Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হবে। স্বাধীনতার এত বছর পর আমাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব মিলাতে গিয়ে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে ঈর্ষণীয় হারে। ১৯৭১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আমাদের অর্জন বিস্ময়কর।

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন সার্কভুক্ত দেশের মাঝে দ্বিতীয় এবং বিশ্বে ৪১তম। অর্থনীতির এ উন্নয়নের গতি যদি ধরে রাখা যায়, তাহলে ২০৩৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে।বাংলাদেশের শুরুটা এমন ছিল না। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ দেশের জন্ম। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে ছিল পরনির্ভর ও ঋণনির্ভরশীল দেশ।

শূন্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে উন্নয়নের কৌশল পরিবর্তন ও বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশ আজকের এ অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। স্বাধীনতার ঠিক পর যেখানে মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ১২৯ মার্কিন ডলার, বর্তমানে তা বেড়ে ২০৭৯ ডলারে দাঁড়িয়েছে।এ উন্নতি হঠাৎ করেই অর্জিত হয়নি। যুদ্ধবিধ্বস্ত সেই নড়বড়ে অবস্থা থেকে এ দেশকে গড়ে তুলতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল এ দেশকে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলা।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি যে মুক্তির সংগ্রামের কথা বলেছিলেন; সেই মুক্তি শুধু শত্রুর কবল থেকে দেশকে মুক্ত করা নয়। সে মুক্তি ছিল, এ দেশের মানুষের দারিদ্র্য ও ক্ষুধা থেকে মুক্তি, অশিক্ষা ও কুসংস্কার থেকে মুক্তি; সামাজিক বৈষম্য থেকে মুক্তি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার অঙ্গীকার ছিল-মানুষ তিনবেলা খাবার পাবে, সবার থাকার ঘর হবে, সুচিকিৎসা নিশ্চিত হবে। শিক্ষার আলো পাবে, কর্মসংস্থান হবে, মানুষের মানবিক মর্যাদা রক্ষা পাবে। সর্বোপরি এ দেশে আইনের শাসন ও মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হবে।

বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পিছিয়ে থাকলেও বাংলাদেশ তার অঙ্গীকার পূরণের পথেই এগিয়ে চলেছে। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, মানুষের গড় আয়ু, শিল্পকারখানা, আমদানি, রপ্তানি, রিজার্ভ, ডলারের মান, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, মাথাপিছু আয় এবং সামাজিক অনেক সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে; এমনকি ভারতের চেয়েও অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে।

কৃষি খাতে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। খাদ্য উৎপাদনে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানে পৌঁছাতে বাংলাদেশের কৃষক প্রভূত সাফল্য দেখিয়েছে। ১৯৭২-৭৩ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ যেখানে ৯৯ দশমিক ৩০ লাখ টন ছিল, বর্তমানে সেই উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫১ কোটি টনে।

আয়তনে বিশ্বের ৯৪তম দেশ হলেও সবজি উৎপাদনে তৃতীয় এবং মৎস্য উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। দেশে শিক্ষাব্যবস্থায়ও আমূল পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে শতভাগ ছাত্রছাত্রীর মাঝে বিনামূল্যে বই বিতরণ কর্মসূচি এক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছে।১৯৯০ সালে বিদ্যালয়ের শিশু ভর্তির হার ছিল ৬১ শতাংশ, বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৯৭.৭ শতাংশে। বিশেষ করে নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করার পদক্ষেপ দেশে শিক্ষাবিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

বিশ্বের অন্য অনগ্রসর দেশগুলো যেখানে শিক্ষায় ছেলেমেয়ের সমতা অর্জনে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে আমাদের দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই স্তরেই মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে সমতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে।প্রাথমিকে ছাত্রীদের হার প্রায় ৫১ শতাংশ এবং মাধ্যমিকে প্রায় ৫৪ শতাংশ। এ হার বিশ্বে নজর কেড়েছে। আশার বিষয়-এখন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও ছাত্রীদের অংশগ্রহণ ক্রমাগত বাড়ছে।

নারী শিক্ষা কেবল নারীদের জন্য জীবিকা অর্জনে সুযোগ সৃষ্টি করেনি, বরং লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। স্বাধীনতার পরপর আমাদের সাক্ষরতার হার ছিল ১৬.৮ শতাংশ, এখন সেই হার পৌঁছেছে ৬১ শতাংশে।স্বাস্থ্য বিষয়েও আমাদের অর্জন প্রশংসনীয়। স্বাধীনতার ঠিক পরই মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৬ বছর, এখন মানুষের গড় আয়ু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২.৬ বছর।

যেখানে ভারতের গড় হচ্ছে ৬৫ বছর। শিশুমৃত্যুর হারে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় এগিয়ে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর শিশুমৃত্যর হার যেখানে হাজারে ৫২ জন, সেখানে বাংলাদেশে ৩৫ জন।উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে বিশেষ করে পোশাকশিল্পে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে।

তাছাড়া পরিকাঠামোগত, আবাসন, ওষুধশিল্প, জাহাজ নির্মাণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যসামগ্রী ও আইটি সেক্টরে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বের আগ্রহের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।স্বাধীনতার পরপর দেশ গড়ার কাজ শুরু হলেও গণতান্ত্রিক চর্চার সঙ্গে সঙ্গে দেশের উন্নয়নের চাকাটিও যেন গতিশীল হয়েছে।এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ ১৯৯০ দশকের সার্বিক প্রবৃদ্ধিতে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের গড় হারের তুলনায় অনেক এগিয়ে আছে।

স্বাধীনতার বছর দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ যখন দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত, এমনকি ১৯৯০ দশকেও বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার যেখানে ছিল ৫৭ শতাংশ, আর এখন হচ্ছে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশেরও নিচে।বাংলদেশের এ অগ্রগতির ধারাকে অব্যাহত রাখতে হলে চাই সম্পদের সুষম বণ্টন ও মানবসম্পদের উন্নয়ন। আমাদের বিপুল কর্মক্ষম জনশক্তিই সার্বিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি।

কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এ জনসম্পদের প্রতি যতটুকু যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন ছিল, অনেক ক্ষেত্রেই আমরা তা নিশ্চিত করতে পারছি না। যতই দিন যাচ্ছে, ততই যেন ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বেড়েই চলেছে।যে বৈষম্য দূর করার অঙ্গীকার নিয়েই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। স্বাধীনতার পর ধনী-দরিদ্রের সম্পদের বৈষম্য যেখানে ২.৪ ছিল, বর্তমানে তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।

ফলে মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা এবং সমাজে বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, বর্তমানে আমাদের সমাজে একশ্রেণির বিত্তশালী ও ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যার প্রভাব সুদূরপ্রসারি।

আমাদের দেশে, দুর্নীতি ও অর্থসম্পদ লুণ্ঠনের অনৈতিক যে ধারা চালু হয়েছে, তা দেশের উন্নয়নের জন্য হুমকিস্বরূপ। নৈতিকতা-মূল্যবোধ-সততা ও আদর্শহীন কিছু মানুষের ক্ষমতা এবং বিত্তের প্রতি লোভ দেশের অগ্রযাত্রাকে করছে ব্যাহত।

ইতোমধ্যে একশ্রেণির মানুষ দেশের যে সম্পদ লুট করেছে এবং যে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে পাচার করে দিয়েছে, তা যদি বন্ধ করা যেত, তাহলে বাংলাদেশ আরও বেশি এগিয়ে যেতে পারত।মানবিক সূচকে পিছিয়ে থেকে শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন দিয়ে একটা দেশের সার্বিক অগ্রগতির সাফল্য দাবি করা যায় না।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি মানবিক মর্যাদা, আইনি সহায়তা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করা গেলে দেশের মানুষ স্বাধীনতার পূর্ণস্বাদ গ্রহণ করতে পারবে।একটা কথা মনে রাখতে হবে-বহু নির্যাতন সহ্য করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যই ছিল জনগণ, সমাজ ও রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নতি করা। আমার বিশ্বাস-বাংলাদেশ সে লক্ষ্য পূরণেই সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ৭ মার্চ ২০২১ /এমএম