প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: আতংক আর আলোচনার ঘটনাবহুল সমাপ্তিতে বিশ্ব ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে ২০২০, স্বাগত ২০২১! করোনা ভাইরাস তথা কোভিড ১৯ বছরের বেশীর ভাগ জুড়েই টালমাটাল করে রেখেছিল সারা বিশ্বকে। অর্থনীতি, রাজনীতি, আর সমাজব্যবস্থায় এক কঠিন সময় পার করছে সারা পৃথিবী, জীবন নিয়ে আতংকিত বিশ্ববাসী এখনো সুসময়ের প্রত্যাশায় প্রহর গুণছে। প্রতিদিনই প্রিয়জন আর বহু গুণী মানুষের বিদায়ে বিষন্নতা ই যেন আমাদের নিয়ত সংগী হয়ে উঠছে।
এই প্রাণঘাতি মহামারী প্রিয় জন্মভূমির প্রায় দু’শতাধিক মেধাবী চিকিৎসক সহ কিংবদন্তিতূল্য জাতির অনেক শ্রেষ্ঠ সন্তানদের কেঁড়ে নিয়েছে, এ বছরে জাতীয় অধ্যাপক ডঃ আনিসুজ্জামান, বরেণ্য কৃতিমান অধ্যাপক ডঃ জামিলুর রেজা চৌধুরী সহ মহান কৃতিমান মানুষদের অকাল প্রয়ান সত্য আর সুন্দরের লড়াইকে যেমন নেতৃত্ব সংকটে আবর্তিত করছে, তেমনি চতুর্থ শিল্প বিপ্লব কে সামনে রেখে যমুনা গ্রুপের নুরুল ইসলাম বাবুল, পারটেক্সের আবুল হাশেম এর মতো সৃষ্টিশীল মানুষদের বিদায় জাতিকে অপূরনীয় ক্ষতির সম্মুখীন করছে।
সারাবিশ্বে এ যাবত প্রায় ১৮ লক্ষ মানুষের প্রাণহানীর পরেও মহামারীর দাপটে তামাম দুনিয়া আজও অস্থির, এরই মাঝে ব্রিটেনে নতুন প্রকৃতির আর এক অনুজীব মানব জাতির সামনে নতুন সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের সামনে ছেড়ে দিয়েছে এক নতুন চ্যালেঞ্জ।
দ্রুততম সময়ে করোনা ভ্যাক্সিনের আবিষ্কার আশার আলোর সঞ্চার করলে ও কবে নাগাদ প্রতিটি মানবসমাজ ভ্যাক্সিন সুবিধার আওতায় আসবে, সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া মোকাবিলা করে ব্যক্তি তার সুস্থ জীবনে প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করবে, এর সবই যখন এখনো সম্ভাবনার স্তরে, তার মাঝে ৭০% দ্রুত ছড়ানোর ক্ষমতা সম্পন্ন নতুন ভাইরাস ২০২১ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞান কে হয়তো আরও বেশী ব্যতিব্যস্ত করে তুলবে।
করোনা ভয়াবহতার পাশাপাশি বিশ্ব রাজনীতির মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদের উত্থান অসহিষ্ণু, উম্মাদ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আস্ফালন মধ্যপ্রাচ্য সহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তিকেই অস্থিরতার আবরণ তৈরী করেছিল। অর্থনীতির মোড়ল চীনের সাথে বাক বিতন্ডা আর স্নায়ুযুদ্ধ, বিশ্ব শান্তির পথে কোন আলোর পথ দেখাতে পারেনি। মেয়াদ শেষে জাতীয় নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার নির্লজ্জ অব্যাহত প্রচেষ্টার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কলংকের ইতিহাসে ট্রাম্পের নামটি হয়তো শীর্ষ তালিকায় ই স্থান পাবে।
বাইডেন আর কমলা হ্যারিসের নেতৃত্বে ডেমোক্র্যাটদের বিজয় অভ্যন্তরীণ মার্কিনী সমাজ ব্যবস্থায় সাময়িক শান্তির সুবাতাস নিয়ে এসেছে। কল্যাণ রাষ্ট্র কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা ও অর্থনীতির চরম দুঃসময়েও জনগনের পাশে থেকে ত্রাতার ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। দূর্যোগে মোকাবেলায় মানবপ্রেমী সরকার প্রধানদের তালিকা হলে, তার নামটি যে সর্বাগ্রে থাকবে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই বললেই চলে।
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যতম মোড়ল বৃহত্তম গনতান্ত্রিক দেশ ভারত কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে ২য় অবস্থানে, সেই সাথে অর্থনীতির নানাবিধ চ্যালেঞ্জ দেশটিকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। ১৯৪৭ এর পর থেকে নানা প্রতিকুলতাকে অতিক্রম করে যে দেশটি বৃহত্তম ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিল, হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি সরকারের নানাবিধ কার্যক্রম অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় চরম হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের পথে সৃষ্টি হচ্ছে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ।
পুরো ২০২০ জুড়েই উগ্র হিন্দুত্ববাদ সমাজব্যবস্থাকে তছনছ করেছে, নাগরিকত্ব আর এনআরসি বিল ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, ভয়াবহ হিন্দু মুসলিম দাংগা রক্তাক্ত করেছে দিল্লির পথ প্রান্তর, বছর শেষে কৃষক বিদ্রোহে গলদঘর্ম হয়েছে সরকার। এনআরসি আর নাগরিকত্ব আইন বিশকোটি মুসলিম অধ্যুষিত ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় অসন্তোষের স্থায়ী দাবানলের সৃষ্টি হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
বাংলাদেশে জীবন জীবিকার সুরক্ষায় কোভিড কালে শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক নীতি-কৌশলের সাফল্য পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশ কে ছাড়িয়ে গেলেও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার দৈন্যদশা ও ভয়াবহ দূর্নীতির চিত্র সমাজ ব্যবস্থাকে নিদারুণভাবে আতংকিত করেছে।
দূর্নীতিবাজ লক্ষীপুরের পাপলুর মতো কলংকের বরপুত্র আর তার আদুরে বধু অবৈধ অর্থ বিত্তের জোরে যখন আইন প্রনেতা হয়ে উঠেন,তখন অনিয়ম আর অনাচার প্রতিরোধে সরকার আর রাজনৈতিক দলগুলোর দেউলিয়াত্বের প্রমাণ ই জাতির সামনে ফুটে উঠেছে, পাপলুর শ্যালিকা পেশাবিহীন জেসমিন যখন ১৪৬ কোটি নগদ অর্থ সহ ৫০০ কোটি টাকার মালিক হয় তখন রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যবস্থাপনার চরম অস্বচ্ছ দৈন্যদশা ই দেশপ্রেমিক মানুষের হ্রদয়কে ক্ষতবিক্ষত করেছে।
ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নামে বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে বিদেশে পাচার করে পি কে হালদার আর কেরানী আফজালের মতো অগনিত মানুষরুপী দানবরা যখন প্রবাসে আবাস গড়তে সক্ষম হয় তখন শর্ষে ক্ষেতে ভুতের আবাস নিয়ে চিন্তিত হয় রাত দিন খেটে যাওয়া কল্যাণকামী বাঙালী সমাজ।
দূর্নীতি দমন ব্যুরোর প্রধান আইনজীবী যখন ডয়েচে ভেলের সাক্ষাৎকারে পেরিফেরীতে আটকে যাওয়ার কথা বলেন,তখন আমার মতো অগনিত আশাবাদী মানুষ হতাশ হয়; নববর্ষে দেয়াল ভেঙে সক্ষমতা বৃদ্ধি করে যে কোন মূল্যে লোভাতুর এই দানবীয় গোষ্ঠীকে রুখে দেয়ার বিকল্প কোন পথ খোলা নেই।
‘রুখো লুটেরা, বাঁচাও স্বদেশ’ শিরোনামে একটি সামাজিক আন্দোলন কানাডা প্রবাসী লুটেরাদের অনেকটা একঘরে করে, বিলাসী জীবনযাত্রাকে কিছুটা থমকে দিতে পারলেও দ্রুত কার্যকর আইন প্রনয়নের মাধ্যমে এসব দূর্নীতিবাজদের দেশে থাকা সমস্ত সম্পদ রাষ্ট্রের আওতায় আনতে না পারার ব্যর্থতা সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টিকারীদের মনে হতাশার সৃষ্টি করছে। জনগণ আশান্বিত, জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০২১ হবে উন্নয়নের পথে দূর্নীতিবাজ রাঘব বোয়ালদের বিরুদ্ধে ইস্পাত-দৃঢ় সংগ্রামের সুকঠিন মাইল ফলক।
গত একযুগে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নানা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ২০৬৪ ডলারের গড় মাথাপিছু আয়, ৭% বেশি গড় প্রবৃদ্ধি, ৪২ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ দেশটির সক্ষমতারই বহিঃপ্রকাশ তবে উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে, প্রবৃদ্ধির সুফলকে তৃণমূলে পৌঁছাতে হলে বৈষম্য দূরীকরণে, কর ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নে কানাডার মতো কল্যাণ রাষ্ট্রের আদলে মেগা পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন অনেক সুফল বয়ে আনতে পারে, জাতির জনকের জন্ম শতবর্ষে তার ই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এটি ই হতে পারে জাতির জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার!
শেখ হাসিনা, শুধুমাত্র শেখ হাসিনার দৃঢ়তায় নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত দৃশ্যমান পদ্মাসেতু আন্তর্জাতিক অংগনে বাংলাদেশের বিস্ময়কর সক্ষমতার জানান দিয়েছে, গৌরবোজ্জ্বল করেছে দেশের ভাবমূর্তি, অর্থনীতির মোড়লদের কাছে অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় মর্যাদাবোধ। সেদিন বেশী দূরে নয় দেশের দক্ষিণাঞ্চলে অর্থনীতির প্রাণ চাঞ্চল্য শুরু হবে, যোগাযোগে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পাশাপাশি কোটি মানুষের কর্ম সংস্থান বদলে দেবে দৃশ্যপট, জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে যুক্ত হবে ১.২%, বছরে দারিদ্র্য কমবে ১.৯% (এডিবি)।
লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ,তবে আগামী দিনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক চাপকে বেগবান করতে আমাদের কুটনীতিকে আরও অনেক বেশী শক্তিশালী করার বিকল্প কোন পথ খোলা নেই।
জাতি আর কোন এনু, রুপন, জিকে শামিম আর ক্যাসিনো সম্রাটের উত্থান দেখতে চায় না, আওয়ামী লীগের উপ কমিটির সদস্য পরিচয়ে, মুজিব কোটের আড়ালে আর কোন রিজেন্ট শাহেদ তৈরী হোক এটিও প্রত্যাশিত নয়। আমলাদের বশীভূত করে জেকেজির মোহনীয় সুন্দরী সাবরিনা অতিস্মার্ট আরিফ আর পাপিয়াদের মতো কেউ অবৈধ বানিজ্যের রঙ্গশালা গড়ে তুলুক, সেটি ও আর কোনভাবেই কাঙ্খিত নয়।
বিগত বিজয় দিবস কে সামনে রেখে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির আস্ফালন ছিল সংবিধান আর সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ, জাতির জনকের ভাস্কর্য ভেঙে একাত্তরে পরাজিত শক্তি দেশের মানচিত্রকে ই ক্ষতবিক্ষত করেছিল। বঙ্গবন্ধু মুজিবের ভাস্কর্য আর প্রতিকৃতি পাকপ্রেমী অপশক্তির হ্রদয়ের দহন কে বাড়িয়ে দেয়, অসহ্য অন্তরজ্বালা নিবারনে ওরা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে মারমুখী হয়ে উঠে।
ধর্মভীরু সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে শান্তির ধর্ম ইসলামকে অপব্যবহার করে অপশক্তির ফায়দা হাসিলের প্রচেষ্টা মোটেও নতুন নয়। তাদের সংগে যে কোন গোপন সমঝোতা একদিকে যেমন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মানে বিরাট অন্তরায় হবে, অন্যদিকে আরেকটি ৭৫ সৃষ্টির সম্ভাবনা কে ও বাড়িয়ে দিতে পারে, বিপরীতে ইতিহাস, সামাজিক শিক্ষা, গনিত আর বিজ্ঞান কে বাধ্যতামূলক করে মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে ধর্মান্ধ সৃষ্টির পথকে ই চিরতরে রোধ করতে হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজন্ম লালিত বাসনা সুখী, সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলার পথে তার ই কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আরও দুর্বার গতিতে সকল প্রতিকূলতাকে জয় করে প্রিয় বাংলাদেশ এগিয়ে যাক- সেটিই হোক আজকের প্রত্যাশা! শুভ নববর্ষ!!!
লেখকঃ কলামিস্ট, উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক
ক্যালগেরি, কানাডা।
প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ২৯ ডিসেম্বর ২০২০/এমএম





