Menu

যুগ যুগ ধরেই উন্নয়নশীল,স্বল্পোন্নত তথা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে গণতন্ত্র, মানবাধিকার আর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার চাপে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবী-ব্যাপী তাদের কর্তৃত্ব কে প্রতিষ্ঠা করে মোড়লের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে চার বছর আগে রিপাবলিকান সরকারের আগমনে ক্রমান্বয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হতে থাকে।

মেগা বিলিওনিয়ার উদ্ভট ব্যক্তিত্বের অধিকারী ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়ে একের পর এক বিতর্কিত বিষয় কে সামনে এনে পেশীবলে সবকিছু কে রাষ্ট্রের উপর চাপিয়ে দিয়ে পাগলাটে, দিকভ্রান্ত, বর্ণবাদী, আদর্শহীন একজন অযোগ্য রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ই বিশ্ববাসীর সামনে প্রতিভাত হয়েছেন। ক্ষমতার অন্ধে মাতোয়ারা এই বিলিওনিয়ার প্রেসিডেন্ট, ব্যবসা-বানিজ্যে সফল হলেও রাষ্ট্র পরিচালনা তথা বিশ্ব নেতৃত্বে কতটা অযোগ্য তার লক্ষ্মণগুলো আরও দু’বছর আগে থেকেই সুস্পষ্ট হতে থাকলেও বিগত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কে সামনে রেখে তা পুরোপুরি বিশ্ববাসীর সামনে উম্মোচিত হয়।

নির্বাচনে কারচুপির সম্ভাবনা কে সামনে এনে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় থাকার লক্ষ্যে দিশাহীন হয়ে পড়েন, করোনাকালে নিজ দেশের সরকার আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষিত বিধিনিষেধ অমান্য করে আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙুল দেখিয়ে গোয়ার্তুমির রাজা হিসেবেই নিজেকে তুলে ধরেছেন, তবুও আশ্চর্যজনক ভাবে যুক্ত রাষ্ট্রের ভোটের ইতিহাসে রেকর্ডতম প্রতিদন্ধিতা তৈরী করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

প্রথমেই আসা যাক যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন টি কি প্রশ্নবিদ্ধ ছিল? মোটেই তা নয়, ডোনাল্ড ট্রাম্প সময়ের পরিক্রমায় নানা অভিযোগ উত্থাপন করলেও, বিতর্কিত করার নানা প্রচেষ্টা চালিয়ে গেলেও প্রশাসন আর নির্বাচন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তার কোন অভিযোগের ই ভিত্তি আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়নি, দেশটির জনগনও একটি নিরপেক্ষ, পক্ষপাতমুক্ত, অবাধ এবং সকল বিধিবিধান অনুসরণ করেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে বলেই বিশ্বাস করে।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, ক্ষমতায় থেকেও ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন যন্ত্রকে যেমন তার অনৈতিক পরিকল্পনায় ব্যবহার করতে সক্ষম হননি, আবার খোদ তার দল রিপাবলিকান কে ও সামগ্রিক ভাবে তার চাপের কাছে নতি স্বীকার করাতে ও ব্যর্থ হয়েছেন। তাই এটি অত্যন্ত দৃঢ়চিত্তেই বলা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গনতন্ত্র একটি অত্যন্ত সুদৃঢ় প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত বলেই অর্থ, বিত্ত, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তদুপরি হোয়াইট সুপ্রিমেসীর জোড়ে প্রচন্ড জনপ্রিয়তা কোন কিছুই বর্ণবাদী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে রক্ষা করতে পারেনি।

গতকাল থেকে কিছু কিছু গণমাধ্যম সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার প্রিয় বাংলাদেশ এ অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গনতন্ত্র পরাজিত হয়েছে, কেউ বা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কিছুদিন আগে দেয়া বক্তব্যের সাথে সুর মিলিয়ে বলছেন সত্যি ই আমাদের কাছ থেকে শিক্ষনীয় আছে। বিনয়ের সাথে প্রশ্ন রাখতে চাই, আমার দেশের কোন নির্বাচন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় সরকার প্রধানের আদেশ নির্দেশ অমান্য করার মতো নুন্যতম কোন ক্ষমতা রাখেন কি?

দলীয় প্রধানের দিক নির্দেশনা অমান্য করে মেরুদণ্ড সোজা করে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ও রিপাবলিকান নির্বাচিত জন প্রতিনিধিদের মতো গনতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়ানোর মতো হিম্মত আমার দেশের কোন রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রী রাখেন কি? যদি দু’টি প্রশ্নের উত্তর “না ” হয়, তবে বিনয়ের সাথে বলবো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গনতন্ত্র ব্যর্থ হয়নি, বরং ডোনাল্ড ট্রাম্প সৃষ্ট সংকট, গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কালিমা লেপনের চেষ্টা করলেও যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় গনতন্ত্র কতটা শক্তিশালী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত সেটি ই প্রমানিত হয়েছে।

আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বর্ণবাদ, মানবাধিকারের লংঘন, উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদের উত্থান কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প অত্যন্ত সচেতন ভাবেই এর সব কয়টিকে ই ধারণ করেছিলেন বলেই রেকর্ড পরিমাণ জনপ্রিয়তায় প্রতিটি রাজ্যেই শক্তিশালী প্রতিযোগিতা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন, নির্বাচনে হেরেও ” True patriot, True American ” শ্লোগান তুলে ক্যাপিটাল হিলের সামনে নজিরবিহীন গনজমায়েত করে আক্রমনাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।

দুঃখজনক ভাবে আহত নিহতের মধ্য দিয়ে এর সাময়িক পরিসমাপ্তি ঘটলেও পৃথিবীর ইতিহাসে ১৮১৪ সালের পর ২০২১ সালের ৬ ই জানুয়ারী ক্যাপিটাল হিলের এই সংঘবদ্ধ আক্রমণ একদিকে যেমন কলংক জনক ইতিহাস হয়ে থাকবে, অন্যদিকে বর্ণবাদীদের এই সাময়িক ব্যর্থতা ভবিষ্যতে তাদের আরও সংঘটিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করলেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।

৬ জানুয়ারি ২০২১ ডেমোক্র্যাট আর রিপাবলিকান সমন্বয়ে মার্কিন কংগ্রেসের অধিবেশন, জো বাইডেন আর কমলা হ্যারিসের নেতৃত্বাধীন ডেমোক্র্যাটদের বিজয় কে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী গনতান্ত্রিক ভিত্তিকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হলেও মার্কিনী সমাজে শক্তিশালী বর্ণবাদ আর উগ্র ধর্মান্ধতা কতটা শিকর গেঁড়েছে, এটি ই এখন সবচেয়ে বড় আতংক আর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বৃহত্তম গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত, ১৯৪৮ সাল থেকে ক্রমাগত সংগ্রামের মধ্যদিয়ে ধর্ম নিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ব্যবস্থা বাস্তবায়নে অনেক অগ্রগতি অর্জন করতে সক্ষম হলেও উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের আগমনে উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদ দেশটিকে অশান্ত করে তুলছে। কাশ্মীরে দমন বিদ্রোহ, সারাদেশে এনআরসি এর নামে বিশ কোটি মুসলমানকে নিম্ন শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করার প্রক্রিয়া, দিল্লির হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা, কৃষক বিদ্রোহ নানা অভ্যন্তরীণ সমস্যায় আজ অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে আছে দেশটি।

সাদা চামড়ার মানুষকে True American আখ্যায়িত করে ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন সমাজে যে বিষবাষ্প ছড়িয়ে যাচ্ছে, মোদির হিন্দুত্ববাদের শ্লোগান ও এর ব্যতিক্রম নয়। মানবতা,উন্নয়ন আর গনতন্ত্র সেখানে মূখ্য নয়, একজন বর্ণবাদ কে ব্যবহার করে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন আর একজন ধর্মীয় উগ্রবাদ কে উস্কে দিয়ে ক্ষমতাকে ধরে রেখেছেন। প্রিয় বাংলাদেশে ও একটি শক্তিশালী সাম্প্রদায়িক চক্র অত্যন্ত সুকৌশলে ‘ বাংলাদেশ ৯০% মুসলমান’ এর দেশ এই শ্লোগান টি জনপ্রিয় করে যে কোন মুল্যে ক্ষমতারোহনের স্বপ্নে বিভোর।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা বর্ণবাদের বিদ্রোহ কে সাময়িক উৎকন্ঠামুক্ত করতে সক্ষম হলেও, যদি ধর্মীয় আবরণে এমনতর কোন পরিস্থিতির উদ্ভব বাংলাদেশে ঘটে, তা মোকাবেলার জন্য গনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের কোন শক্তিশালী ভিত্তি সে দেশে আছে কি?

নানা প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে জো বাইডেন আর কমলা হ্যারিস এর নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সরকার সকল সাংবিধানিক প্রক্রিয়া প্রায় সম্পন্ন করেছেন,আর ক’দিন পরেই আনুষ্ঠানিক ভাবে দায়িত্ব পালন শুরু করবেন।

উন্মাদ ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন সমাজে বিদ্যমান বর্ণবাদ আর উগ্রবাদের যে পৈশাচিক চেহারা তুলে ধরেছেন, জো বাইডেনের সরকার এই চ্যালেঞ্জ কে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একদিকে যেমন মানবাধিকার, সাম্য, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিশ্ব সমাজে নেতৃত্ব দেয়ার নৈতিক মনোবল হারাবেন, বিপরীতে গনতন্ত্রের মোড়লীপনা ও একদিন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠতে পারে!!!

লেখক: কলামিস্ট, উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক
ক্যালগেরি,আলবার্টা, কানাডা ।

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/০৯ জানুয়ারি ২০২১ /এমএম


Array