Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: ‘যে মানুষকে ভালোবাসে সে কোনোদিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না।’ বঙ্গবন্ধু তার এক ভাষণে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে এ কথা বলেছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘রাজনীতিতে যারা সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে, যারা সাম্প্রদায়িক- তারা হীন, নীচ, তাদের অন্তর ছোট। যারা এখানে মুসলমান আছেন তারা জানেন যে, খোদা যিনি আছেন তিনি রাব্বুল আলামিন, রাব্বুল মুসলিমিন নন। হিন্দু হোক, খ্রিস্টান হোক, মুসলমান হোক, বৌদ্ধ হোক- সব মানুষ তার কাছে সমান।’

আমরা লক্ষ করব জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার পরিণত বয়সে দেয়া এ ভাষণের আগেই একজন তরুণ নেতা থাকাকালে কেমন করে ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়, এমনকি রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সব শ্রেণির মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন। আমরা এ মহান মানুষটির ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র পরতে পরতে দেখব সম্ভ্রান্ত মুসলিম শেখ পরিবারের খোকা নামের ছেলেটি কেমন করে মহান মানুষ হয়ে উঠেছেন।

ফরিদপুর জেলে রাজবন্দি ওয়ার্ডে দুই কামরায় সাতজন বন্দি ছিলেন। ১৯৪৮ সালের ঘটনা, এক কামরায় চন্দ্র ঘোষ, মাদারীপুরের ফণী মজুমদার ও শেখ মুজিব। ফণী মজুমদার ছিলেন ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতা আর চন্দ্র ঘোষ ছিলেন সমাজকর্মী, যিনি জীবনে কোনো রাজনীতি করেননি, মহাত্মা গান্ধীর মতো একখানা কাপড় পরতেন, গোপালগঞ্জ মহকুমায় অনেক স্কুল করেছেন, কাশিয়ানী থানায় একটা ডিগ্রি কলেজ করেছেন, মহিলা কলেজ করেছেন, খাল কেটেছেন, রাস্তা করেছেন, স্থানীয় জনগণ মুসলমান-হিন্দু নির্বিশেষে ভালোবাসতেন তাকে।

কিন্তু ধর্মীয় রাজনীতির খেলায় এ লোকটিকে নির্যাতনের শিকার হয়ে জেলে বন্দি জীবনযাপন করতে হয়েছে দীর্ঘদিন। শেখ মুজিবুর রহমান জেলে অসুস্থ হলে সারারাত তার সেবা করেছেন ফণীবাবু ও চন্দ্রবাবু।

এর কিছুদিন পর আবার রাজবন্দি হিসেবে ফরিদপুর জেলে ফিরে এলে শেখ মুজিবুর রহমান দেখেন চন্দ্রবাবু হাসপাতালে ভর্তি, অবস্থা খুবই খারাপ তার, হার্নিয়ার অসুখ, পেটে চাপ দিয়েছিল, হঠাৎ নাড়ি উল্টে গলা দিয়ে মল পড়তে শুরু করেছে, যে কোনো সময় মারা যেতে পারেন, সিভিল সার্জন বাইরের হাসপাতালে নিয়ে অপারেশন করেছেন।

যাওয়ার সময় চন্দ্র শেখর বাবু জেল কর্তৃপক্ষকে বললেন, ‘আমাকে বাইরের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। আমার তো কেউ নেই। আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে একবার দেখতে চাই, সে আমার ভাইয়ের মতো। জীবনে তো আর দেখা হবে না।’

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখছেন, ‘‘সিভিল সার্জন এবং জেলের সুপারিনটেনডেন্ট, তাদের নির্দেশে আমাকে জেলগেটে নিয়ে যাওয়া হল। চন্দ্র ঘোষ স্ট্রেচারে শুয়ে আছেন। দেখে মনে হল আর বাঁচবেন না, আমাকে দেখে কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, ‘ভাই, এরা আমাকে ‘সাম্প্রাদায়িক’ বলে বদনাম দিল, শুধু এই আমার দুঃখ মরার সময়! কোনোদিন হিন্দু-মুসলমানকে দুই চোখে দেখি নাই। তোমার কাছে আমার অনুরোধ রইল, মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখ।

মানুষে মানুষে কোনো পার্থক্য ভগবানও করেননি। আমার তো কেউ নেই, আপন ভেবে তোমাকেই শেষ দেখা দেখে নিলাম। ভগবান তোমার মঙ্গল করুক।’ এমনভাবে কথাগুলো বললেন যে সুপারিনটেনডেন্ট, জেলার সাহেব, ডেপুটি জেলার, ডাক্তার ও গোয়েন্দা কর্মচারী সবার চোখেই পানি এসে গিয়েছিল। আর আমার চোখেও পানি এসে গিয়েছিল। বললাম, চিন্তা করবেন না, আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিস্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ।’’

এই যে ২৮ বছর বয়সের দৃঢ়চেতা তরুণ শেখ মুজিবের বাণী, তা যেন ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থের কাজী নজরুল ইসলামের ‘মানুষ’ কবিতার মূলসুর-

‘পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল! মূর্খরা সব শোনো

মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।’

সত্যি, ঔপনিবেশিক শাসকদের চাপিয়ে দেয়া সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প আজও জ্বলছে উপমহাদেশে। আর এই ছোট্ট ভূখণ্ডের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বপ্নের মানবিক পৃথিবী গড়ার প্রত্যয়ে যার নেতৃত্বে মুক্ত হয়েছে পরাধীন দেশ, আমরা পেয়েছি নতুন পতাকা স্বাধীনতার অনন্য স্বাদ; তিনি শুধু বঙ্গ বা বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিতেই একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের প্রতিনিধি হয়েও তিনি তার নীতি থেকে এক পাও সরে দাঁড়াননি।

তিনি সদ্যস্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ১৯৭৩ সালে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে অংশ নিলে লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফি এবং সৌদি বাদশাহ ফয়সাল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়াসহ সব সুযোগ-সুবিধা দেয়ার শর্তে বাংলাদেশকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ দেশ হিসেবে ঘোষণার কথা বললে বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট জানিয়ে দেন- ‘এটা সম্ভব নয়। কারণ বাংলাদেশ সবার দেশ। মুসলমান, অমুসলমান- সবারই দেশ।’

বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়তা মুগ্ধ করেছে সারাবিশ্বের নেতাকর্মীদের। সত্য, সুন্দর ও অসাম্প্রদায়িকতার শর্তে তিনি কখনই আপস করেননি। কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে বলেছিলেন- ‘আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনিই হিমালয়।’ ফিদেল কাস্ত্রোর এ উক্তির যথার্থতা বাঙালি উপলব্ধি করতে পেরেছিল।

মানবপ্রেমে বঙ্গবন্ধু চণ্ডীদাসের চিন্তা ধারণ করেছিলেন ধর্মকেন্দ্রিকতা থেকে উপরে দাঁড়িয়ে। চণ্ডীদাস যেখানে বলেছিলেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’; বঙ্গবন্ধু সেখানে নিজ দেশের মানুষের প্রেমে আবেগাপ্লুত হয়ে বলেছিলেন- ‘কোনো জেল-জুলুমই আমাকে টলাতে পারেনি, কিন্তু মানুষের ভালোবাসা আমাকে বিব্রত করেছে।’

রাজনীতির মহাকবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেন রবির কিরণ আর নজরুলের ধূমকেতু হয়ে এই বাংলায়

জন্মেছেন আপন মহিমায়। ব্রিটিশ শাসনে টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রাজনীতিতে মুজিবের বিচরণকে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়-

‘আজি এ প্রভাতে রবির কর

কেমনে পশিল প্রাণের পর,

কেমনে পশিল গুহার আঁধারে

প্রভাত পাখির গান!’

খোকার জন্ম এই বাংলার বুকে নতুন সূর্যের আশা জাগানিয়া জয়গান হয়ে আসে। রবির প্রভাতের নতুন সূর্যের মতো খোকা যেমন ছিল তার বঙ্গের মানুষের কাছে কোমলপ্রাণ আবেগী, তেমনি দেশমাতৃকার স্বার্থের প্রশ্নে এবং অধিকার আদায়ে প্রতিটি ঝঞ্ঝা সরিয়ে নতুন আলোর দিশারী।

পাকিস্তানিদের সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতমূলক মানসিকতার জাঁতাকলে বাঙালি যখন অতিষ্ঠ, তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতির হাল ধরেছেন, আর প্রতিষ্ঠা করেছেন অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক পরিবেশ। ১৯২০ সালে যে বছর বঙ্গবন্ধুর জন্ম, সে বছর তুরস্কে ইউরোপীয় আগ্রাসনের ফলে ধ্বংসস্তূপের উপর প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার একজন নেতা ক্ষমতায় আসেন, যার নাম কামাল আতাতুর্ক।

ঠিক তার ৫২ বছর পর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমপ্রধান দেশে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান গড়েন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের সরকার। তেজোদীপ্ত শেখ মুজিব সম্পর্কে হেনরি কিসিঞ্জার ভোল পাল্টে ফেলেন- ‘আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মতো তেজী ও গতিশীল নেতা আগামী বিশ বছরের মধ্যে এশিয়া মহাদেশে আর পাওয়া যাবে না।’

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র শুরুতেই বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এ নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’

১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার খবরে মর্মাহত জেমস লামন্ড বলেছেন- ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশই শুধু এতিম হয়নি, বিশ্ববাসী হারিয়েছে একজন মহান সন্তান।’ প্রকৃতই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতি বাঙালি জাতিকে করে দিয়েছিল দিশেহারা।

যে দেশের মানুষের জন্য তিনি তার জীবনের ১২টা বছর কাটিয়েছেন জেলে, বাকি জীবনটা ব্যয় করেছেন দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে; সেই মানুষটাকেই এ দেশের কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ নৃশংসভাবে হত্যা করে। তবে জাতির পিতা শারীরিকভাবে উপস্থিত না থাকলেও মিশে আছেন আমাদের অস্তিত্বে, আমাদের মজ্জায়। বঙ্গবন্ধু শুধু তার নিজ দেশেরই নেতা নন, তিনি সারা মানবিক পৃথিবীর নেতা হিসেবে বিবেচিত আজ।

সৈয়দা রেশমা আক্তার লাবণী : লেকচারার, জেনারেল এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ২০ ডিসেম্বর ২০২০/এমএম


Array