Menu

মোঃ মাহমুদ হাসান ,ক্যালগেরি :: কিছুদিন থেকেই এক উদ্ভট ভাবনা আমায় পেয়ে বসেছে, দায় তথা ঋন শোধের ভাবনা। যে ব্যক্তি দায় বা ঋনগ্রস্ত সেই জানে এর যাতনা কত ভয়ংকর ও নির্মম, কত নিষ্ঠুর এর নিয়ত নির্যাতন। ঋণের যন্ত্রণায় পলাতক জীবন, আত্নগোপন, আত্নহননের মতো অগনিত উদাহরণ ও আমাদের সমাজে নতুন নয়। টানাপোড়েনের পরিবারে বেড়ে উঠা একজন শিক্ষক পিতার দায়গ্রস্ত সন্তান হিসেবে পিতা মাতার প্রতি দায়শোধে আমার নিয়ত সদিচ্ছা ও প্রচেষ্টা থাকলেও মোটেও তৃপ্ত নই, আর যে সমাজে বেড়ে উঠেছিলাম, সেই সমাজের ঋন তো আজ ও আমায় খুঁড়ে খুঁড়েই খাচ্ছে।

অজ পাড়া গায়ের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ-বিশ্ববিদ্যালয় অবধি দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় দায়বদ্ধতার যেন শেষ নেই, শিক্ষার সুযোগ দিয়ে সমাজ যেমন দায়বদ্ধ করেছে, দীর্ঘ পথে অর্থের যোগান দিয়ে পরিবার ও আমাকে ঋনের অক্টোপাসে আবদ্ধ করেছে। এ ঋন শোধে আমার মতো লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত তরুণ যুবক সারাজীবন ই তাদের প্রচেষ্টা কে ও অব্যাহত রাখছে।

বিশ্বাস করি আমার মতো হাজারো শিক্ষিত ডিগ্রীধারীরা পিতা মাতার ঋণশোধে নিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যান, কৃতজ্ঞতায় নতজানু হয়ে জীবন টা কে ই পার করে দেন, তবু ও আমার মতো লক্ষ লক্ষ মানুষ আজ অজানা এক দায় দেনায় অভিযুক্ত। আর এ দেনার অভিযোগকারী যখন রাষ্ট্রের নিয়ন্তারা, তখন বুঝতে ই পারেন, এ ঋন শোধ না করার পরিণিত কতটা ই ভয়াবহ হতে পারে।

প্রযুক্তির কল্যাণে তথ্যের জগত আজ উন্মুক্ত, আর এর সাথে সমন্বয় না করতে পারলে, এগিয়ে যাওয়ার বিকল্প কোন পথ খোলা নেই। কিছুটা দেরীতে হলে ও প্রিয় বাংলাদেশ ও এই সত্যি টি উপলব্ধি করতে পেরেছিল বলেই ডিজিটাল বাংলাদেশ – আজ একটি জনপ্রিয় শ্লোগান। প্রবাসে বসে ও আজ বাংলাদেশ কে ধারণ করা যায়- এটি নিতান্তই আনন্দের। সামাজিক আর গণমাধ্যমের সুবাধে প্রকাশ্যে আজ তথ্যের ভান্ডার।

আর এর সুবাদেই জানার সৌভাগ্য হয়, আমার শিক্ষায় শুধুই বাবা মায়ের অর্থই নয় রাষ্ট্রের ও বিনিয়োগ আছে, শুধু পিতা মাতা নয় আমি রাষ্ট্রের কাছেও ঋনগ্রস্ত, আর এ দায়টির কথা স্মরণ করিয়ে দেন স্বয়ং দেশের ই প্রধানমন্ত্রী। আমার উপলব্ধি আসে ঋণের অংকটি খুঁজে বের করার, অনুসন্ধানে মাধ্যম হয়ে উঠে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট। আদৌ কি রাষ্ট্রের কাছে আমার কোন দায় আছে?

যদি থাকেই তবে দেনার অংকটি কত? দেনার অংকটি না জানিয়ে রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে আমার মতো হাজারো উচ্চ শিক্ষিত তরুণ যুবককে দেশপ্রেমহীনতার দায়ে অভিযুক্ত করা কতটুকু ন্যায়সঙ্গত? এর জন্য কি শুধুমাত্র জ্ঞানপিপাসু শিক্ষার্থীরা ই দায়ী, নাকি নীতি প্রনয়ণ ও বাস্তবায়নের মহারথীরা ও এর দায়ভাগ নিবেন?

শিক্ষার মান আর নানাবিধ সুযোগ সুবিধায় মেডিকেল, প্রকৌশল সহ বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের  চাহিদা দেশের শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের কাছে এখনও আকাশচুম্বি। এর পিছনে একদিকে যেমন রয়েছেন মেধাবী শিক্ষকদের সান্নিধ্য লাভের আকাঙ্খা ও বৃহৎ পরিসরে জ্ঞান অর্জনের এক সুবিশাল ক্ষেত্র পাশাপাশি রয়েছে ব্যয় সাশ্র‍্যয়ের এক অবারিত সুযোগ। বিনামূল্যে ছাত্রছাত্রীদের আবাসন, নামমাত্র মুল্যে খাবার, আর প্রতিকী টিউশন ফি-এটি কে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মাসিক নয় টাকা ছাত্র বেতন, আর বিভিন্ন পরিক্ষার ফি বাবদ সর্বসাকুল্যে বছরে আনুমানিক এক হাজার টাকা, আর আবাসন, খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে সর্বোচ্চ বছরে ১২০০০ টাকা খরচ করলেই সাচ্ছন্দ্যে শিক্ষা অর্জন সম্ভব হতো, ডলার মূল্যে যার পরিমাণ ১৩০ ডলার মাত্র। বর্তমান সময়ে অন্ন,বস্ত্র আর বিলাসিতায় খরচের অংকটি বৃদ্ধি পেলেও টিউশন ফি র ক্ষেত্রে কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে বলে জানা নেই।

এতো সর্বনিম্ন খরচে পৃথিবীর কোথাও শিক্ষা অর্জনের সুযোগ আছে কি? হাজার হাজার শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারি, নানাবিধ কর্মকান্ডের সুবিশাল আয়তনের এক একটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এত সল্প মূল্যে পড়াশোনা করতে পারার হেতু টা ই বা কি? নিশ্চয়ই বলবেন রাষ্ট্রের বিনিয়োগ – তাহলে সেই অংক টা ই বা কত? বিনিয়োগ করেন আপত্তি নেই কিন্তু একজন ছাত্র যদি নাই জানে তার পিছনে রাষ্ট্রের বিনিয়োগ কত, তবে কি ঋন শোধ না করার দায়ে তাকে অভিযুক্ত করা যাবে?

সরকারের কর্তা মহোদয় গন ডিজিটাল বাংলাদেশের সাফল্যে আজ বিগলিত, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আজ বিভিন্ন সভা সমাবেশে গর্ব করেই বলেন, তনয় সজিব ওয়াজেদ জয়ের পরামর্শে ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণা কে গ্রহণ করছেন বলেই নানাক্ষেত্রেই আজ আমাদের বিস্ময়কর সাফল্য।

পুরোপুরি এক মত হয়েই প্রশ্ন করতে চাই, আপনারা কি জানেন – বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সমুহের নিজস্ব ওয়েব সাইটে সেখানে পড়াশোনার খরচ বা নিউশন ফি সংক্রান্ত কোন তথ্য নেই? এটি কি সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা, অজ্ঞতা নাকি ইচ্ছাকৃত কোন দৈন্যতা?

পৃথিবীর যে কোন উন্নত দেশেও উচ্চ শিক্ষা অত্যন্ত ব্যয়বহুল, তবে শিক্ষা অর্জনের সুযোগ ধনী গরীব সবার জন্য ই অবারিত। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ওয়েব সাইটে টিউশন ফি সহ সব ধরনের খরচের তথ্য দেওয়া থাকে, যদিও বা ব্যয়ের অংকটি অনেক সময় আঁতকে উঠার মতো, তবু্ও রাষ্ট্রের কোন নাগরিকের জন্য ই সেটি সাধ্যাতীত নয়, রাষ্ট্রের বিনিয়োগ সেখানে ও আছে, তবে শ্রেণীবেদে এই সুযোগ গ্রহণের মাত্রাটি সীমিত হয়ে থাকে।

উচ্চ শিক্ষার প্রারম্ভে ই একজন শিক্ষার্থী আবেদনের প্রেক্ষিতে সরকার বা ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে পরিশোধ করেন আবার রাষ্ট্রীয় ভর্তুকির মাধ্যমে প্রয়োজন সাপেক্ষে মওকুফের ও ব্যবস্থা আছে। এতে অর্থ গ্রহণকারী ছাত্রদের মধ্যে দুটো বিষয় জাগ্রত হয়, একটি হচ্ছে শিক্ষাকে সাফল্যের বাহন হিসেবে গ্রহণ করার প্রানান্তকর প্রচেষ্টা আর অতি গুরুত্বপূর্ণ টি হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা।

প্রতিটি সেমিস্টার শেষে একজন ছাত্র যখন দেখতে পায় তার দেনার অংকটি ক্রমেই বেড়ে চলেছে, ডিগ্রি শেষে লক্ষ ডলারের দায় রাষ্ট্রীয় আনুকুল্যে অবমুক্ত, তখন রাষ্ট্রের প্রতি দায় তথা দেশপ্রেমের মাত্রাটি কেমন হতে পারে একবার ভেবে দেখার অবকাশ আছে কি?

আমাদের দেশে কদাকিঞ্চিত একজন ছাত্রের পক্ষে জানার সুযোগ হয় শিক্ষায় রাষ্ট্রের বিনিয়োগ আছে তবে তার ব্যক্তিগত দায়ভারের চিত্রটি জানার কোন অবকাশই নেই। আটারো কোটি মানুষের দেশে কোটি কোটি গ্রাহকের হাতে ইন্টারনেট সংবলিত ডিজিটাল ডিভাইস অথচ বাংলাদেশের খ্যাতনামা কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ই আজ অবধি তথ্য আর তত্ত্বের সমাহারে সমৃদ্ধ একটি পূর্ণাঙ্গ ওয়েবসাইট ই প্রকাশ করতে পারেনি- এটি কি বিধিনিষেধের বাধ্যবাধকতা নাকি উদাসীন দৈন্যতা অথবা পদ-পদবীর লোভে অন্ধভাবে ব্যতিব্যস্ত কতৃপক্ষের কোন অমার্জনীয় ব্যর্থতা!!!

লেখকঃ উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক
আলবার্টা, কানাডা।

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/২৪ নভেম্বের ২০২০/এমএম


Array