Menu

কয়েকদিন আগে ঢাকা শহরের কলাবাগানে ইংরেজি মাধ্যমের একজন শিক্ষার্থী তার বন্ধুর বাসায় বলৎকারের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করে। প্রাথমিক ময়না তদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী মেয়েটি বিকৃত যৌনাচারের শিকার হয়েছিল বলে ধারনা করা হয়েছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণই তার মৃত্যু কারণ। ঘটনাটি বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ঘটনাটি সমগ্র জাতিকে হতবাক, মর্মাহত ও হতাশা গ্রস্ত করেছে। পুলিশ তদন্ত করছে, আশা করি কিছু দিনের মধ্যে সত্য ঘটনা উন্মোচিত হবে।

এই ঘটনা নিয়ে জনমনে নানা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অনেক আলোচনা, সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে নির্যাতিতা, অপরাধী ও তাঁদের পরিবারকে ঘিরে যা বিব্রতকর ও হতাশা ব্যঞ্জক। এটা একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। ভুক্তভোগী নির্যাতিতা পরিবারের মান-মর্যাদার বিষয়ে গণমাধ্যম, জনগণ ও সরকার প্রতেকের অধিক গুরুত্ব ও সতর্কের সাথে বিবেচনা করা উচিৎ। ‌যৌন অপরাধের (Sexual offence) ক্ষেত্রে মেয়ে বয়স যেহেতু ১৮ বছরের নিচে গনমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের (Publication ban) প্রকাশনা নিষিদ্ধ করা উচিৎ ।

নির্যাতিতা ও তার পরিবারের সকল তথ্য গোপনীয়তা মেনে চলা একটি সভ্য জাতির কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। সেটা দেশের সকল মানুষকে অনুধাবন করতে হবে।নির্যাতিতার ছবি অনলাইন তথা ইউটিউবে ভেসে বেড়াচ্ছে। এই মুহূর্তে সকলকে নির্যাতিতা পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে। সান্তনা দিতে হবে যাতে পরিবারটি এই ক্ষতির শোক কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। সবার মনে আজ একই প্রশ্ন, কেন বারবার এমন ঘটনা ঘটছে? পরিবার, সমাজ, সরকার তাদের সন্তানদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে কেন?

কিছু মানুষের ভিতরটা কতটা অমানবিক সেই চেহারাটা প্রতিদিন কোন না কোন ঘটনা থেকে উলঙ্গ হয়ে জনসম্মুখে প্রকাশ পাচ্ছে। কিছু দিন পর অন্য ঘটনা এসে এই ঘটনাটি চাপা পরে যাবে। মানুষও ভুলে যাবে। আবার কোন কোন ঘটনার পুনরাবৃত্তিও হচ্ছে। কিছু দিন আগে জনগনের চাপে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যু দন্ড করা হলেও ধর্ষণের সংখ্যা না কমে বরং বৃদ্ধি পেয়েছে।

যে বাবা মা তাঁর সন্তান হারালো, যে মেয়েটি তাঁর সম্ভ্রম হারালো, অব্যক্ত নির্মম যন্ত্রনার শিকার হয়ে এই নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে বিদায় নিলো, এখন সমাজের তথা কথিত কিছু অবিবেচক মানুষ আঙ্গুল দেখিয়ে বলছে “যত দোষ নন্দ ঘোষের” অর্থাৎ মেয়ের ও মেয়ের পিতা মাতার। এভাবে দীর্ঘদিন আমাদের সমাজে সনাতনী কুসংস্কার চলে আসছে। নারী ঘটিত যে কোন ঘটনায় ভুক্তভোগী, নির্যাতিতা নারীর উপর সব দোষ চাপানো আমাদের চিরাচরিত একতরফা পুরুষ শাসিত সংস্কৃতি। মেয়েটির চরিত্র খারাপ, অবিভাবকদের সমস্যা ছিল।

এই ঘটনায় অপরাধীর মায়ের দাবি অপরাধ প্রমাণ না হওয়ার আগে তার ছেলেকে ধর্ষক বলা উচিৎ হবে না। অপরাধীর পিতার দাবি ছেলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো। হঠাৎ কি যে হলো আল্লাহ জানেন অর্থাৎ তিনি কিছু জানেন না। এটাই স্বাভাবিক আচরণ আমাদের ঘুণ ধরা, মরিচা পরা সমাজে।

ঘটনাটি বিভৎস। সারা দেশে ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে অপরাধীর কঠিন শাস্তির দাবিতে। তদন্ত চলছে, বিচার হবে, ধরে নেওয়া যায় অপরাধীর সাজা হবে কিন্তু যে পরিবারটি সন্তান হারালো, সমাজে অপমানিত হলো, ক্ষতিগ্রস্ত হলো, কোন আর্থিক ক্ষতিপুরণ দিয়ে কি তাঁদের সন্তানকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব? তাদের মনের ক্ষত, হারানো সম্মান ফিরিয়ে আনা সম্ভব? সন্তানদের ভালো পথে পরিচালিত করতে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সমষ্টিগত দায়িত্ব আছে।

শুধু পিতা মাতার উপর তাঁদের সন্তান কি করছে, কোথায় যাচ্ছে, কাদের সঙ্গে মিশছে দায় ভারটা চাপিয়ে দিলে চলবে না। তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, পরিবারের মূল্য বোধ মানুষের চরিত্র গঠনে বড় ভূমিকা রাখে। ছেলে মেয়ে যখন হাইস্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তখন কোচিং, থেকে শুরু করে ক্লাসে যাওয়া আসা বন্ধুদের সাথে গল্প করা, রেষ্টুরেন্ট, লাইব্রেরীতে যাওয়া, সব সময় অবিভাবকগনের নজরে রাখা সম্ভব নয়।

সমাজ ও রাষ্ট্রের সমষ্টিগত ভাবে দায়িত্ব আছে। কোন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চোখে পড়লে সমাজের কেউ না কেউ অবিভাবকদের অভিহিত করা উচিৎ। আজকাল জীবনের তাগিদে বাবা মা উভয়কে কাজ করতে হয় তাই তাদের পক্ষে সব সময় চোখে চোখে রাখা সম্ভব নয়। ছেলে মেয়েরা অল্প বয়সে সহজে ভুল পথে যেতে পারে। বিপরীত লিঙ্গের কাউকে ভালো লাগা স্বাভাবিক। বাহির জগতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবাধে মেলা মেশার সুযোগ পায়।

একজন মেয়ে বা মেয়ে বন্ধু যদি ছেলে বন্ধুর বাসায় যায়, বাসায় কেউ থাকুক আর নাই থাকুক ছেলেটির দায়িত্ব মেয়েটির সম্ভ্রম রক্ষা করা, সন্মান করা, তার উপর লাফিয়ে পড়ে বলৎকার করা নয়। এখানে পারিবারিক মূল্যবোধ অনেক বড় ভূমিকা রাখে। ঐ ছেলের মা বোনও থাকতে পারে। একদিন সে কন্যা সন্তানের বাবাও হতে পারে। সে কি চাইবে তাঁর কন্যা সন্তানকে কেউ এভাবে বিকৃত যৌনাচার করে মেরে ফেলুক?

কিভাবে আমাদের সন্তানেরা কৈশোর ও তারুণ্য নিরাপদ রাখবে ও অন্যকে নিরাপদ রাখবে তার জন্য এদেরকে নৈতিক মূল্য বোধ, শিষ্টাচার শেখাতে হবে। সুন্দর আচার আচরণ, ভাল- মন্দ, ন্যায়- অন্যায়, সমাজে কোন কাজটি কল্যাণমুলক, কোনটা অকল্যানমূলক বুঝাতে হবে। একজনের দায়িত্বহীন কর্মকান্ডে একটি জীবন, একটি পরিবার ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

সময় এসেছে মহল্লায় মহল্লায়, হাইস্কুলে ধর্ষণ নিয়ন্ত্রণ ও ধর্ষণ বিরোধী ক্লাস, মিটিং, সেমিনার করে তরুণ সমাজকে নৈতিকতার শিক্ষা তথা সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ শিখাতে হবে। এই ক্ষেত্রে পুলিশ প্রশাসন, শিক্ষক, অবিভাবকগন, মহল্লার বড় ভাই বোন সকলে মিলে কাজ করতে হবে। যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে তরুন সমাজকে ধর্ষণ, মাদক নেশা থেকে শুরু করে সব ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে

দূরে রাখা ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

লেখকঃ আলমগীর দারাইন, কলামিস্ট, ক্যালগেরী, আলবার্টা, কানাডা।

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ৩০ জানুয়ারি ২০২১ /এমএম

 


Array