Menu

অতি প্রকৃতির প্রতি আমাদের আগ্রহ অনেক। ভবিষ্যত জানার অদম্য ইচ্ছা কমবেশী সবারই আছে। মিসেস জীন ডিকসন এমন একজন ব্যক্তিত্ব অতিন্দ্রীয় বিষয়ে খবর বলতে পারতেন। যাকে বলে ভবিষ্যৎ বাণী। কিন্তু তাঁর অনেক ভবিষ্যৎ বাণী সঠিক হয় নি। তেমনই মনে হয় জোতিষীদের ২০২০ সালের ভবিষ্যৎ বাণী সঠিক হয় নি। পত্রিকা ঘেটে ২০২০ সালের কিছু ভবিষ্যৎ বাণী পড়লেই ২০২০ সালের সব জাতকদের কেমন গেলো সে আর ব্যাখ্যা করার দরকার নাই। মানুষ ভবিষ্যৎ বলতে না পারলেও আমরা ভবিষ্যৎ জানার জন্য আগ্রহী এটা সত্যি।

তবে আনুমানিক ধারণায় কিছু একটা বলা। এই অনুমান সবসময় ঠিক হয় না। অনুমান ভিত্তিক একটা ঘটনা মনে পরে গেলো। আনুমানিক ২১/২২ বছরের আগের ঘটনা। আমাদের প্রিয় বড় ভাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাক্তন জাকসু ভিপি ছিনতাইকারী দ্বারা ছুরিকাহত হয়েছিলেন, আমরা শঙ্কিত হলেও শুনলাম গুরুতর কিছু না। তাঁর উরুতে ছিনতাইকারী ছুরিকাঘাত করেন। সে সময় ছাত্রদের মাঝে তিনি বেশ জনপ্রিয় ছিলেন এবং অত্যন্ত একজন ভালো মনের মানুষ। খুবই সহজ সরল। তার কাছে ঘটনা জানতে চাইলে বললেন, গুলিস্তানের যানজটের মধ্যে তার বেবি ট্যাক্সি দাঁড়াতেই দুই দিক থেকে দুই ছিনতাইকারী ছুরি ধরে তার যা কিছু আছে তা দিতে বলে। আমরা বললাম, দিয়ে দিতেন ঝুঁকি নিলেন কেন ? উনি বললেন, আমি তো দিয়েই দিয়েছিলাম, তারা নেমেও গিয়েছিলো,হঠাৎ আমার মাথা গরম হয়ে উঠলো, দেশ স্বাধীন হয়েছে এদের জন্য ? আর আমি প্রাক্তন ছাত্রনেতা আমার কাছ থেকে চিন্তায় করবে? প্রশ্রয় না দিয়ে প্রতিবাদ করা উচিৎ, তাই তার কোমড় অনুমান করে দিলাম এক
লাথি।

কিন্তু ভাগ্যটা এমন খারাপ লাথিটা এডজাষ্ট না হয়ে সেটা লাগলো বেবি ট্যাক্সির রডে। আর তখনি আমাকে ছুরিকাঘাত করলো, ভাগ্যিস বেবি ট্যাক্সি চলতে শুরু করেছিল তাই আঘাত লাগে নাই ঠিক মতো। বলেই তিনি হাসলেন, সাথে আমরাও। আমাদের হাসির কারণ ছিল তার বর্ণনায় তার লাথি এডজাষ্ট হয় নাই । তেমনই ২০২০ সালের ভবিষ্যৎ অনুমান সব জোতীষির ক্ষেত্রে এডজাস্ট হয় নাই। সব জেনেও মানুষের জোতিষীর গণনার মাধ্যমে অনেকেই তার ভবিষ্যৎ জেনে তৃপ্তির হাসি নিয়ে ঘরে ফেরেন। আমিও এদের বাইরে না, ভবিষ্যৎ জানার আগ্রহ ছিলো খুব। ছাত্র জীবনে তো বটেই কর্ম জীবনেও অনেকবার হাত দেখিয়েছি। আমার মনে হয় আমার মত অধিকাংশই তাদের ভবিষ্যৎ জানার আগ্রহে জ্যোতিষীর স্মরণাপন্ন হয়েছেন। আমারও জ্যোতিষীর গণনার উপর বেশ আগ্রহ ছিলো ছাত্র জীবনে।

শেষবারের মত জোতিষীর সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিলো নেপালে। নেপাল ভ্রমণ আমার কাছে ছিল খুবই অপ্রত্যশিত। কর্ম জীবনে আমার স্কুল জীবনের এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছিল প্রায় এক যুগ পরে। বন্ধুটি ব্যবসায় বেশ উন্নতি করেছে।দুই বন্ধু মিলে সারাদিন ও রাতে বেশ কিছু সময় আড্ডা দিলাম। স্কুল জীবনের বন্ধুদের কেকোথায় আছে, স্কুলের নানারকম দুষ্টামি ও স্মৃতি গাঁথা অনেক কথা সে কি আর এক দিনে শেষ হয় ?

গল্পে গল্পে জানতে পেলাম তার ভারত ও নেপালের সাথে ব্যবসা আছে। নেপালে ইন্ডেন্টিং পার্টনার আছে। নেপালে তার ব্যবসা বেশ জমে উঠেছে। আমাকে বললো ভারত, নেপাল গিয়েছিস কখনো ? বললাম ছাত্রী জীবনে বন্ধুদের সাথে ভারত গিয়েছিলাম কিন্তু নেপাল যাওয়া হয় নি। তাছাড়া নেপাল সম্পর্কে আমার তেমন কোনো ধারণা নাই তাই খুব একটা অগ্রহ নাই। অবাক হয়ে বললো বলিস কি তোর তো দেখি অনেক আনাই বৃথা। মাঝি ও বাবুর কথার মতই শোনালো। আমি বললাম কেন ? বললো, তুই কি অন্নপূর্ণা, নাগরকোট, পোখরা হিমালয়ের নাম শুনিস নি? আমি বললাম হিমালয় ছাড়া আর কোনো স্থানের নাম জানি না দোস্ত। বললো আমি দুই সপ্তাহ পরে যাবো তুই শুধু তোর টিকেটের খরচ দিবি, তোর বাকি সব দায়িত্ব আমার। এতো লোভনীয় আমন্ত্রনের আহবান প্রত্যাখ্যান করা আমি কেন কারো পক্ষেই সম্ভব না।

তাছাড়া দু বন্ধু মিলে বিদেশ ভ্রমণ আনন্দের হবে সে তো জানাই ছিলো। নতুন চাকরি, জাপান থেকে ট্রেনিং নিয়ে সদ্য ফিরেছি। জাপানিরা বাংলাদেশে না আসা পর্যন্ত আমাদের তেমন কোনো কাজ নেই। জাপানে থাকা কালীন কিছু টাকা জমেছিলো। সেগুলোর শ্রাদ্ধ না করা পর্যন্ত শান্তিও পাচ্ছিলাম না। তাছাড়া তখনও আমার সংসার জীবন শুরু হয় নি। এখনই তো যাবার মোক্ষম সময়। পরদিন অফিসে আমার বস প্রোজেক্ট ডাইরেক্টরকে বলা মাত্রই ছুটি মনজুর হলো। তিনি মিটিংয়ে সবাইকে জানিয়েও দিলেন কারো কোনো ছুটির দরকার হলে এখুনি নিয়ে নিন, জাপানিরা আসলে কিন্তু কোনো ছুটি হবে না।

সে বিবেচনায় আমার ছুটির সময় ছিল যথার্থ। যতদূর মনে পরে মাসটি ছিল সেপ্টেম্বর। নির্দিষ্ট দিনে দুই বন্ধু মিলে নেপাল রওনা হলাম। ওখান সব বড় বড় হোটেলে ক্যাসিনো আছে। বন্ধুটি বললো, দোস্ত আমার কিন্তু দুটি বদ অভ্যাস আছে। আমি বললাম কি? সে বললো, আমি বিদেশ আসলেই ড্রিংক করি আর ক্যাসিনোতে না গেলে আমার নেপাল যাত্রা বৃথা। আমি বললাম বিদেশে আসলে কেন? বাংলাদেশে করিস না? সে বললো মাথা খারাপ তোর ভাবী আমাকে মেরেই ফেলবে। আমি অবাক হয়ে বললাম তুই বিয়ে করেছিস? সে বললো হা সেও তো প্রায় বছর তিনেক হবে। আমি বললাম, এতো কথা হলো তোর বিয়ের কথা তো বলিস নি। বললো, প্রসঙ্গ উঠে নি তাই। আমি আর কথা বাড়ালাম না। আমি বললাম তুই রুমে ড্রিংক করতে পারবি না।

সে বললো, অরে নাহ ! ড্রিংক করি শুধু ক্যাসিনোতে কারণ ওখানে ওটা ফ্রি। আসস্থ হলাম। কারণ কেউ যদি মদ্যপান সেখানে আমার আপত্তি থাকার কোনো কারণ নাই, আপত্তি হচ্ছে মাতলামী করলে। কারণ একমাত্র ভারতবর্ষের লোকেরা মদ্যপানের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। তারপর শুরু হয় অনর্গল কথা, যার বেশির ভাগই বোঝ যায় না। আমি বললাম, তাহলে আমার জন্য কি ব্যবস্থা করলি। সে বললো তোর জন্য আমার অফিসের লোক থাকবে রাতের কাঠমুন্ডু দেখাতে আর দিনের বেলায় আশেপাশের দর্শনীয় স্থান দেখবি ওদের সাথে। কারন আমার ঘুম ভাঙতে দেরি হবে তারপর অফিসের কিছু কাজকর্ম শেষ করতে প্রায় সন্ধ্যে ছটা বেজে যাবে। তুই ফিরলে একসাথে ডিনার খাবো। আগামী শনি রবিবার আমরা একসাথে পোখরা যাবো। তবে ওখানে দুই বন্ধু মিলে শুধুই আড্ডা, নো ড্রিংক নো ক্যাসিনো। আমি বললাম, ঠিক আছে।

পোখরা যাত্রার আগেরদিন ক্যাসিনো দেখার ইচ্ছে হলো। বন্ধুর সাথে ক্যাসিনো গেলাম সন্ধ্যায়। লোকের সমাগম অনেক। দেখলাম এক কোনায় এক জ্যোতিষী বসে হাত দেখছে। মন খুশিতে দুলে উঠলো, দেশী জ্যোতিষীদের হাত দেখিয়েছি অনেক এবার বিদেশী জ্যোতিষী। লাইনে দাঁড়ালাম। ততক্ষনে প্রায় সবাই হাত দেখিয়ে কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছে খুশিমনে, ভাবখানা আজ নির্ঘাত জ্যাকপট মিলবে। এবার আমার হাত দেখাবার পালা। জ্যোতিষী আমার হাত দেখে ফিস ফিস করে বলেছিলো লটারী আর জুয়া ভাগ্য তোমার নাই, তুমি চলে যাও। ফিসফিস করে বলার কারণ ছিল ওকে এখানে যারা বসিয়েছে তারা বলে দিয়েছে, নেগেটিভ কথা না বলতে। আমি কোনোদিন বুঝি নাই সে কেন আমাকে সত্যি কথা বলে দিয়েছিলো। কারণ কখনই আমি লটারিতে কিছু পাই নি। মনে পরে বাংলাদেশে ক্লাবের এই আয়োজনে রাতের ডিনারে গিয়েছিলাম। ওখানে আনুমানিক ৬০০ লোকের সমাগম লটারীর ছোটবড় পুরস্কার নিয়ে মোট ৪৮০ টি পুরস্কার ছিল। আমি মনে মনে ভেবে ছিলাম এবারনিশ্চয়ই কিছু একটা পাব। লটারী ড্রয়ের শেষে দেখা গেলো আমি সত্যি ভাগ্যবান, কারন অতিথিদের মধ্যে আনুমানিক ১২০ জন লটারী জিতেন নাই আমি সেই না পাওয়া ভাগ্যবানদের একজন।

মনে পরে আমিও এক সময় জোতিষির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলাম। সেও অনেক আগের কথা। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মাঝে মাঝে টাকা জমিয়ে বিভিন্ন জোতিষীর কাছে যেতাম নিজের ভবিষ্যৎ জানার জন্য। তিন বছরে প্রায় তিনজন জোতিষীর শরণাপন্ন হয়েছিলাম। তাদের একজনের ভবিষ্যৎ বাণীর সাথে অন্যজনের মিল পাই নি। তবে পাথর বিক্রীর জন্য প্রায় সবাই চাপ দিয়েছিলেন, তা মনে আছে। একটা বিষয় লক্ষণীয় ছিল, তা হচ্ছে সবাই প্রায় কমন কথা বলছেন, যেমন আপনার পার্সোনালিটি খুব স্ট্রং, তৎক্ষণাৎ আমি মনে মনে মিলিয়ে ফেলতাম তাই তো ! আমার পার্সোনালিটি আছে, অমুক দিন অমুক মেয়ের সামনে বসে না তাকিয়েকেমন দিব্বি আড্ডা দিলাম! আড্ডার পর নিশ্চয় মেয়েটি আমার পার্সোনালিটিতে মুগ্ধ হয়ে ছিলো! জ্যোতিষীর কথা একদম খাঁটি। এখন বুঝি সে মুগ্ধ হওয়ার পরিবর্তে আমাকে অসামাজিক প্রাণীই ভেবেছিলো।তিসিকথা বলেছিলো আপনি খুব কল্পনাপ্রবণ, দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে ফেললাম, তাই তো কল্পনায় আমি নিজেকে নিমেষে যোজন যোজন দূরে নিয়ে যেতাম।

দিবা স্বপ্নের কল্পনায় অনেক প্রেম করেছি যা কখনো বাস্তবায়ন হয়নি। পরে বুঝতে পেরেছিলাম ওই বয়সে প্ৰায় সবাই কল্পনা প্রবন হয়। আপনার জীবনে কয়েকটি প্রেমের যোগ আছে। ব্যস অমনি পুলকিত হয়ে তখনি সম্ভাব্য ভালো লাগার মেয়েদের নিয়ে ভেবে ভেবে ভালোবাসার ফল্গুধারা বয়ে যেত। আসলে বাস্তবেই হোক আর কল্পনাই হোক বা এক তরফ ভালোবাসাই হোক সবার জীবনে একাধিক প্রেম আসে। এমন আরো অনেক কথা, যেমন, আপনি দীর্ঘায়ু হবেন, কর্ম জীবনে অনেক উন্নতি হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। তাদের ভাগ্য গণনা আমাকে প্রভাবান্বিত করেছিলো তাই মনে মনে জোতিষী হবার বাসনা হলো।

নীলক্ষেতের পুরানো বইয়ের দোকান থেকে অনেক খুঁজে বিশ্বখ্যাত জোতিষী কিরোর একটি বাংলা অনুবাদের বই পেয়ে গেলাম। তারপর শুরু হলো গণনার কাজ। অবশ্য এ গণনায় কখনো পারিশ্রমিক নেই নি। বন্ধুদের চোখ ফাঁকি দিয়ে জুনিয়র ছেলে মেয়েদের হাত দেখে মোটামোটি জনপ্রিয় হয়ে পড়েছিলাম। এক্ষেত্রে আমার হাত দেখা জোতিষীদের বলা কথা নির্দ্বিধায় বলে যেতে লাগলাম। মনে পড়ে খ্যাতি থাকতে থাকতেই জ্যোতির্বিদ্যার অবসান হলেও কর্ম জীবনে জ্যোতিষীকে হাত দেখানো থেকে বিরত থাকি নি। তাদের পরামর্শে  একটি পাথর কিনে হাতের শোভা করে ফেলেছিলাম। জীবনে জস, খ্যাতিরও অনেক দরকার। পাথরের অনেক গুন থাকলেও আমার আঙুলের পাথরের রং বেগুনী হবার কারণেই বোধহয় উল্লেখযোগ্য কোনো গুনের প্রমান মেলে নি। বেগুন বলে কথা।

মনে পরে, নেপাল থেকে ফেরার পর কাজে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম, সবার সাথে যোগাযোগ প্রায় বন্ধ ছিলো। বছর তিনেক পরে বন্ধুটির সাথে আবার দেখা হলো। একটু মুটিয়ে গেছে, তাছাড়া সব ঠিক। তাঁর দুই হাত ভর্তি আংটি কোনো কোনো আঙুলে দুটি আংটি। আমি খুব একটা অবাক হয় নি কারণ আংটির বাতিক আমারও ছিল এক সময়।

কিন্তু কৌতূহল দমন করতে না পেরে বললাম, কি ব্যাপার দোস্ত তোর হাতে এতো আংটি কেন ? সে বললো, আর বলিস না, আমার দশটি আংটির মধ্যে একটি বিয়ের আংটি, বাকি নয়টি বিবাহত্তোর শান্তি ও সংসার টেকানোর জন্য জোতিষীদের দেয়া। নয়টি আংটি তার সংসারে শান্তি আসছে না। আমি হেসে বললাম, তোর ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য মনে হয় আরো কিছু আংটির প্রয়োজন। হাতে আরো দু একটি আঙ্গুল থাকলে মন্দ হতো না।

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ১২ জানুয়ারি ২০২১ /এমএম