প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: ১৯৭১ সালে বাংলাদেশজুড়ে যে পাশবিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড তার মধ্যে অন্যতম। এ পাশবিক হত্যাকাণ্ড গোটা বাঙালি জাতির হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ শুরু করে দিয়ে গিয়েছিল; সেই রক্তক্ষরণের শব্দতরঙ্গ যেন আজও শোনা যায়। বিশেষ করে একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তান এবং পরিবারের অন্য সদস্যরা; যারা প্রিয়জন হারানোর সেই অবর্ণনীয় যন্ত্রণা বুকে চেপে ধরে আছেন; তারা আজও সেই রক্তস্রোতের শব্দ শুনতে পান।
বছর ঘুরে ঘুরে ১৪ ডিসেম্বর যখন ফিরে আসে, যন্ত্রণাসিক্ত তাদের ভগ্নহৃদয়ে সেই স্রোতের শব্দই যেন প্রতিধ্বনিত হয়। দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা পূর্বকল্পিত নীলনকশানুসারে ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাপকহারে বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যা করলেও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নয় মাসব্যাপী দেশজুড়ে এ বুদ্ধিজীবী নিধন অভিযান অব্যাহত ছিল।
২৫ মার্চ দেশব্যাপী ক্র্যাকডাউনের শুরু থেকেই ঢাকা ও বাইরের প্রতিটি জেলায় এ বাছাইকৃত হত্যাকাণ্ডের সূচনা হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রতিটি ঘটনাই ছিল নিদারুণ, ভয়ংকর এবং মর্মস্পর্শী। একটি ঘটনা থেকে আরেকটি ঘটনা যেন আরও বেশি মর্মান্তিক। বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের সৈয়দপুরে ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল ঘটে যাওয়া এমনই একজন শহীদ বুদ্ধিজীবীর মর্মান্তিক পরিণতির কথা তুলে ধরব।
শহীদ এ বুদ্ধিজীবীর নাম প্রকৌশলী মো. ফজলুর রহমান। ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল প্রকৌশলী মো. ফজলুর রহমানকে তার ছোটভাই মো. রফিকুল ইসলাম ও ভাগ্নে মো. আনোয়ার হোসেনসহ অন্য অনেকের সঙ্গে পাক সেনাসদস্যরা নৃশংসভাবে হত্যা করে এবং সৈয়দপুর সেনানিবাসের অভ্যন্তরেই গণকবর দেয়। শহীদ বুদ্ধিজীবী মো. ফজলুর রহমানের মর্মান্তিক এ ঘটনাটি অনেকদিন লোকচক্ষুর আড়ালেই ছিল।
তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তার ভাগ্যে কী ঘটেছিল দীর্ঘদিন তা অজানাই রয়ে গিয়েছিল। যদিও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের অষ্টম খণ্ডে তার অন্তর্ধানের বর্ণনা অন্তর্ভুক্ত আছে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার কী পরিণতি হয়েছিল সে সম্পর্কে ২০১০ সালের এপ্রিলে গণকবরের খোঁজ না পাওয়া পর্যন্ত তা সবার অজানাই রয়ে গিয়েছিল।
শহীদ বুদ্ধিজীবী মো. ফজলুর রহমান ২৮ জুন ১৯৩৮ সালে নরসিংদী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তার পিতা মরহুম তোরাব আলীর তৃতীয় সন্তান ছিলেন। ১৯৫৮ সালে ঢাকার তৎকালীন আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে পাস করে তরুণ প্রকৌশলী হিসেবে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন গৃহসংস্থান পরিদফতরে চাকরিতে যোগ দেন।
১৯৭১ সালে তিনি সৈয়দপুর সেনানিবাসে উপবিভাগীয় প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর ১৯৪৭ সালে ভারতের বিহার রাজ্য থেকে তৎকালীন রংপুর জেলার সৈয়দপুর থানায় আগত বিহারি মুসলমানদের পুনর্বাসনে যে কলোনি নির্মাণ করা হয়, তার তদারকির ভার শহীদ প্রকৌশলী মো. ফজলুর রহমানের ওপর ন্যস্ত ছিল। পাশাপাশি সৈয়দপুর সেনানিবাসের সার্বিক রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্প্রসারণের কাজও সম্পন্ন হয় তারই তত্ত্বাবধানে।
সৈয়দপুরে বদলি হয়ে যাওয়ার পর ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত স্থানীয় সংসদ সদস্য ডা. জিকরুলসহ অন্য রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে শহীদ মো. ফজলুর রহমানের পরিচয় হয়। পরিচয়ের পর থেকেই তিনি এসব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন ও নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন।
’৭১-এর মার্চের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হলে তাদের এ যোগাযোগ আরও বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া সৈয়দপুর অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারি হওয়ার সুবাদে পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও সৈয়দপুর শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। মার্চের গণজোয়ারের দিনগুলোতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও শহরের গণ্যমান্য বাঙালি ব্যক্তিরা রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ঘনঘন ঘরোয়া সমাবেশে মিলিত হতেন।
শহীদ ফজলুর রহমানের বাসায়ও এ ধরনের সমাবেশ বসেছিল। ২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যা শুরু হলে বেশ কয়েকজন স্থানীয় সাহসী বাঙালি তরুণ যুবক সৈয়দপুরের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে পরামর্শের জন্য শহীদ মো. ফজলুর রহমানের সঙ্গে তার বাসায় গোপনে দেখা করেন; যা তার অফিসের অবাঙালি ড্রাইভার আবিদ হোসেন লক্ষ করে এবং ৩১ মার্চ সৈয়দপুরে গণহত্যা শুরু হলে সৈয়দপুর সেনানিবাসের পাকিস্তান সেনা কর্তৃপক্ষকে সে খবরটি জানিয়ে দেয়।
এরপর ১ এপ্রিল বিকাল আনুমানিক ৪:৩০ ঘটিকায় ক্যাপ্টেন ফিদার নেতৃত্বে একদল পাকিস্তানি সেনাসদস্য শহীদ মো. ফজলুর রহমানের বাসা ঘেরাও করে। ক্যাপ্টেন ফিদা তার লোকবল নিয়ে শহীদ ফজলুর রহমানের সরকারি বাসায় প্রবেশ করেই বাসার সম্মুখের ফুলের বাগানে সবাইকে লাইন ধরে দাঁড়াতে বলে। শহীদ ফজলুর রহমানের বাসায় তখন তার ছোটভাই রংপুর মেডিকেল কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্র মো. রফিকুল ইসলাম, ভাগ্নে ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী মো. আনোয়ার হোসেন ও বাগানের মালি রুহুল আমীন অবস্থান করছিলেন।
ক্যাপ্টেন ফিদার কথা অনুযায়ী স্ত্রী, পুত্র ও কন্যাসহ শহীদ ফজলুর রহমান সবাইকে নিয়ে বাগানে লাইন ধরে দাঁড়ান। এ সময় দেড় বছরের কন্যাসন্তান রুমা তার কোলে ছিল। ক্র্যাকডাউন শুরু হলে তিনি নিয়মিত পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করতেন। এজন্য তিনি একটি কাপড়ের থলিতে ছোট্ট কোরআন শরিফ রেখে গলায় ঝুলিয়ে রাখতেন। সেদিনও সেই কোরআন শরিফটি তার গলায় ঝোলানো কাপড়ের থলিতে ছিল। ক্যাপ্টেন ফিদা প্রথমেই শহীদ ফজলুর রহমানের সহধর্মিণী বেগম সুরাইয়া রহমানকে বাচ্চাদের নিয়ে লাইন থেকে সরে বাসার অভ্যন্তরে চলে যেতে বলে।
বেগম সুরাইয়া শহীদ ফজলুর রহমানের কোল থেকে অবুঝ মেয়ে রুমাকে নামিয়ে আনতে গেলে রুমা কিছুতেই পিতার কোল থেকে নামতে রাজি হল না বরং উল্টো বাবাকে সে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। এমন সময় ক্যাপ্টেন ফিদা মুখে অকথ্য গালি দিয়ে শহীদ ফজলুর রহমানের কোল থেকে ছোঁ মেরে রুমাকে বাগানের মাটিতে ছুড়ে ফেলে দেয়। মাটিতে পড়ে রুমা তীব্র চিৎকারে কেঁদে ওঠে। শুধু তাই নয়, বর্বর ফিদা শহীদ ফজলুর রহমানের গলায় ঝোলানো কাপড়ের থলিতে রাখা পবিত্র কোরআন শরিফকেও মাটিতে ছুড়ে ফেলে।
অবস্থা সঙিন দেখে বেগম সুরাইয়া মেয়েকে মাটি থেকে কোলে তুলে দ্রুত তার ৬-৭ বছরের ছেলে নাজমুল আহসান অঞ্জুকে নিয়ে ঘরের ভেতরে চলে যান। বেগম সুরাইয়া বাসার ভেতরে প্রবেশ করার মুহূর্তে শহীদ ফজলুর রহমান, তাদের জন্য চিন্তা না করে সন্তানদের ভালোভাবে দেখে রাখতে স্ত্রীকে অনুরোধ করেন। এটাই ছিল সুরাইয়া রহমানের সঙ্গে শহীদ ফজলুর রহমানের শেষ কথা। সুরাইয়া রহমান ঘরে চলে যাওয়ার পর হানাদাররা শহীদ ফজলুর রহমানসহ অন্যদের পিছ মোড়া করে বেঁধে বাসা থেকে আনুমানিক ৫০০ গজ দূরে অবস্থিত একটি বিশাল আকৃতির মাঠে ধরে নিয়ে যায়। মাঠটি সেনানিবাসের এক প্রান্তে অবস্থিত। এলাকাটি ছিল জনমানবশূন্য।
সেখানে আগে থেকে আরও ৭-৮ জন হতভাগ্য বাঙালিকে ধরে নিয়ে এসে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। পাকসেনারা শহীদ ফজলুর রহমানদেরও একই লাইনে দাঁড় করায়। এমন সময় ক্যাপ্টেন ফিদা লাইনে দাঁড়ানো দু’জন বাঙালিকে আলাদা করে পাশে দাঁড় করিয়ে রাখে। বেলা প্রায় ডুবুডুবু। ঘড়ির কাঁটায় তখন আনুমানিক ৬টা বেজে ১০ মিনিট। দূরের কোথাও কোনো মসজিদ থেকে তখন মাগরিবের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছিল। এমনি পরিবেশে ক্যাপ্টেন ফিদা ও তার দল সাব-মেশিন গান দিয়ে ব্রাশফায়ার করে সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
হত্যা করেই নরপিশাচের দল শান্ত হয়নি; বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সবার মৃত্যু নিশ্চিত করে। এখানেই শেষ নয়, মাটিচাপা দেয়ার আগ মুহূর্তে শহীদের মৃতদেহকে করা হয় চূড়ান্ত অসম্মান। বেঁচে যাওয়া ওই দু’জন বাঙালিকে দিয়ে একে একে সব মৃতদেহ মাটির গর্তে ফেলে দেয়া হয়। এরপর যে ঘটনা ঘটেছে, তা যেন বর্ণনাতীত। তিনজন সৈনিক প্যান্টের জিপার খুলে মৃতদেহের ওপর প্রস্রাব করা শুরু করে।
ভবিষ্যতে যাতে কেউ চিহ্নিত করতে না পারে সেজন্য পাকিস্তানি সেনারা মৃতদেহগুলোকে মাটিচাপা দিয়ে সেনানিবাসের বিভিন্ন স্থান থেকে নোংরা আবর্জনা সংগ্রহ করে এনে গণকবর ঢেকে দেয় এবং সেদিন থেকেই সৈয়দপুর সেনানিবাসের কেন্দ্রীয় ডাস্টবিন হিসেবে এ গণকবরকে ব্যবহার করা শুরু করে। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৩৯ বছর পর্যন্ত কেউ জানতেও পারেনি সৈয়দপুর সেনানিবাসের কেন্দ্রীয় ডাস্টবিনের আবর্জনা স্তূপের নিচেই শুয়ে আছে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্বোচ্চ আত্মোৎসর্গকারী সূর্য সন্তানরা।
অপরদিকে বেগম সুরাইয়া ওদের সবার ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকে। সারা রাত অপেক্ষার পর ওরা ফিরে না এলে তিনি ছোট বাচ্চাদের নিয়ে একা বাসায় অবস্থান করাটা নিরাপদবোধ করছিলেন না। অতঃপর ২ এপ্রিল খুব ভোরেই তিনি তার দুই সন্তানকে নিয়ে বাসা ত্যাগ করে স্থানীয় পলিটেকনিক্যাল ইন্সটিটিউশনে স্থাপিত আশ্রয় কেন্দ্রে চলে যান। তাদের গৃহ ত্যাগের পরপরই ড্রাইভার আবিদের নেতৃত্বে একদল বিহারি বাসার সব জিনিসপত্র লুটপাট করে নিয়ে যায়।
শহীদ ফজলুর রহমানদের ধরে নিয়ে যাওয়ার পর বেগম সুরাইয়া জানতেও পারেননি তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল! পাকিস্তানি সেনারা তাদের হত্যা করবে সে চিন্তাও মাথায় আসেনি। তিনি ভেবেছিলেন জিজ্ঞাসাবাদের পর হয়তো ছেড়ে দেবে। কিন্তু ওরা কেউ ফিরে আসেনি। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত বেগম সুরাইয়া রহমান তার স্বামীর ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিলেন। বিশ্বাস ছিল, তার স্বামীকে হয়তো বন্দি করে পাকিস্তানে নিয়ে আটক করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৪ সালে যখন আন্তর্জাতিক রেডক্রসের মাধ্যমে পাকিস্তানে আটকে পড়া সব বাঙালির বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হল, অথচ তার স্বামী ফিরে এলেন না, তখন থেকে তিনি ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে শুরু করলেন, ওরা কেউ আর ফিরে আসবে না।
শহীদ ফজলুর রহমানের ছোটভাই মো. রফিকুল ইসলাম রংপুর মেডিকেল কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। ১৯৭১ সালের মার্চের উত্তাল আন্দোলনের সময় ক্লাস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি ঢাকায় পিতামাতার কাছে ফিরে না গিয়ে সৈয়দপুরে ভাইয়ের বাসায় গিয়ে উঠেছিলেন। রফিকুল ইসলাম স্বাধীনতা যুদ্ধে রংপুর মেডিকেল কলেজের একমাত্র শহীদ শিক্ষার্থী।
এ কারণে তার সম্মানার্থে রংপুর মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ কলেজের মিলনায়তনটির নামকরণ করেন শহীদ মো. রফিকুল ইসলাম মিলনায়তন। ভাগ্নে মো. আনোয়ার হোসেন তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী ছিলেন এবং তিনি মামার বাসায় থেকে রাজশাহী বোর্ডের অধীনে সৈয়দপুর থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলেন।
দীর্ঘ ৩৯ বছর পর ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে সৈয়দপুর সেনানিবাসের মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিস (গঊঝ ধৎসু)-এর অবসরপ্রাপ্ত প্লাম্বার মিস্ত্রি আক্তারুল ইসলাম ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরে কর্মরত ফয়েজ উদ্দিনের সহযোগিতায় গণকবরটির সন্ধান পাওয়া যায়।
উল্লেখ্য, আক্তার ও ফয়েজ উদ্দিনই ছিলেন ১ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে বেঁচে যাওয়া সেই দুই ভাগ্যবান বাঙালি, যারা শহীদ মো. ফজলুর রহমানসহ অন্য সবার হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী। ফয়েজ এবং আক্তার সেদিনের সেই মুহূর্তে সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় একই পাকসেনা দলের হাতে ধরা পড়েন এবং তাদের দিয়েই মাটি কাটিয়ে পাকসেনারা শহীদদের গণকবর দিয়েছিল।
২০১০ সালের এপ্রিল মাসে বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী শহীদ ফজলুর রহমানের ছেলে মো. নাজমুল আহসান অঞ্জু মাকে নিয়ে যখন দীর্ঘদিন পর পিতার মৃত্যুবার্ষিকী পালনের উদ্দেশ্যে সৈয়দপুরে যান, তখন সৈয়দপুরের স্থানীয় একটি পত্রিকায় তার সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারের শিরোনামটি ছিল এ রকম ‘নাজমুল আহসান অঞ্জু আজও স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত তার পিতার কবর খুঁজে ফিরছেন’।
সংবাদপত্রে এ খবরটি পড়ে সৈয়দপুর বিমানবন্দরে কর্মরত ফয়েজ সঙ্গে সঙ্গে প্লাম্বার মিস্ত্রি আক্তারের কাছে ছুটে যান এবং তাৎক্ষণিক উভয়ে সংবাদপত্রে উল্লেখিত ঠিকানায় শহীদ ফজলুর রহমানের সহধর্মিণী ও পুত্রসন্তানের সঙ্গে দেখা করে সৈয়দপুর সেনানিবাসের কেন্দ্রীয় ডাস্টবিনের নিচে শহীদের গণকবরটি দেখিয়ে দেন। এখানে উল্লেখ্য, ফয়েজ ১৯৭১ সালে শহীদ ফজলুর রহমানের বাসায় গরুর দুধ বিক্রি করতেন এবং আক্তার সৈয়দপুর সেনানিবাসে প্লাম্বার মিস্ত্রি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ওই মর্মান্তিক ঘটনার পর ফয়েজ এবং আক্তার ধরেই নিয়েছিলেন শহীদ ফজলুর রহমানের পরিবারের কোনো সদস্য আর বেঁচে নেই।
কিন্তু তারা জানতেন না, হত্যাযজ্ঞের পরদিনই ২ এপ্রিল বেগম সুরাইয়া রহমান পুত্র অঞ্জু ও কন্যা রুমাকে নিয়ে সেনানিবাসের বাসভবন ত্যাগ করে বিহারি অধ্যুষিত সৈয়দপুর শহরের বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে বেরিয়ে নিজেদের জীবন বাঁচিয়ে ছিলেন এবং আনুমানিক প্রায় দু’মাসেরও বেশি সময় ধরে এক দুর্বিষহ জীবন কাটিয়ে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় তার শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছতে সক্ষম হন। দীর্ঘ ৩৯ বছর পর সংবাদপত্রের ওই সাক্ষাৎকার পড়ে ফয়েজ ও আক্তার প্রথমবারের মতো জানতে পারলেন ওরা এখনও বেঁচে আছেন।
গণকবরের সন্ধান পাওয়ার পর সৈয়দপুর সেনানিবাস কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে কেন্দ্রীয় ডাস্টবিনটি সরিয়ে ফেলে এবং গণকবরটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শহীদদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ গণকবরের ওপর একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে।
পাক সেনাসদস্যরা শহীদ ফজলুর রহমানদের ধরে নিয়ে যাওয়ার পর বেগম সুরাইয়া রহমান তার সন্তানদের নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যে পথ ধরে সেনানিবাস ত্যাগ করেন, সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষ সে পথটিকে ‘শহীদ প্রকৌশলী মো. ফজলুর রহমান সড়ক’ নামকরণ করে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী শহীদ মো. ফজলুর রহমানকে শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে।
একেএম শামসুদ্দিন : সাবেক সেনা কর্মকর্তা
প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ১৪ ডিসেম্বর ২০২০/এমএম





