Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: বিগত শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষদিকে বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ জন্মগ্রহণ করেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত ও সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে।বিগত শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষদিকে বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ জন্মগ্রহণ করেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত ও সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে।

তিনি ছাত্রজীবন থেকে বেড়ে ওঠেন এক নিয়মতান্ত্রিক পরিবেশে, যা তাকে শুধু ঈর্ষণীয় চরিত্রের অধিকারীই করেনি, প্রেরণা জুগিয়েছে যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান দি অনারেবল সোসাইটি অফ লিংকন ইন থেকে ১৯৩৮ সালে ব্যারিস্টার-এট-ল অর্জনে।

পেশাগত জীবনে তার কঠোর পরিশ্রম ও অসামান্য মেধা তাকে নিয়ে গেছে খ্যাতির শীর্ষে। ১৯৫৪ সালের শেষদিকে তিনি হাইকোর্টে যোগ দেন এবং একই বছর বিচারক পদে নিযুক্ত হন। বিচারপতি মোর্শেদ পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্টের বিচারক পদে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৬২ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত।

১৯৬৪ সালে তিনি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির পদে অধিষ্ঠিত হন। এ দায়িত্ব পালনকালে তিনি নিু আদালতের ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেন। বিচারপতির দায়িত্ব পালনকালে তার কিছু ঐতিহাসিক রায় এবং সাংবিধানিক ব্যাখ্যা উপমহাদেশের পরিধি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়।

আইন পেশার পাশাপাশি আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসন ও শোষণের বিপরীতে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে এবং ২১ দফা কর্মসূচি প্রণয়নে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বলা হয়ে থাকে, ২১ দফা দাবির প্রথম খসড়াটি তিনিই প্রণয়ন করেছিলেন।

বিচারপতি মোর্শেদ তার জীবদ্দশায় শুধু বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন না, তিনি নিজেই সৃষ্টি করেছেন ইতিহাস। পেশাগত সুখ্যাতি, মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও সাধারণের মাঝে তার অংশগ্রহণ, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা ও অবস্থানের গুরুত্ব জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। সে সময় ঐতিহাসিক ‘নেহেরু-লিয়াকত’ চুক্তি প্রণয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, আইয়ুব খানের ঐতিহাসিক গোলটেবিল বৈঠকে (ফেব্রুয়ারি-মার্চ ১৯৬৯) সমগ্র পাকিস্তানের যে ৩৫ নেতা আমন্ত্রিত হয়েছিলেন, বিচারপতি মোর্শেদ ছিলেন তাদের অন্যতম। সেই বৈঠকে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আমাদের ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ইতিহাসবিদদের মতে, সেদিন গোলটেবিল বৈঠকে বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’ প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং সামরিক জান্তাদের রক্তচক্ষুর সামনে এ দাবি ছিনিয়ে আনেন। এর আগে পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সমানসংখ্যাক আসন নির্ধারিত ছিল।

বিচারপতি মোর্শেদের প্রস্তাব অনুযায়ী ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’ নীতি গ্রহণের ফলে সমগ্র পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ৩০০ আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) আসন সংখ্যা ১৫০ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১৬৯।

রাজনৈতিকভাবে এ আসন সংখ্যার বিভাজনটি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে ব্যাপকভাবে পরাভূত করে, যার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায় ১৯৭০-এর নির্বাচনে। বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদের এ অবদান বাংলাদেশের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

পাকিস্তানের সামরিকজান্তা আইয়ুব খান তার সামরিক শাসন পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে যখন ‘আগড়তলা ষড়যন্ত্র’ মামলা দায়ের করেন, সে সময় বিচারপতি মোর্শেদ প্রধান বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে জনতার কাতারে এসে দাঁড়ান।

এরপর প্রথমেই তিনি মনোযোগ দেন আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের পক্ষে মামলার প্রস্তুতি গ্রহণের এবং পাশাপাশি এর বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গঠন করেন। এর মাধ্যমে তিনি সামনে থেকে আইনি প্রক্রিয়ার পাশাপাশি সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণে ব্যাপক ‘আইয়ুববিরোধী আন্দোলন’ গড়ে তোলেন।

সে সময় অবিসংবাদিত নেতা শেখ মজিবুর রহমানসহ সব আসামির গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বিরুদ্ধে এবং তাদের মুক্তির জন্য সভা-সমাবেশ-সেমিনারে অংশ নেয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলে আবেদন জানান। তার এ অবদানের কথা ইতিহাসের পাতা থেকে কখনও মোছা যাবে না। আজ তার জন্মদিনে তার প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

ব্যারিস্টার এম তমিজউদ্দিন : লেখক ও গবেষক

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ১১ জানুয়ারি ২০২১ /এমএম


Array