দিবস। তাই ইতিহাসটা একটু আওড়ে আসি; শেকড়ের কথাটি হলো- শ্রমিক নারীর কাজের সময়, ছুটি, সম্মানজনক বেতনের দাবিতে আন্দোলন থেকেই এ দিবসের জন্ম।
১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ, আমেরিকার বস্ত্রশিল্পের নারী শ্রমিকদের কাজের সময় কমানো ও মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে লড়াই-আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলন পশ্চিমা দুনিয়ায় আলোড়ন তোলে। পরবর্তীকালে যুক্ত হয় নারীদের ভোটাধিকারের দাবি। এসব দাবি আদায়ের উদ্দেশ্যে ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। সেখানে ৮ মার্চ নারী দিবস পালনের ডাক দেওয়া হয় এবং ১৯১১ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তা পালন শুরুও হয়। তারপর থেকে কালক্রমে বাংলাদেশ তথা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকে মেয়েদের অর্থনৈতিক, সামাজিক অধিকারের দাবিতে নারী দিবস পালন শুরু হয়।
হ্যাঁ, এ কথা স্বীকার করতে হবে- প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশে নারীদের জন্য আজ অনেক সম্মান ও ইতিবাচক খবর আছে। আমাদের রাষ্ট্রীয় উন্নয়নযাত্রা যার হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে, তিনি নারী; আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। আমাদের জাতীয় সংসদের স্পিকার হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন নারীনেত্রী ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।
সম্প্রতি আমাদের দেশে প্রশাসন, পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় গুরুদায়িত্বে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। আগের তুলনায় নারীরা এখন অনেকাংশে এগিয়ে গেছে এবং অবশ্যই নারীরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে নিজের যোগ্যতায়, স্বমহিমায়। সারা পৃথিবীর বুকে নারী নেতৃত্বের এক অনন্য উদাহরণ আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা।
তবুও কথা তো থেকেই যায়। মুষ্টিমেয় নারীর মুক্তির দিকে তাকিয়ে আমরা যখন অধিকারের দাবি-দাওয়ার কথা ভুলে যাই, তখন ৮ মার্চ তার তাৎপর্য হারায়। এখনো নারীরা নিগৃহীত হয়, নির্যাতিত হয়, হয়ে থাকে কোণঠাসা। রাষ্ট্র তথা বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো যে ছোঁ মেরে ৮ মার্চকে উৎসবের রূপ দিয়ে দিল, তার পেছনেও একটি নীলনকশার ছোটগল্প আছে। নারী দিবস যেহেতু পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে, নারী দিবস যেহেতু নারী-পুরুষের সমতার পক্ষে, নির্দিষ্টভাবে ধনতান্ত্রিক পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে ধারালো আন্দোলন গড়ে তোলার দিন হিসাবে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছিল; তাই রাষ্ট্র ও করপোরেট দুনিয়া একীভূতভাবে দিনটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য আন্দোলনের পথ থেকে এ দিনটিকে সরিয়ে এনে একটি উৎসবে রূপ দেওয়ার পাঁয়তারা শুরু করে দিল। সুপরিকল্পিতভাবে নারী মুক্তির আন্দোলনটিকে সরাসরি দমনের পথে না গিয়ে ওই একটি দিন নারীদের উপলক্ষ্য করে উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে নারীদেরও খুশি করা হলো, দিবস পালনের রূপরেখাও বদলে গেল। একেই বলে করপোরেট প্ল্যানিং; যাতে রাষ্ট্র সহযোগিতার দুয়ার খুলে দিল।
যে নারীকে রোজ ভোরে উঠে বাচ্চাকে স্কুলের জন্য তৈরি করতে হয়, ঘুমের ঘোরে থাকা স্বামীর বিছানায় ধোঁয়া ওঠা চা হাতে নিয়ে হাজিরা দিতে হয়, সকাল থেকে দুপুরের রান্না সেরে দৌড়াতে দৌড়াতে কাজের ঠিকানায় পৌঁছতে হয়, আবার দু’দশ মিনিট দেরি হলেই অফিসের কর্তাব্যক্তির কাছে শুনতে হয়- ‘নারী কর্মীদের দ্বারা কিচ্ছু হয় না।’ এভাবে নানা কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা করে অফিসের সব কাজ সামলাতে হয়, আবার বাড়ি ফিরেই ফের রান্নাঘরের চুলায় আগুন জ্বেলে খাবার তৈরির নামে নিজের জীবনের সুখ-স্বপ্ন পুরাতে হয়; সেই নারী যখন ৮ মার্চ সকালে দেখেন- উৎসবী আমেজে তিনি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছেন কেবল নারী হওয়ার জন্যই, তখন তার চোখেও সত্যের পিঠে মিথ্যার প্রলেপ দেওয়া ধোঁয়াশার ঘোর লাগে বৈকি! আর এ ঘোর নিয়েই তার প্রতিটি নারী দিবস কাটে; কিন্তু প্রকৃত মুক্তি তার কখনই মিলে না। শুধু রাষ্ট্র ও করপোরেট শিল্পের কৌশলের কাছে মাথা নত করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে হয়।
নারীবাদী চিন্তার হিসাব অনুযায়ী, পিতৃতন্ত্রে পুরুষও বঞ্চিত হয়; পুরুষকেও অনিচ্ছা সত্ত্বে অনেক দায়ভার গ্রহণ করতে হয়। পিতৃ-মাতৃবিয়োগে ছেলেরা প্রাণ খুলে কাঁদতে পারেন না, স্ত্রীকে সংসারের কাজে সাহায্য করলে তাদের ‘স্ত্রৈণ’ বলে খাটো করা হয় এ সমাজেই। কোনো ছেলে চাইলেই যে সে তার নারী সঙ্গীর যোগ্য বন্ধু হয়ে উঠবে, সে সুযোগ নেই। সমাজ তখন তাকেও নানান ছলে খাটো করে কটূক্তি করবে।
নারীবাদ পুরুষকেও এ সীমাবদ্ধতা থেকে থেকে মুক্তি দিতে চায়। নারীবাদ সমাজ-নির্মিত পুরুষতন্ত্র ধারণার বিরুদ্ধে সক্রিয়। আর একই কারণে নারী দিবস পুরুষতন্ত্রের নির্মমতা আর নিচু চিন্তাশীলতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার দিন, পুরুষের বিরুদ্ধে নয়। নারী দিবস শুধু নারীর অধিকার নিয়ে আওয়াজ তোলার দিন নয়, পুরুষতন্ত্র ভেঙে সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার আওয়াজ তোলার দিন। নারী দিবস শুধু নারীদের জন্য নয়, নারী দিবস মানে সাম্যের পক্ষে দাঁড়ানো প্রতিটি প্রাণের দাবি তোলার দিবস।
আগামীর পৃথিবী শুধু নারীদের না হোক, আগামীর পৃথিবী শুধু পুরুষের না হোক; আগামী পৃথিবী হোক সাম্যের, সৌন্দর্যের আর মুক্তির। মুক্তচিন্তার জলস্রোতে ধুয়ে যাক নারীর প্রতি সমাজের সব বঞ্চনা আর অবিচার। পুরুষতন্ত্রের শিকার হয়ে নারীর কোণঠাসা-বন্দিদশা কেটে প্রকৃত মুক্তির সন্ধান মিলুক- এটাই এবারের নারী দিবসের ঐকান্তিক চাওয়া।
আমরা বিশ্বাস করি, ‘নারীরা আলোর মিছিল। নারী-পুরুষ সমতায় পৃথিবী হবে সুন্দর, পৃথিবীর প্রতিটি কোনায় তখন সভ্যতার আলো পৌঁছাবে।’
রেবেকা সুলতানা : অনারারি নির্বাহী পরিচালক, অন্যচিত্র উন্নয়ন সংস্থা
প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ৯ মার্চ ২০২১ /এমএম





