Menu

টানা একযুগের আওয়ামী লীগ শাসন আর শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক লড়াই সংগ্রামে বাংলাদেশ কে অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। ব্যক্তি শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তার সাথে তার দল আওয়ামী লীগ কি ব্যালেন্স করতে ব্যর্থ হচ্ছে নাকি দলে থেকেই, দলকে ডুবিয়ে দেয়ার কোন সুগভীর ষড়যন্ত্র নিয়ে নব্য মুশতাকদের অনুসারীরা নৌকার মাঝির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে? সম্প্রতি হয়ে যাওয়া, স্থানীয় সরকারের পৌরসভা নির্বাচনে, এ প্রশ্নটি এখন ঘুরপাক খাচ্ছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের অনুসারী হাজারো নেতা কর্মীর হ্রদয়-মনে!

বাংলাদেশে এখন সরকার বিরোধী রাজনৈতিক কর্মকান্ড নেই বললেই চলে, বিরোধীরা অবশ্য একে দমন-পীড়ন নীতির প্রতিফলন বলেই আখ্যায়িত করেন। অধিকার আদায়ের সংগ্রাম কি কখনো দমন-পীড়নের বাইরে ছিল? ভাষার সংগ্রাম, শিক্ষার সংগ্রাম, ভোটের অধিকার, ভাতের অধিকার এমনকি মত প্রকাশের মৌলিক মানবাধিকার এর মতো বিষয়গুলো আদায় করতেও দমন-পীড়ন কে চ্যালেঞ্জ করেই বিজয়ী হতে হয়েছে। যে কোন আন্দোলন সংগ্রামে সফল হতে হলে যোগ্য নেতৃত্বের পাশাপাশি চাই জন সম্পৃক্ততা।

জনবিচ্ছিন্ন আর ভোগবাদী নেতৃত্বকে সামনে রেখে গণদাবি আদায় হয় না। জেল জুলম, গুলি, বোমা আর পুলিশী নির্যাতন কে ভয় পেলে কি এরশাদ কে বিদায় করা যেতো? জন সম্পৃক্ততা না থাকলে ছিয়ানব্বই এর ভোটার বিহীন নির্বাচনের পর গড়ে উঠা জনতার মঞ্চ কি খালেদা জিয়ার সরকার কে নতি স্বীকার করাতে পারতো? যে খালেদা জিয়া একসময় বিশ্বাস করতেন, ‘ শিশু আর পাগল ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নেই’ তাকে ও তো একদিন নিরপেক্ষ সরকারের দাবী মেনে নিতে হয়েছিল। ২০০৮ থেকে টানা ১২ বছরের আওয়ামী শাসনে দেশে যেনো আজ বিরোধীদের আকাল, সারাজীবন মুক্তিযুদ্ধ আর দেশ বিরোধী চেতনা ধারন করে যারা মুজিব আদর্শে বিশ্বাসীদের জীবন কে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল, আর একটি সুযোগের অপেক্ষায় যারা প্রতিনিয়ত প্রহর গুনছে, এরাও যেন আজ আওয়ামী লীগের বড় শুভাকাঙ্ক্ষী!!

দেশের জনগণ যেন গনতন্ত্রের বলীদানে উন্নয়ন কে ই স্বাগত জানাতে চায়!! তা না হলে ২০১৪ আর ২০১৮ সালের গনতন্ত্রের কালিমা জাতি কে কেন বিক্ষুব্ধ করে না? গনতন্ত্রের নামে গনতান্ত্রিক সরকারের ই শাসনামলে সারাদেশে একযোগে বোমা বিস্ফোরণ, গ্রেনেড হামলায় বাঙালির গর্ব সাবেক অর্থমন্ত্রী এএসএম কিবরিয়ার জীবনাবসান, আ্হসান উল্লাহ মাস্টার হত্যাকাণ্ড জাতিকে হতাশ করেছে সন্দেহ নেই। গনতন্ত্রের বরপুত্র তথাকথিত বড় মিয়ার তত্ত্বাবধানে পল্টনের নিষ্ঠুর গ্রেনেড হামলার নায়কদের সামনে রেখে দেশে গনতন্ত্রের আন্দোলন হবে, আর জনগন সেই আন্দোলনে জীবন দিবে এমন ভাবনা এখন দিবাস্বপ্ন। ভাবতেই কষ্ট হয়, সেলিম, দেলোয়ার, রাউফুন বসুনিয়া, কাঞ্চন, দীপালি সাহারা কেন জীবন দিয়েছিল? ডাঃ মিলন আর নুর হোসেন এর জীবনদান কি শুধুই মসনদ বদলেরই আন্দোলন ছিল? যে অধিকার এর জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবন যৌবন কে উৎসর্গ করেছিলেন, সেই অধিকার আজ কোথায়? জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ২১ বছর জেল জুলুম আর সীমাহীন নির্যাতন সহ্য করে যারা দলটিকে ধরে রেখেছিলেন তারা কেন আজ বহিষ্কার আতংকে?

জননেত্রী শেখ হাসিনা সব সময়ই বলে থাকেন, দুঃসময়ের নেতা কর্মিরা ই আওয়ামী লীগের প্রাণ। রাজনীতিক মহলে ওবায়দুল কাদেরের কাউয়া তত্ত্ব তো সর্বজন বিদিত ই, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রজ তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ তো নিয়তই দুঃসময়ের নেতা কর্মিদের মূল্যায়নের নসিহত করেন, কিন্তু বাস্তবতা তার বিপরীত কেন? কার্যকর বিরোধী দলীয় রাজনীতির অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ই এখন বাস্তবতা। দলীয় প্রতিকের স্থানীয় সরকারের নির্বাচন যেন আগুনে ঘি ঢালার ই নামান্তর। দেশের অনেক এলাকায় ই আওয়ামী লীগ আর মন্ত্রীলীগ এখন মুখোমুখি, পরিনতিতে শক্তি হারাচ্ছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ। যে সব এলাকায় মন্ত্রী লীগ আছে সেসব এলাকার প্রশাসন যেন আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ তাই নেতা কর্মির আহাজারির ও শেষ নেই!

“আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকরা যা বলেন তা করেন না” নিন্দুকদের এমন কথা-ই কি সঠিক? তা না হলে ওবায়দুল কাদেরের ভাই আলোচিত মির্জা কাদের ফেনী আর নোয়াখালীর আওয়ামী রাজনীতির যে দৈন্যদশা জাতির সামনে তুলে ধরেছেন তা কি আর একটি উন্নত মানের কোন রাজনৈতিক চালাকিপনা? নির্বাচন আসলে দলীয় নীতি নির্ধারকরা বিদ্রোহী প্রার্থীদের বহিষ্কারের হুংকার ছাড়েন, এবার বহিষ্কার হলে আর ফিরিয়ে আনা হবে না – এমন মিথ্যার ফুলজুরি তো এখন রাজনৈতিক বাস্তবতা। তাই বহিষ্কারের চিটি এখন দলীয় নেতা কর্মির কাছে মুল্যহীন,তিন মাসের তাগাদাপত্র মাত্র!!

সারাদেশে চলছে স্থানীয় সরকারের পৌরসভা নির্বাচন। আমার জেলা হবিগঞ্জে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি মাধবপুরে মাত্র ৬০৮ ভোট পেয়ে নৌকার মাঝি শ্রীধাম দাশগুপ্তের জামানত হারানোর ঘটনা জাতীয় ও আঞ্চলিক গনমাধ্যমে এখন মুখরোচক এক গল্পের নাম। দিশা হারানো এই মাঝি এক স্কুল ছাত্র কে রিভলবার দেখিয়ে নতুন আলোচনার ও জন্ম দিয়েছেন। তার চেয়েও উদ্বেগের বিষয় গতকাল শ্রীধাম সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘ ৯৯% আওয়ামী লীগের নেতা কর্মি তার বিরুদ্ধে ‘ ছিল। আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকদের কাছে জানতে চাই, দলের ৯৯% নেতা কর্মী যে প্রার্থীকে সমর্থন করে না, সেই প্রার্থী কোন বিবেচনায়, কার প্ররোচনায় দলীয় প্রতীক পায়? আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ড সরকারি, বেসরকারি নানা রকম গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রার্থী যাচাই বাচাই করে, এটি কি আসলে মিথ্যার ই ফুলঝুড়ি? এবার যারা দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করবেন তাদের সবাই কে ই চিরতরে বহিষ্কার করা হবে, এটি যদি সত্যি হয় তাহলে জামানত হারানো দাশগুপ্তের অভিযোগের ভিত্তিতে মাধবপুরের ৯৯% নেতা কর্মি কি বহিষ্কৃত হবেন?

বৃহত্তর সিলেটের গোপালগঞ্জ খ্যাত হবিগঞ্জ, আওয়ামী লীগের দূর্গ বলেই পরিচিত। যুদ্ধাপরাধী ধনাঢ্য অনেক রাজাকার আর প্রো-পাকিস্থানী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ দানশীলদের মোকাবেলা করে গত দুই যুগে বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের নানা ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে অত্যন্ত সুসংগঠিত ছিল জেলা আওয়ামী লীগ। এমন পরিস্থিতিতে ইতিমধ্যেই হয়ে যাওয়া তিনটি পৌরসভা নির্বাচনে ই আওয়ামী লীগের পরাজয় কিসের ইংগিত বহন করে? নেতা কর্মী চায় না, রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম আর ত্যাগ তিতিক্ষার ইতিহাস নেই, নেতা কর্মীর সংগে নেই কোন প্রাণের বন্ধন, এমন মানুষরা যখন নৌকার মাঝি হয়ে হ্যাট্রিক পরাজয় বরন করে, এর দায় কি সারা জীবন ত্যাগ স্বীকার করা তৃণমূল নেতাকর্মির নাকি যারা জন সংস্রবহীন অগ্রণযোগ্যদের হাতে বঙ্গবন্ধুর নৌকা তুলে দেন তাদের?

আসছে ১৪ ফেব্রুয়ারি আর এক আওয়ামী দূর্গ চুনারুঘাট পৌরসভার নির্বাচন, বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর ও সাধারণ মানুষের বিশ্বাস জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ ও ব্যবসায়ী নেতা আলহাজ্ব আকল মিয়া হত্যাকাণ্ডের সংগে সংশ্লিষ্টতা ছিল নৌকার মনোনীত প্রার্থীর। এমন বিতর্কিত বিষয়ে যার সংশ্লিষ্টতা, তার হাতে নৌকা তুলে দেয়া কি খুবই জরুরি ছিল? নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব আর স্বচ্ছতার স্বার্থে যদি ঐ এলাকার আওয়ামী লীগের নেতা কর্মি বিরোধিতা করেন বা নিস্ক্রিয় থাকেন কোন আদর্শিক বিবেচনায় তারা বহিষ্কৃত হবেন? হবিগঞ্জের আওয়ামী দূর্গে তিনটি পৌরসভায় ই বিএনপির বিজয়, সামনের নির্বাচনগুলোতে ও পরাজয়ের সম্ভাবনা মোটেও কোন শুভ লক্ষণ নয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিনের মাটি চাটগাঁয়ের বাতাসেও অশনি সংকেত, এসব কিসের আলামত?

উল্টো পথে যাত্রা করা দেশটি কে আদর্শিক পথে ফিরিয়ে আনার অবিরাম সংগ্রামে নিয়োজিত জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা। অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াইয়ে তার সাফল্য আজ বিশ্বব্যাপী অনন্য উচ্চতায় প্রশংসিত। একনাগাড়ে দীর্ঘদিনের ক্ষমতা বলয়ে অনেক আদর্শহীন আবর্জনা এখন দলটির আশেপাশে, আর আবর্জনার চাপে ত্যাগি নেতাকর্মীদের জীবনে এখন ত্রাহি-ত্রাহি অবস্থা! রাজপথের অভিজ্ঞতাহীন, নেতা-কর্মী বিচ্ছিন্ন শুধু আনুগত্যে উত্তির্ন এমন মন্ত্রী এমপিদের দল থেকে দূরে রাখার বিকল্প নেই। জনপ্রিয়তা জরিপ আর প্রকৃত অনুসন্ধান ছাড়া শুধু ব্যক্তিগত আনুকুল্যে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নে, বহিষ্কার আতংকে কিছু নেতা কর্মীর রাজনৈতিক জীবন ই শুধু দূর্বিষহ হবে, আখেরে ফলাফল টি বুমেরাং হতেই বাধ্য!!

লেখকঃ কলামিস্ট, উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক
আলবার্টা, কানাডা ।

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ২১ জানুয়ারি ২০২১ /এমএম