Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক ::  শীতের সকাল, ঘন কুয়াশা, ঝিরিঝিরি বাতাস। চারদিকে অন্ধকার, ঝাপসা প্রকৃতি। কুয়াশা ভেদ করে এক সময় সূর্য ওঠে। মাঝে মাঝে ঘন কুয়াশার কারণে সারা দিনেও সূর্য দেখা যায় না। কিন্তু জীবিকার তাগিদে প্রতিটি মানুষকে নিজ নিজ কর্মস্থলে ছুটতে হয়। পৃথিবী আছে আগের মতোই। আছে রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, সমাজনীতি, দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও যুদ্ধবিগ্রহ। তবে অনেক নিয়মকানুন ও বিধিনিষেধের মধ্যে মানুষের জীবন অতিবাহিত হচ্ছে।

সারা বিশ্বে দেশভেদে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবকিছু চললেও সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম-বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বিশ্বব্যাপী শিক্ষাঙ্গন প্রায় স্থবির হয়ে আছে। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রছাত্রীদের পদচারণা, চঞ্চলতা, কোলাহল, গল্প, আনন্দ, উল্লাস, কর্মব্যস্ততা এবং ক্যাম্পাসের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা-সবকিছুই হারিয়ে গেছে। প্রথমদিকে করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে সারা পৃথিবীতে শিক্ষার্থীদের ক্লাস, পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট থেকে দূরে থাকতে হলেও বর্তমানে অনলাইনে সীমিত আকারে ক্লাস ও পরীক্ষা চলছে।

আবাসিক হল বন্ধ থাকায় ক্যাম্পাসের প্রায় সব শিক্ষার্থী এখন নিজেদের বাড়ি বা বাসায় অবস্থান করছে। গত ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী ধাপে ধাপে ছুটি চলছে। বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বেশ ভালোভাবেই অনলাইনে ক্লাস চলছে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদনসাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর চূড়ান্ত বর্ষের পরীক্ষা নিচ্ছে। দেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে দাপ্তরিক কার্যক্রম অনেকদিন আগে থেকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে পুরোদমে চলছে। ক্যাম্পাসের প্রতিটি কর্মকাণ্ডই চলছে এখন আগের মতোই।

বর্তমানে দেশে ৪৬ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৪২টি সরকারি এবং ৪টি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়। আরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয় প্রস্তাবিত আছে। অতি শিগগির সেগুলো কার্যক্রম শুরু করবে। ৪৬ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় সোয়া আট লাখ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। শুরুতে করোনার কারণে আবাসিক হল বন্ধ থাকায় প্রায় সব শিক্ষার্থী তাদের নিজ নিজ বাড়িতে চলে গিয়েছিল।

এ বাস্তবতায় অনলাইনে ক্লাস নেয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসে। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষার্থীদের অবস্থান, ইন্টারনেটের সংযোগ না-থাকা বা ইন্টারনেটের ধীরগতি, ডিজিটাল ডিভাইসের অভাবসহ বিভিন্ন কারণে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীদের অনীহার কারণে করোনার প্রথমদিকে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার বিষয়টি খুব একটা ফলপ্রসূ ছিল না।

পরবর্তী সময়ে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাস নেওয়া শুরু করে এবং তা অব্যাহত আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের স্বল্পমূল্যে ডেটা প্যাক প্রদানের জন্য বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক সেবাদাতা কোম্পানি রবি ও বাংলালিংকের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪১ হাজার ৫০১ জন অসচ্ছল শিক্ষার্থীকে স্মার্টফোন কেনার জন্য বিনা সুদে ৮ হাজার টাকা ঋণ দিচ্ছে। শিক্ষার্থীরা এ টাকা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর অধ্যয়নকালীন চার কিস্তিতে অথবা এককালীন পরিশোধ করতে পারবে।

বেশিরভাগ শিক্ষার্থী এখন অনলাইনেই সময় অতিবাহিত করছে। গ্রামে কিছু শিক্ষার্থী কৃষিকাজে যুক্ত হয়ে পরিবারকে সহায়তা করছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের উপার্জনের একটি বড় খাত টিউশনি। অনেক শিক্ষার্থী টিউশনি করে নিজে চলে এবং গ্রামের বাড়িতে পরিবারকে টাকা পাঠায়। ঢাকা শহরের মতো সারা দেশের শিক্ষার্থীদের করোনার কারণে টিউশনি না থাকায় উপার্জনও বন্ধ গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী করোনাকালে জীবিকার তাগিদে সবজি চাষে যুক্ত থেকে সফলতা পেয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র করোনার প্রথমদিকে সবজি বিক্রি করেছে এবং ঘটনাটি ফেসবুকেও ভাইরাল হয়েছে। শিক্ষার্থীরা বিষয়টিকে অনুপ্রেরণামূলক হিসেবে দেখেছে। কিছু শিক্ষার্থী অনলাইন ব্যবসায় যুক্ত আছে এবং কেউ কেউ পার্টটাইম চাকরি করছে।

যারা বাড়িতে আছে, তাদের বেশিরভাগ অলসভাবেই সময় কাটাচ্ছে। এর ফলে তাদের একাকিত্ব, দুশ্চিন্তা, সংশয়, অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা বেড়ে গেছে এবং অনেক শিক্ষার্থীই বিচ্ছিন্নতাবোধ করছে। পড়াশোনায় অমনোযোগী ও মনোবল হারিয়ে ফেলছে। দীর্ঘ ছুটির কারণে মেয়েদের বিয়ের হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে মাসের পর মাস বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ সেশনজটের সম্মুখীন হচ্ছে।

আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের বাইরে শহরের আশপাশে বিভিন্ন মেস বা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমানে করোনার কারণে হলে কোনো শিক্ষার্থী অবস্থান করছে না। অনেক শিক্ষার্থী এখন মেস বা বাসায় আসতে শুরু করেছে। করোনার শুরু থেকেই কিছু শিক্ষার্থী অবশ্য মেসে থেকে বিসিএসের মতো সরকারি ও অন্যান্য চাকরির জন্য পড়াশোনা করছে।

ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা তাদের সিলেবাসভিত্তিক পড়াশোনার বাইরেও সহশিক্ষামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকেন। যেমন: সভা, সেমিনার, কর্মশালা, বিজ্ঞানমেলা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, গণিত ও রসায়ন অলিম্পিয়াড, আবৃত্তি সংগঠন, ফটোগ্রাফি, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ব্যান্ড সংগীত ইত্যাদি। এ ছাড়াও দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মানবিক, জেলাভিত্তিক, বিভাগভিত্তিকসহ বিভিন্ন সংগঠন তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। করোনায় ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় দক্ষতা, উন্নয়নমূলক, সাংস্কৃতিক, স্বেচ্ছাসেবী ও অন্যান্য সংগঠনের সরাসরি সব কার্যক্রম প্রায় বন্ধ বললেই চলে।

অনলাইনে অতীব প্রয়োজনীয় কিছু প্রোগ্রামের আয়োজন করা হলেও ডিভাইস ও দুর্বল ইন্টারনেটের কারণে তা ভালোভাবে সম্পন্ন হচ্ছে না। এসব সংগঠন থেকে শিক্ষার্থীরা যে সেবাগুলো প্রদান করত সেগুলো থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে মানুষ। যদিও নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার জন্য সংগঠনগুলো অনলাইনে বিভিন্ন মিটিং, আলোচনা, আড্ডা, অনুষ্ঠান করার চেষ্টা করছে; কিন্তু সেটিও খুব একটা ফলপ্রসূ হচ্ছে না।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে অনেক দেশ আবার লকডাউনে যাচ্ছে। কিন্তু তারপরও মানুষ ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে শুরু করেছে। করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের দেশেও অনেক মানুষ তাদের স্বজন হারিয়েছেন। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন, অনেকের চাকরি থাকলেও কম বেতন পাচ্ছেন, আবার কারও চাকরি আছে কিন্তু বেতন পাচ্ছেন না। কেউ কেউ ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। পৃথিবীর অনেক বড় বড় কোম্পানি তাদের ব্যবসা হারিয়ে দেউলিয়া হয়ে গেছে। তবে অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ করোনা মহামারির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট ভালোভাবেই কাটিয়ে উঠতে পেরেছে।

রাত যত গভীর ও অন্ধকার থাকুক না কেন, এক সময় ভোর হবে। যথানিয়মে সূর্য উঠবে এবং অন্ধকারও কেটে যাবে। প্রকৃতির নিয়মেই পৃথিবীর সবকিছু পরিচালিত হবে। এক সময় এ মহাদুর্যোগ কাটিয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রিয় ক্যাম্পাসে ফিরতে পারবে। আবার মেতে উঠবে আনন্দ, উল্লাস আর উন্মাদনায়।

মো. বাবুল হোসেন : জনসংযোগ কর্মকর্তা, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ০৩ জানুয়ারি ২০২১ /এমএম

 


Array