প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুজিববর্ষ ঘোষিত হয়েছে। কমরানা ভাইরাসের মহামারীর কারণে গ্রহণ করা কর্মসূচিগুলো ২০২১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত যথাযথভাবে করতে পারা যাবে না বলে মুজিববর্ষের মেয়াদ বর্ধিত করা হয়েছে। এই সময় একুশের চেতনা ভিন্নতর তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছে।
আমরা জানি, ১৯৪৭ সালের মধ্যরাত্রির স্বাধীনতার নেতিবাচক ফল, উন্মীলিত অস্তিত্বের সর্বগ্রাসী আর্তনাদ এবং ভিন্ন ভিন্ন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পালিয়ে আসা অসংখ্য পরিবারের অশ্রু দিয়ে মোড়া আমাদের এই ভ‚খণ্ডের মানুষের প্রাথমিক সংগ্রামের সূচনা। পারিবারিক পরিমণ্ডল থেকে রাজপথে সংঘটিত রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ মধ্যবিত্তকে নিজের বৃত্তের বাইরে নিয়ে এলো ভাষার প্রশ্নে।
তখনকার রাজনৈতিক ঘটনা তরঙ্গিত আবর্তের যোগফলে দ্বান্দ্বিক-অন্তর্ময় সম্পর্কসূত্র নিরূপিত মানবাকাক্সক্ষার অমৃতই একুশের চেতনা। ১৯৪৭-এর ভারত-বিভাগ থেকে শুরু করে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সময়পরিসরকে পটভ‚মি হিসেবে গ্রহণ করলে দেখা যায় জাতির সমাজ-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সমস্যা এবং সেই সমস্যার আবর্তে ঘূর্ণিত ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত ব্যক্তি ও সামষ্টিক জীবনের অন্তরঙ্গ ছবি ভাষা-আন্দোলনের মৌল অনুষঙ্গ।
প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৭-১৯৫৮ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত সময়ের কালানুক্রমিক ইতিহাস বাঙালির জীবনাভিজ্ঞতার রক্তাক্ত অধ্যায়। একদিকে ব্রিটিশ রাজশক্তির সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের বিষবৃক্ষ ভারতবিভাগ, অন্যদিকে দেশবিভাগের ফলস্বরূপ বাংলাভাষী অধ্যুষিত পূর্বাঞ্চলের পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্তি- এই রাজনৈতিক মীমাংসা অবিভক্ত বাংলার পূর্বাঞ্চলের মধ্যবিত্তশ্রেণির জন্য ছিল অসঙ্গত, ঐতিহাসিক ধারার পরিপন্থী একটি সিদ্ধান্ত।
কি অর্থনৈতিক, কি রাজনৈকি-সামাজিক কোনো দিক থেকে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব-পাকিস্তানের সমকক্ষ ছিল না। এজন্য পশ্চিম পাকিস্তানের ধূর্ত শাসকগোষ্ঠী এবং আধুনিক শিক্ষাবিবর্জিত সামন্ত-মূল্যবোধ ও অর্থনৈতিক বিন্যাসের সুযোগ প্রাপ্ত ঢাকার নবাব পরিবার ও তাদের কতিপয় অনুসারী পূর্ববাংলাকে গড়ে তুলতে চাইলো আধা-ঔপনিবেশিক ও আধা-সামন্তবাদী সমাজরূপে।
কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং কর্মসূচি ছিল বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আশা-আকাক্সক্ষার পরিপন্থী। এদেশের মৃত্তিকা সংলগ্ন জীবন, সমাজবিন্যাস এবং আর্থ-উৎপাদন কাঠামো সম্পর্কে অজ্ঞতার ফলে পাকিস্তানি শাসকবর্গ-ধর্মকে স্থাপন করল সবকিছুর কেন্দ্রস্থলে।
ফলে পূর্ব বাংলার ভূ-খণ্ডে দু’শ্রেণির মধ্যবিত্ত চরিত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটল, একশ্রেণি সামন্ত মূল্যবোধ আশ্রয়ী ধর্মীয় ঐক্যের মানদণ্ডে স্বাগত জানাল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠানকে; অন্যদিকে বাংলাদেশের শিক্ষিত প্রগতিশীল মধ্যবিত্ত শ্রেণি প্রত্যাখ্যান করল ধর্মকেন্দ্রিক, পাকিস্তানি শাসকবর্গের জাতিশোষণ, শ্রেণিশোষণ ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসী মনোভাবকে। পাকিস্তানে জন্মলগ্নেই মোহভঙ্গের ফলে ঢাকা নগর কেন্দ্রিক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত প্রথম প্রতিবাদ করল ১৯৪৮-এ।
অন্যদিকে ১৯৪৭-১৯৫১ সময় প্রবাহে পাকিস্তান শাসিত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ঘটে একাধিক ঘটনা। বিভাগোত্তরকালে সা¤প্রদায়িক বাটোয়ার ভিত্তিতে বহুসংখ্যক মুসলিম বাস্তুচ্যুত পরিবারের পূর্বাঞ্চলের আগমন এবং পরবর্তী সময়ের প্রাকৃতিক দুর্যোগ জনজীবনকে করে তুলে দুর্বিষহ। পাকিস্তান সরকারের ভ্রান্ত খাদ্যনীতির ফলে কর্ডন ও লেভির অত্যাচারও বৃদ্ধি পেতে থাকে ক্রমাগত।
ফলে জনগণের সামগ্রিক অর্থনৈতিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। জনগণের খাদ্যসঙ্কট ও পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকারের গণবিরোধী চরিত্র কৃষক জনতার ভেতর আন্দোলনের সম্ভাবনা অনিবার্য করে তোলে। সিলেটে জমিদারি নানকার প্রথাবিরোধী আন্দোলন (১৯৪৮-৫০), ময়মনসিংহ জেলায় জমিদারি ও টঙ্ক প্রথাবিরোধী আন্দোলন (১৯৪৯-৫০), নাচোলের কৃষক বিদ্রোহ (১৯৫০) আন্দোলন ও তার পরিণাম এবং তৎকালীন সরকারি প্রশাসন যন্ত্রের দমননীতির বর্বরতা নৃশংসতা এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বাংলাদেশের বিকাশমান মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামশীল করে তোলে।
১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ভাষা আন্দোলনের সাময়িক সাফল্যের পর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বিচিত্র প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির ক্রমশ পরিবর্তন ঘটতে থাকে।’ এই পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে বাঙালি পুঁজিপতি ও মধ্যবিত্তশ্রেণির স্বার্থ-রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান ‘আওয়ামী মুসলিম লীগের’ জন্ম হয়।
প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্ব এবং কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে সংগ্রামের উদ্দেশ্য নিয়ে আওয়ামী লীগ গঠিত হলেও এই সংগঠনের কার্যক্রম ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক দ্বন্দ্বের কারণ হয়ে ওঠে। এ সময় বিভাগোত্তরকালের কমিউনিস্ট পার্টির একমাত্র প্রগতিশীল সাহিত্য সংগঠন ‘প্রগতি লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘ’ ক্রমশই কমিউনিস্ট বিপ্লবের দ্বিধাবিভক্ত ও তাত্ত্বিক বিতর্কের ফলে ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা জেলায় এর অস্তিত্ব একেবারে বিলুপ্ত হয়। রবীন্দ্রসাহিত্য নিয়ে বিতর্ক, কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে তাত্ত্বিক বিরোধ, মুসলিম লীগ সরকারের প্রচণ্ড দমননীতি-প্রধানত এইসব কারণে ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা জেলা প্রগতি লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের অস্তিত্ব একেবারে বিলুপ্ত হয়।
কেন্দ্রীয় সরকারের অবদমন নীতি ও বাংলাদেশকে পাকিস্তানের নব্য-কলোনিতে পরিণত করার চক্রান্তে এবং রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে যে গভীর ষড়যন্ত্র ও বিতর্ক উত্থাপিত হয়, এরই ফলে সংঘটিত হয় ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৮-১৯৫২ এই কালক্রমিক ঘটনাপ্রবাহে রাষ্ট্রষন্ত্রের প্রচণ্ড দমন, নির্যাতন ও গ্রেফতার সত্তে¡ও ২১ ফেব্রুয়ারির রক্তদানের প্রতিক্রিয়ায় বৃহত্তর জনজীবনে পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তীব্র রূপ ধারণ করে।
কারণ এই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে কেবল ভাষা আর সংস্কৃতির প্রশ্নই জড়িত ছিল না: এর মূল নিহিত ছিল বাঙালির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের গভীরে। দেশ-বিভাগোত্তর কেন্দ্রীয় প্রশাসনের রাজনৈতিক কূটজাল, অত্যাচার, নিপীড়ন, ধর্মীয় কলহ ও দুর্নীতির ভয়াবহ বিস্তারের বিরুদ্ধে বাঙালির ঐক্য ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় লাভ অনিবার্য করে তোলে।
কিন্তু যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা গঠিত হলেও কেন্দ্রীয় প্রশাসনের চক্রান্তে বাংলাদেশের খাদ্যপরিস্থিতির অবনতি ও বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে দাঙ্গার সৃষ্টি করে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতনের পটভ‚মি তৈরি করা হয়। ১৯৫৪ সালে মে মাসে বাতিল করা হয় যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা। এটা ছিল বাংলাদেশের সামন্ত প্রথাভিত্তিক গণতন্ত্রের ওপর পুঁজিবাদের প্রথম আঘাত, কিন্তু মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করলেও ১৯৫৯-এর পূর্বে পুঁজিবাদ এখানে জয়যুক্ত হতে পারেনি।
১৯৫৮ সালের সামরিক অভ্যুত্থান হলো সামন্ত প্রথাভিত্তিক গণতন্ত্রের ওপর শেষ ও চরম আঘাত। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার পতনের পর ১৯৫৮ সালের আগস্ট পর্যন্ত কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক ষড়যন্ত্রের ফলস্বরূপ বারবার মন্ত্রিসভার পতন সুগম করে দেয় পাকিস্তান সামরিক জান্তার ক্ষমতা দখলের পথ।
বস্তুত দেশ-বিভাগ থেকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এবং ভাষা আন্দোলন পরবর্তী পাঁচ বছর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ দ্ব›দ্ব-জটিল হলেও এর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলটি ছিল সকল বিকৃতি, কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতা এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও স¤প্রদায়গত সকল প্রকার বৈরীভাবের বিরুদ্ধে মানবতার আদর্শকে রাষ্ট্র ও সমাজজীবনের সকল ক্ষেত্রে মহিমাদীপ্ত করার কাল।
এদিক থেকে ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কাগমারীতে পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের আন্তর্জাতিক মানের সাংস্কৃতিক সম্মেলনের কথা উল্লেখযোগ্য। রাজনীতির সঙ্গে সংস্কৃতির এই যোগসূত্র নির্মাণ ছিল খুবই তাৎপর্যবহ। যার নেতৃত্বে ছিলেন মওলানা ভাসানী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সেই অনুপ্রেরণার মহিমা আবারও প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আমরা রাজনৈতিক আত্মপরিচয়ের ভেতর সাংস্কৃতিক সম্পৃক্ততায় আস্থাশীল। একুশের চেতনা এখানেই ভাস্বর।
লেখক: অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ /এমএম





