প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী ২৭৩টি করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা চললেও মাত্র ১২টি তৃতীয় ধাপ অতিক্রম করতে পেরেছে। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি ৭০ থেকে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে একটি ভ্যাকসিন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বাকি চারটি ভ্যাকসিন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বা সরকার তাদের জনগণের ওপর প্রয়োগের অনুমতি দিয়েছে।
মোট এই পাঁচটি ভ্যাকসিন হলো- যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির যৌথ উদ্যোগে তৈরি ফাইজার বায়োএনটেক, যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না, চীনের সিনোভ্যাক, রাশিয়ার স্পুটনিক ফাইভ এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন। বাংলাদেশে অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করা হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কয়েকদিন আগেই ঘোষণা দিয়েছে, কোনো ভ্যাকসিন মানবদেহে যদি ৫০ শতাংশের বেশি কার্যকর হয় তবে তা অনুমোদন পাওয়ার যোগ্য। একটি ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা বলতে বোঝায় ভ্যাকসিনটি মানবদেহকে কতটা সুরক্ষা দিতে পারে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নির্ভর করে কত লোকের ওপর ট্রায়াল করা হয়েছে তার ওপর।
এ পরীক্ষার সময় বিশেষ করে যাদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত মানুষ এবং গর্ভবতী মহিলাদের বাদ দেওয়া হয়। এ বিবেচনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনটি বিশ্বব্যাপী প্রয়োগের অনুমতি দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) মতে, মানবদেহে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন কয়েকটি স্তরে সুরক্ষা দেয়; বিশেষ করে টিকা দেওয়ার পর মানবদেহে টি-লিম্ফোসাইট এবং বি-লিম্ফোসাইট বাড়াতে সাহায্য করে। লিম্ফোসাইটের কাজ হলো শরীরে পর্যাপ্ত অ্যান্টিবডি তৈরি করা আর এ অ্যান্টিবডি করোনাভাইরাসের জীবাণুর সঙ্গে লড়াই করতে মানবদেহকে ঢাল হিসাবে সাহায্য করে।
দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি করে ইমিউনিটি বা রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে যে জৈব-রাসায়নিক মিশ্রণ, তাকে ভ্যাকসিন বা টিকা বলে। এ প্রতিষেধক জৈব পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়। কোনো সংক্রামক ব্যাধির জীবাণু (ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া) দেহে প্রবেশ করলে শরীরের প্রাকৃতিক রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা তাকে অ্যান্টিজেন বা বহিরাগত হিসাবে চিহ্নিত করে। এ অ্যান্টিজেনকে ধ্বংস করার জন্য দেহের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ‘ইমিউন সিস্টেম’ অ্যান্টিবডি তৈরি করা শুরু করে। অ্যান্টিবডি জীবাণুকে ধ্বংস করতে সাহায্য করে।
প্রতিটি মেডিসিনের কোনো না কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইটেও করোনা ভ্যাকসিনের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই সামান্য। সংখ্যার বিচারে যা প্রতি ১০ জনের একজন বলে প্রমাণিত হয়েছে। সাধারণত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো হলো শরীরের যে স্থানে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়, সেই স্থান একটু ফুলে যাওয়া বা লাল হওয়া বা সামান্য ব্যথা অনুভূত হওয়া, মাংসপেশি বা অস্থিসন্ধিতে ব্যথা অথবা জ্বর আসা, মাথাব্যথা বা শীতল অনুভূতি। শরীরে ভ্যাকসিন কার্যকর হতে মোটামুটি এক সপ্তাহ সময় লাগে।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল থেকে প্রাপ্ত তথ্যে অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনটির এখন পর্যন্ত মারাত্মক কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা জানা যায়নি। তবে টিকা নেওয়ার পর যে কোনো সমস্যা হলে অবশ্যই দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে যেতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কোভিড-১৯ পরীক্ষার রিপোর্ট নেগেটিভ আসার ২৮ দিন পর টিকা দেওয়া যাবে। যেমন আমার পরিবারে পাঁচজন টিকা গ্রহণ করলেও একজনের শুধু জ্বর এসেছে আর সবাই ভালো আছে, যদিও যার জ্বর এসেছিল তিনি এখন একদম সুস্থ-স্বাভাবিক রয়েছেন।
অনেককেই দেখেছি টিকা নিতে আগ্রহী নন। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট তৈরি টিকার ব্যাপারে কারও কারও আপত্তি রয়েছে, আবার অনেকের মধ্যে আস্থাহীনতাও লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু তারা জানেন না, তাদের অতি আদরের সন্তানদের জন্মের পর থেকে যত টিকা দেওয়া হয়েছে, তার অধিকাংশই বাজারজাত করছে সেরাম ইনস্টিটিউট। সেরাম ইনস্টিটিউট করোনাভাইরাসের টিকা ছাড়াও অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন রোগের টিকা উৎপাদন করছে।
বিশেষ করে এর উৎপাদিত টিকাগুলোর মধ্যে যক্ষ্মার জন্য টিউবারভ্যাক টিকা (বিসিজি), পোলিওর জন্য পোলিওভ্যাক টিকাসহ বিভিন্ন টিকা বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী শিশুদের দেওয়া হয়ে থাকে এবং এগুলো বিশ্বের সর্বত্র রফতানি করা হয়। ল্যানসেট গবেষণায় দেখা গেছে, একমাত্র যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনটি, যেটি সেরাম ইনস্টিটিউট তৈরি করছে, সেটি মানবদেহে যে কোনো বয়সেই সমানভাবে কার্যকর।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, এ পর্যন্ত ২৫টি রোগের টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব রোগের মধ্যে রয়েছে কলেরা, প্লেগ, অ্যানথ্র্যাক্স, হাম, রুবেলা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডিপথেরিয়া, মাম্পস, ধনুষ্টংকার, হেপাটাইটিস এ ও বি, যক্ষ্মা, টাইফয়েড, পোলিও, জলাতঙ্ক, সর্বশেষ করোনাভাইরাস। প্রতিটি রোগের টিকা আবিষ্কারের ইতিহাস আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। কিন্তু মহামারি ও মড়কের হাত থেকে বাঁচার জন্য টিকার যে বিকল্প নেই, এ কথা মানা ছাড়া উপায় নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি বছর টিকার মাধ্যমে আড়াই মিলিয়ন মৃত্যু প্রতিরোধ হয়। এখনো বহু রোগের টিকা আবিষ্কার করতে পারছেন না বিজ্ঞানীরা। এর মধ্যে হেপাটাইটিস ও ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা নতুনভাবে সংযুক্ত এবং বর্তমানে শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ হিসাবে বিবেচিত নিউমোনিয়া রোগ-প্রতিরোধে নতুন টিকা (পিসিভি) খুব শিগ্গির টিকাদান কর্মসূচিতে যুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। জিকা ভাইরাসের সংক্রমণের তিয়াত্তর বছর হতে চলল, এখনো এর টিকা উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি। সার্স, মার্স বা এইডসের মতো ঘাতক ব্যাধির টিকা এখনো অধরাই রয়ে গেছে।
বর্তমান সরকারের নির্দেশনা অনুসারে ১৮ বছরের বেশি বয়সী সব নাগরিক করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন গ্রহণ করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে অগ্রাধিকার তালিকায় থাকার প্রয়োজন নেই। পরিশেষে বলতে পারি, ফ্রন্ট লাইনার হিসাবে টিকা গ্রহণ করেছি; তাই কোনো সংশয় নয়, অবিশ্বাস নয়, আসুন অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করে ভ্যাকসিন গ্রহণ করি। গুজবে কান দেবেন না। মহামারি করোনাকে পরাজিত করে আমরা একসঙ্গে অনেকদিন বাঁচতে চাই।
ডা. আইরিন ফেরদৌস : চিকিৎসক, বিসিএস স্বাস্থ্য
প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ /এমএম





