প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: ৫ ই মে ২০১৩ তারিখে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলাম কি এজেন্ডা নিয়ে সমাবেশ করেছিল, আর সমাবেশ শেষে ঢাকা দখলের নীলনকশায় কি ছিল আওয়ামীলীগ তথা সরকারের কি সে টি অজানা ছিল? মোটেই তা নয়, আর এজন্যই প্রয়াত তৎকালীন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ ও তার সংগীরা শেখ হাসিনার নির্দেশনায় অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথেই সেদিন দেশ বিরোধী অশুভ চক্রান্তকে রুখে দিতে সক্ষম হয়েছিল, তবে তৎ পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ কি এই সাম্প্রদায়িক অপশক্তি কে মোকাবেলার পক্ষে সহায়ক ছিল নাকি এই শক্তিকে আর ও সংগঠিত হওয়ার ই সুযোগ করে দিয়েছে?
মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্ব দানকারী দল আওয়ামী লীগ নানা চড়াই উতরাই পেড়িয়ে সরকারে এসে যে কয়টি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করেছে তার দু’টো হচ্ছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার আর যুদ্ধাপরাধীরের বিচারে ট্রাইবুন্যাল গঠন। জামাতে ইসলামী তার সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের মাধ্যমে গত ৪৫ বছরে মুক্তি সংগ্রামের চেতনার পরিপন্থী লক্ষ লক্ষ তরুণ যুবদের সমন্বয়ে অত্যন্ত সংঘবদ্ধ একটি প্রজন্ম তৈরী করতে সক্ষম হয়েছে, সুদক্ষ সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে সরকারের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরেই তাদের ভাবাদর্শের লোকদের বসাতে সক্ষম হয়েছে, অর্থনীতি আর বানিজ্যেও গড়ে তুলেছে এক শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। এমন পরিস্থিতিতে প্রচলিত আইনে যুদ্ধাপরাধী শীর্ষ নেতাদের বিচার করে ফাঁসির রায় কার্যকর করা মোটেও কোন সহজ কাজ ছিল না। দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবি, রাজনীতিকদের দীর্ঘ দিনের দাবী থাকলেও শাহবাগের আন্দোলন বিচারের এ দাবি কে গণদাবিতে রুপ দিয়েছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই।
শেখ হাসিনার দৃঢ়তা, আর গন বিস্ফোরণ ছিল বলেই মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী আর জাতিসংঘ মহাসচিবের অন্যায় দাবীকে অগ্রাহ্য করে ও শেখ হাসিনার সরকারের পক্ষে কলংক মুক্তির শপথ কে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছিল। কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর বিচারে প্রতিকী কলংক মুক্তি ঘটলেও তাদের অনুসারী লাখ লাখ নেতা কর্মী কি হারিয়ে গেছে? মোটেই নয়, বরং ছদ্মবেশে তাদের ই একটা অংশ সরকারের সংগে মিশে গেছে আর একটি অংশ অত্যন্ত সুচতুরভাবে ভাবে কৌশলী মেধা নিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অনুভুতিকে অপ ব্যবহারের মাধ্যমে সরকার কে অস্থির করে, উন্নয়ন কে বাধাগ্রস্ত করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে ভূলুণ্ঠিত করে ৭১ এর ব্যর্থতার প্রতিশোধ নিতেই ব্যস্ত। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শত বার্ষিকীতে যখন একটি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে জেলা ছাত্র শিবিরের সাবেক সভাপতি বর্তমানে যুগ্ম সচিব শোক দিবসের অনুষ্ঠানে সঞ্চালক ও সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন, আর প্রগতিশীল কর্মকর্তারা সাইড লাইনে বসে থাকেন তখন কি কারো বুঝতে অসুবিধা হয়, জাতির জনকের আদর্শকে ইজারা নিতে এই অপশক্তি অনেকদূর ই এগিয়ে গেছে!
আজ কুষ্টিয়ায় জাতির জনকের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়েছে। গত ক’দিন আগে মোমিনুল হক আর বাবুনগরী যে দম্ভোক্তি করেছিলেন, আজকের ন্যক্কারজনক ঘটনা তার ই ধারাবাহিকতা মাত্র। এই আঘাত শুধুমাত্র একটি ভাস্কর্যের ই অবমাননা নয়, এটি দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত,দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সর্বোপরি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সামপ্রদায়িক অপশক্তির এক সর্বনাশা চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জে বিজয়ী হওয়ার জন্য একদিকে যেমন প্রকাশ্য ফতোয়াবাজির মাধ্যমে ধর্মপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে দেশকে অশান্ত করার সুগভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছে, অন্যদিকে গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী এই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর নেতারা প্রধানমন্ত্রীর সংগে আলোচনার ও আগ্রহ প্রকাশ করেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, ৭১ এর এই পরাজিত শক্তির আলোচনার প্রস্তাব কে সরকারের অনুসারী কিছু কিছু বিজ্ঞ জন ইনিয়ে বিনিয়ে স্বাগত জানাচ্ছে।
ত্রিশ লক্ষ প্রাণ আর দু,লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সীমাহীন ত্যাগ তিতিক্ষা আর দূরদর্শী নেতৃত্বে যে চার মূলনীতির উপর বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম, এর কোন একটি অবজ্ঞা করে কেউ কি নিজেকে এই রাষ্ট্রের নাগরিক বলে দাবী করতে পারে? যারা স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে না, রক্তে অর্জিত সংবিধানে যাদের আনুগত্য নেই, ৭১এ ব্যর্থ হয়ে যারা ৭৫ এ প্রতিশোধ নিয়েছিল, গ্রেনেড হামলায় যারা শেখ হাসিনা ও তার দলকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ৭১ এ যে বিষয়গুলোর মিমাংসা হয়েছিল, সে-সব মিমাংসিত বিষয় নিয়ে সেই পাক-প্রেমী পরাজিত শক্তির দোসরদের সাথে আলোচনায় বসে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা কি বাবার রক্তের সংগে বেইমানী করবেন নাকি পবিত্র সংবিধান কে পদদলিত করে রাজাকার আল বদরের প্রতিভূদের সাথে আলোচনার টেবিলে বসবেন?
সীমাহীন অনিয়ম দূর্নীতির সাথে নিয়ত সংগ্রাম করেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের বিস্ময়কর সাফল্য আজ সর্বজনবিদিত। অনেকেই শেখ হাসিনা কে নীলকন্ঠি বলেন, তিনি নাকি বিষ খেয়ে বিষ হজম করতে পারেন। উন্নয়ন অগ্রগতির প্রশ্নে দেশের আনুগত্যে বিশ্বাস করেন,কিন্তু শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দর্শন কে ধারণ করেন না, এমন মানুষদের বিষ হজম করলেও চিরশত্রু আনুগত্যহীন দেশ বিরোধীদের সাথে যে কোন আলোচনা আর সমঝোতা শতাব্দীর মহানায়ক জাতির জনকের সাথে ঘৃণিত মোশতাকের সখ্যতা কে ই স্মরণ করিয়ে দেবে। নিয়ত সংগ্রামী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আপোষহীন,বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরী, উন্নয়নের প্রশ্নে আপোষ করলে ও পিতা মুজিবের দর্শন থেকে বিচ্যুত হতে পারেন না।
পৃথিবীর অন্যতম গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিবেশী ভারত, সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতা কে ধারণ করে নানা ধর্ম বর্ণের মানুষের সমন্বয়ে দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় যে সামাজিক সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল, মোদি সরকারের আগমনে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার উত্থান রাষ্ট্র টি কে অস্থির করে তুলেছে। বিজেপির আদর্শিক অভিভাবক খ্যাত আরএসএস তথা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের মুসলিম বিরোধী আগ্রাসী ভাবধারা এবং হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্টার অব্যাহত সাম্প্রদায়িক প্রচেষ্টা শত বছরের সাংস্কৃতিক সামাজিক ঐতিহ্য কে পদদলিত করে সে দেশে বসবাসকারী মোট জনসংখ্যার ১৪.২% তথা ২০ কোটি মুসলমান জনগোষ্ঠীকে ২য় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে ভাবতে বাধ্য করছে, ভোটাধিকার হরনের মতো প্রক্রিয়া ও চলমান যা সামাজিক সংহতি কে নষ্ট করছে নিষ্ঠুরভাবে, উন্নয়ন অগ্রগতিতে সৃষ্টি করছে সীমাহীন প্রতিবন্ধকতা। আরএসএস এর আদলে বাংলাদেশে গড়ে উঠা উগ্র মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদ ও আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার ক্যারিসম্যাটিক উন্নয়ন কে বাধাগ্রস্ত করে সামাজিক বন্ধন কে ভারসাম্যহীন করে তুলতে পারে, শেষ বিকেলে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও হতে পারে হুমকির সম্মুখীন, তাই সময় থাকতেই সাধু সাবধান!!
ডিসেম্বর বিজয়ের মাস।এ মাসে হায়েনাদের অন্তরজ্বালা বেড়ে যায়, বঙ্গবন্ধু মুজিবের প্রতিচ্ছবি তাদের হ্রদয়ের দহন কে বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে, তাই নেতা মুজিবের ভাস্কর্য প্রতিরোধে ডিসেম্বর কে ই এরা বেঁচে নিয়েছে।মুক্তি সংগ্রামের পঞ্চাশ বছরে, এ জাতির অর্জন অনেক। বিনিময় মূল্যে পাকিস্তানি রুপির চেয়ে টাকা এখন দিগুণ শক্তি শালী। অর্থনীতি, নারীর ক্ষমতায়ন, জন্ম মৃত্যু আর জনমিতির নানা সূচকে পাকিস্তান কে টপকিয়েছে বহু আগেই, এই অগ্রগতি প্রতিবেশী সহ অনেক আন্তর্জাতিক মুরুব্বীর ই অন্তরজ্বালার কারণ। দেশীয় আর আন্তর্জাতিক চক্র যারা প্রিয় বাংলাদেশ এর অভ্যুদয় ও অগ্রগতিকে আজও মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি সেই ঘৃণ্য অপশক্তি ই শাপলা চত্বরের ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে সামনে রেখে মরণ নেশায় মত্ত হয়েছে। সারাদেশে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প চলমান, মাতারবাড়ীতে চলছে উন্নয়নের মহাজজ্ঞ, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল বদলে দেবে যোগাযোগের চিত্র, শেখ হাসিনার জেদের ফসল পদ্মাসেতু ঘুরিয়ে দেবে দেশের দক্ষিনাঞ্চল – এতো সব নিকট সম্ভাবনা কে সামনে রেখে গর্জে উঠেছে শকুনের দল – এই হায়নাদের প্রতিরোধে কালক্ষেপণের সুযোগ কই!!!!
লেখকঃ উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক
ক্যালগেরী, আলবার্টা, কানাডা
প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ০৭ ডিসেম্বর ২০২০/এমএম





