Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক ::  যারা জ্ঞানী, যাদের অন্তর্দৃষ্টি আছে তারা অনেক কিছুই সহজে বুঝতে পারেন। যেমন জহীরউদ্দীন মুহম্মদ বাবর, ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা।

অগাধ জ্ঞান, অন্তর্দৃষ্টি-দূরদৃষ্টি ও সাহসের অধিকারী না হলে মধ্য-এশিয়ায় পিতার সিংহাসন থেকে বিতাড়িত হয়ে বা পিতৃভূমিতে বারবার ভাগ্য বিপর্যয়ের পরও সুদূর ভারতের হিন্দু-মুলুকে এসে তিনশ’ বছরের বেশি স্থায়ী মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করা তার পক্ষে বোধকরি সম্ভব হতো না।

পানিপথের যুদ্ধে দিল্লির সুলতান ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করে নিজ বংশীয় শাসন প্রতিষ্ঠার (১৫২৬) পর মাত্র চার বছর বেঁচেছিলেন তিনি। কিন্তু এই স্বল্পকালের জীবন ও কর্ম বাবরকে কেবল ভারতের ইতিহাসে নয়, জগতের ইতিহাসে অমর করে রেখেছে।

জ্ঞান এক ঐশ্বরিক বস্তু, মানুষে মানুষে জ্ঞানের ভিন্নতা হয়ে থাকে। মানুষের মন বুঝতে পারাটা জ্ঞানী লোকদের একটি বিশেষ গুণ। বিষয়টি সাধারণ বা সামান্য নয়, এজন্য তাকে মানুষের মনের ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। তার মনস্তত্ত্ব জানা থাকতে হয়। আনুমানিক পাঁচশ’ বছর আগে বাঙালি বা বাংলাদেশের অধিবাসীদের সম্পর্কে এই মুঘলকুল চূড়ামণি যে মন্তব্যটি করে গেছেন, তা জাতীয়ভাবে আমাদের ক্ষেত্রে বোধকরি আজও সমানভাবে প্রযোজ্য।

তিনি যে স্মৃতিকথা লিখে গেছেন, বাংলা ভাষায় তার নাম ‘বাবরনামা’। অত্যন্ত মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ মূল বইটি চাঘতাই তুর্কি ভাষায় রচিত। সম্রাট আকবরের আমলে আবদুর রহিম খান-ই-খানান তা ফার্সিতে অনুবাদ করেন। ১৮২৬ সালে জন লেডেন ও উইলিয়াম আর্সকাইন বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। দুই খণ্ডে লেখা আনুমানিক সাতশ’ পৃষ্ঠার বইটি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন সুসাহিত্যিক প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ। বাবরের সমসাময়িক ভারতবর্ষের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায় এ গ্রন্থে।

এদিক দিয়ে ‘বাবরনামা’কে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিল বলে বিবেচনা করা হয়। গোটা হিন্দুস্তানের বিবরণ দিতে গিয়ে বাবর প্রধানত পাঁচজন সুলতান (মুসলিম শাসক) ও দু’জন রাজার (হিন্দু শাসক) নাম উল্লেখ করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছে বাংলা রাজ্য ও এখানকার সৈয়দ বংশীয় সুলতান নসরত শাহের কথা।

নসরত শাহের পিতা সুলতান আলাউদ্দিন হোসাইন শাহ। বিস্তারিত নয়, বাবরনামায় বাংলার বর্ণনা দিতে গিয়ে বাবর সামান্য ক’টি কথা উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, বাংলাদেশের একটি অদ্ভুত রীতি হচ্ছে এই যে, এখানে উত্তরাধিকার সূত্রে সিংহাসন দাবি করার সুযোগ নেই বললেই চলে। রাজার জন্য একটি সিংহাসন আলাদা থাকে। ওই রকম একেকটি আসন প্রত্যেক উজির, আমির ও মনসবদারের জন্য নির্দিষ্ট থাকে। বাংলাদেশের মানুষ এই সিংহাসন ও অন্যান্য আসনকে শ্রদ্ধা করে চলে। এর প্রতিটি আসনের সঙ্গে যুক্ত থাকে কতগুলো অনুচর, রক্ষী, চাকর, খানসামা ইত্যাদি।

যখন যে ব্যক্তি ওই আসনে বসেন, তিনি ওই আসনের অনুগামী লোকদের খেদমত পান। এমনকি সুলতান বা রাজার ব্যাপারেও এই রীতিই কার্যকর হয়ে থাকে। রাজাকে হত্যা করে যে কোনো ব্যক্তি তার সিংহাসনে বসুন না কেন, তাকেই সবাই রাজা বলে স্বীকার করে নেয়। আমির দরবারি, চাকর-বাকর সবাই তাকে সেই আনুগত্য ও শ্রদ্ধা দেয়; যারা নিহত রাজাকে আগে দিত।

বাংলার লোকে বলে : আমরা সিংহাসনকে মান্য করি; যিনি এখানে বসবেন তিনিই আমাদের আনুগত্য পাবেন (বাবরনামা, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ১৫৮-১৫৯)।’ পাঁচশ’ বছর হয়ে গেল বাবর মারা গেছেন। এ সময়ে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা দিয়ে অনেক জলরাশি গড়িয়েছে। মুঘল, পাঠান, ইংরেজ, পাকিস্তানি শাসন শেষে আমরা লাভ করেছি স্বাধীনতা- স্বশাসনের অধিকার ও ক্ষমতা।

আমরা এখন স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। কথা হল, বাংলাদেশের অধিবাসী সম্পর্কে বাবরের এহেন মূল্যায়নে কি কোনো অতিশয়োক্তি ছিল কিংবা কোনোরকমের অসঙ্গতি?

বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ০৮  ডিসেম্বর ২০২০/এমএম


Array