আবু সাইদ লিপু :: ‘আশ্চর্য! এ মেয়েটি নার্স হয়েছে কেন?’
নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই খুঁজছি কৌতুহলী হয়ে। অবশ্য, নার্স হওয়াটা কিন্তু আমি অসম্মানের চোখে দেখছি না। পশ্চিমে নার্স মানে ভালো কিছু একটা। অভিবাসী নার্সগণ বেশ গর্ব করেই বলেন, ‘আমাদের নার্সিং পেশা তো। তাই ব্যস্ততা একটু বেশী।’ আর রেজিস্টার্ড নার্স মানেতো প্রায় ডাক্তার। চার বছর নার্সিংয়ের উপর পড়াশুনা করেই তবে আরএন – রেজিস্টার্ড নার্স। এই আরএনদের আয়-ইনকাম বেশ। আমজনতা মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে।
তা হোক, এতে আমার খারাপ লাগে না। তবে, প্রশ্নটা অন্য কারণে। মেয়েটির বয়স কত হবে? পঁচিশ/ছাব্বিশ বা তারও কম। গায়ের রং ঠিক দুধে আলতা। অবশ্য, এই উপমার দুধ আর আলতার মিশ্রণ ঠিক কী হবে আমার জানা নেই। তার চেয়ে বরং পরিচিত বরফের কথা বলি। প্রান্তরজুড়ে বিস্তৃত বরফে যখন গোধূলীর আগুন এসে লাগে সেই আবহ মেয়েটির গতরজুড়ে। দৃষ্টি ফেরানো যায় না। এদিকে, আমার চোখ যে শুধু গায়ের রংয়ে আটকে আছে তা কিন্তু না।
রিমলেস চশমা তার চোখে। চশমার কাচের মধ্যে দিয়ে দু’টো চোথ দেখা যাচ্ছে; যাকে পটল-চেরা বলে সাহিত্যে। কানাডার ক্যালগেরিতে পটল পাওয়া যায় না প্রায়। ঝিঙ্গা-চিচিঙ্গার আলামত দেখিনি কোথাও। তারপরও একদিন কোত্থেকে যেন পটল এনে লম্বালম্বি করে কেটে দেখেছি। মাই গড! কী ভয়ংকর লাগছে! তাইলে কবিরা একথা কেন বললেন? আমার অসহায়ত্ব দেখে বউ শুধরে দেয় সাথে সাথে। লম্বালম্বি না, আড়াআড়ি করে কাট। এবার রহস্যভেদ হলো। আড়াআড়ি কাটা পটল গোলগাল, খারাপ লাগছে না। তবে, মোটের উপর সন্তুষ্ট হতে পারছি না পুরোপুরি। তাই একদিন কিউই ফল এনে আড়াআড়ি কেটে দেখেছি। বাহ! অতি চমৎকার লাগছে। অগত্যা নিশ্চিন্তেই বলা যায় – এই মেয়েটির কিউই-চেরা চোখ।
বিদেশ বিভুঁইয়ে নাক ছিদ্র করে অলংকার লাগানোর সময় কোথায়। তারপরও মেয়েটি নাকফুল বাদ দিয়ে একেবারে দেশী নোলক পড়েছে। এর বাইরে আর কোন অলংকারের বালাই নেই। অবশ্য, শুধু দাঁতগুলো ছাড়া। এই মুখে দাঁতই যে অলংকার! পেস্টের বিজ্ঞাপন ব্যতিরেকে আর কোন মানুষের এত সুন্দর দাঁত আমি জীবনেও দেখিনি। ক্লোজআপ-কোলগেটে যে ঝকঝকে মশৃণ দাঁত দেখানো হয় তার কতটুকু ফেইক কে জানে। আমি জনমকাল ধরে সেনসোডাইন ব্যবহার করেও বিজ্ঞাপন-দাঁতের চতুর্সীমানায় যেতে পারিনি। জীবদ্দশায় ঐরকম দাঁত কারও দেখিইনি সামনাসামনি। কারও দেখব সে আশাও করিনি। আচানক সে আশা পূরণ হয়ে গেল। খবর পেলে কোলগেট কর্তৃপক্ষ হন্যে হয়ে খুঁজবে এই মেয়েটিকে, সন্দেহ নেই সামান্যও।
এবার চোখ-দাঁত বাদ দিয়ে তাকিয়ে আছি মুখের দিকে। না তাকিয়ে উপায় আছে? চোখের সামনে সাদা অ্যাপ্রনের নার্স কত দেখেছি। মুখে সদা হাসি, কোমল স্বর – এসবও হরহামেশা দেখি। ওদের আন্তরিকতায় অভ্যেস হয়ে গেছে আমার। তাই বলে চোখের সামনে সাদা অ্যাপ্রনের পরী দেখলে কেমনে কী। তৎক্ষণাত প্রশ্ন উদিত হবেই, ‘এই মেয়ে, তুমি নার্স হয়েছো কেন? হলিউড-বলিউড তোমাকে খুঁজছে যে!’
মেয়েটি ভারতীয় বংশদ্ভুত কানেইডিয়ান। আরেকটু ভাল করে বললে ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের। ওর নাম মানপ্রিত। একটু হতাশ লাগে আমার। এই মেয়ের নাম মানপ্রিত-জাসপ্রিত, এগুলো হবে কেন? এর নাম হবে আফ্রোডাইটি বা লায়লা জাতীয় কিছু একটা দেবীটেবীর নামে। অন্তত সরস্বতী বা পূরবী হলেও চলে। আমার চুপচাপ দেখে মেয়েটি মুক্তো ছড়িয়ে হাসে। কথাটা ঠিক হলো কী? এ’যুগে মুক্তো-ফুক্তোর বেইল আছে? দুনিয়ার সবচাইতে দামী মুক্তোর দাম কত হবে? সোনার চেয়ে বেশী নিশ্চয় না। এরপর প্লাটিনামতো আছেই। এর চেয়েও দামী বস্তু রোডিয়াম আছে। এক গ্রাম কিনতেই পুরো জান কবচ হয়ে যাবে।
এদিকে, ক্যালিফোর্নিয়ামের কথা বলতে গেলেও আলাদা পয়সা গুনতে হয়। এক গ্রামের দাম নাকি সাতাশ মিলিয়ন ডলার। দেখ তামশা! এসব বাদ দিয়ে এই মেয়ে সামান্য মুক্তো ছড়িয়ে হাসবে কেন? যত্তসব রাবিশ! আমাদের অগ্রজগণ মুক্তো বিনে তেমন কিছু দেখেন নাই নিশ্চয়। তাই মুক্তো ছড়াতেই উনারা খুশী। তবে মানপ্রিত কিন্তু মুক্তো ছড়িয়ে হাসছে না, হাসছে ক্যালিফোর্নিয়াম ছড়িয়ে। একটু আনকোরা লাগলেও এটাই সত্যি। একসময় অভ্যস্ত হয়ে যাবে সকলে।
মানপ্রিত হাসতে হাসতেই বলে, ‘সকালে কখন খেয়েছো?’
আমি হাত বাড়িয়ে মানপ্রিতের ছড়িয়ে দেয়া দু’চার গ্রাম ক্যালিফোর্নিয়াম পকেটে ভরি। হোমার সিম্পসনের মত বিশ্রী একটা হাসি দিয়ে বলি, ‘এই ধরো সাড়ে ছ’টায়।’
‘ঘুমের থেকে কখন উঠেছো?’
‘ছ’টার দিকে।’
‘গুড, ভেরি গুড। ঘুম থেকে উঠার দু’ঘন্টার মধ্যেই খেতে হয়।’
‘থ্যাংক ইউ।’ আমি গর্বিত স্বরে বলি।
‘এবার বলো, সকালে কী খেয়েছো?’ কিউই-চেরা চোখ একটু উপরে তুলে বুমেরাংয়ের মত দেখতে ভ্রু’জোড়া নাচায় মানপ্রিত।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত বলি, ‘দু’টো পরাটা, আর আলু-বেগুন ভাজি। একটা ডিম পোচ ছিল। আর এক কাপ চা, দুধ-চিনিসহ।’ বলার সাথে সাথেই মনে হয় খাল কেটে কুমির না আস্ত জলহস্তি নিয়ে এসেছি। কিংবা বড় সাইজের ব্লু হোয়েলও হতে পারে।
এইবার ভ্রু কোঁচকায় আমার সামনে থাকা গ্রীক ভাস্কর্য। মানুষ নীচের ঠোঁট কামড়ে চিন্তা করে। আর আমাদের গডেস উপরের ঠোঁট কামড়ে বলেন, ‘দু’টো পরাটা! সাথে আলু! উঁহু।’
আমি হতাশ চোখে নীল তিমির দিকে তাকিয়ে থাকি। কী কুক্ষণে যে দুই পরাটার কথাটা বললাম! তারপরও ভয়ার্ত চোখে বলি, ‘উঁহু মানে?’
‘মানে দু’টো পরাটা সাথে আলু হবে না। ডিম খেতে পার, সমস্যা নেই।’ পটে আঁকা পরী তখন সমানে রোডিয়াম ছড়িয়ে যাচ্ছেন। রোডিয়ামের দামও সোনা-দানার চেয়ে বহু বহুগুন। মুক্তো থোরাই কেয়ার।
আমি কষ্ট করে অসহিষ্ণুতা চেপে রেখে বলি, ‘তাহলে?’
‘দু’টো পরাটা খেলে শুধু সব্জি দিয়ে খেতে হবে। আর আলুভাজি খেলে মাত্র একটা পরাটা।’ মানপ্রিত হেসেই চলেছে। এ মেয়ের কী হাসি-রোগ আছে নাকি?
‘হায় হায়! বলো কী?’ আমি তখন আহত পক্ষী। যন্ত্রণায় ছটফট করছি।
‘হু। আচ্ছা, এরপর তুমি কখন খাও?’ শায়ক-বেধাঁ পক্ষী-টক্ষী নিয়ে হেলেন অব ট্রয়ের কোন মস্তক-বেদনা নাই। উনি প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন।
‘সাড়ে ন’টা দশটার দিকে কিছু একটা খাই।’
‘কী সেটা?’
‘ফলমূল কিছু।’
‘গুড।’
‘এরপর?’
‘বারটা সাড়ে বারটার দিকে দুপুরের খাবার খাই।’
‘ভেরি গুড, চমৎকার! কী কী খাও?’
‘অবশ্যই ভাত থাকবে। সাথে মাছ বা মাংশ। সব্জি থাকে কিছু, আর সালাদ।’
‘ভাতের পরিমান কতটুকু?’
আমি অনুমান করে বলি, ‘এতটুকু।’
চোখ কপালে উঠে সুন্দরীর, ‘এতগুলো ভাত!’
আমি আহত চোখে তাকিয়ে থাকি। বাঙালির ভাতের হিসেব তুমি কি জান হে দেবী। তুমিতো আমার অফিসের কেরানি শামসুর ভাত খাওয়া দেখইনি। পুরো গামলা শেষ করে ফেলে এক বসায়। অন্যদের কিছু থাকল না বলে ওর বউ শঙ্কায় গামলা পর্যন্ত সরিয়ে নেয়। কত শত বাঙালি এক সানকি ভেজা ভাতে একটু লবন ছড়িয়ে কাচামরিচ ডলে আয়েশ করে তৃপ্তি ভরে খেয়ে নেয়। কিংবা শুধুই একবাটি ডাল মিশিয়ে হাপুস-হুপুস করে ভক্ষণ। বাঙালির ভাত খেয়েই শুরু, ভাত খেয়েই শেষ। অন্য কিছু মুখে রোচে না যে!
বাংলাদেশে রীতিমত একটা দর্শণীয় জায়গাই আছে ভাতের নামে। মাগুরা জেলার ফটকী নদীর তীরের সেই জায়গার নাম ‘ভাতের ভিটা ঢিবি’। চাকরির প্রয়োজনে যেতে হয়েছিল সেখানে। বিচিত্র সব কান্ড কারবার! এক দরবেশ ও পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। রাতের শুরুতে তিনি স্থির করলেন এখানে মসজিদ বানাবেন সূর্য ওঠার আগেই। প্রথম সূর্যের আলো আসার আগেই এলাকাবাসী দেখতে পাবে মসজিদটি। ভদ্রলোকের অলৌকিক ক্ষমতা ছিল বিস্তর। লোক-লস্কর জোগাড় হয়ে গেল। পুরোদমে কাজ চলছে। কামলাদের খাবার জন্য দরবেশজী ভাত চড়িয়ে দিলেন। এদিকে, সকাল হয়ে গেল। ভাতও তৈরী। কিন্তু মসজিদ যে শেষ হয়নি। ভদ্রলোক কাজকর্ম ফেলে, ভাত রেখে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। পাহাড়সম ভাত পড়ে রইল। এলাকাবাসী দেখল, একটি আধা-খেচড়া মসজিদ আর উঁচু ভাতের ঢিবি। সেই থেকে বিখ্যাত হয়ে গেল জায়গাটা – ভাতের ভিটা ঢিবি।
ভাত না হয়ে বার্গার বা স্যান্ডুইচ হলে কি এরকম নাম হতে পারতো? কক্ষণো না। ভাতের এমনই গুণ। কবিগুরুর ভাতের আহাজারি গগনবিদারী, ‘পাঁচদিন ভাত নেই, দুধ একরত্তি-’। নজরুলের ভাতের ভ্রুকুটি সমাজের দিকে চেয়ে, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন’। আহারে ভাত রে! রফিক আজাদ তাই হুংকার দিল, ‘ভাত দে হারামজাদা’। কবি মহোদয় কিন্তু বলেননি, পিজা দে হারামজাদা। কিংবা পাস্তা দে। আহারে আমার ভাত! ‘লোনার মাকে আমি বলেছিলাম রোজ এসে ভাত ডাল মাছ নিয়ে যেতে।’ ভাততো নিতেই হবে। ভাত না খেলে চলবে?
আমি সুদৃশ্য পাঞ্জাবী সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলি, ‘মানপ্রিত, ভাত কি বেশী হয়ে গেলো?’
‘তাতো হয়েছেই। তোমাকে এর তিন ভাগের একভাগ, নিদেনপক্ষে অর্ধেক খেতে হবে।’ ভ্রু নাচিয়ে যুবতী কলকলিয়ে হাসে।
‘বলো কী? তাহলে খাব কী?’ আচমকাই চমকে উঠি আমি।
একটু নিরাশ হন দেবী। এরপর উৎসাহে আবারও বলেন, ‘খাবারের সে তালিকাইতো এখন দিব। ভাত খাবে ঠিক আছে। তবে পরিমানে কম। অর্থাৎ তোমার এক মুঠোতে যতটা ধরে ততটা।’ নিজের ছোট্ট মুষ্টি আমার সামনে মেলে ধরে সে।
আমার চট করেই ঐ কৌতুকটার কথা মনে হয়। ডাক্তার লোকটির সবকিছু শুনে বলল, ‘আপনার কার্বহাইড্রেট বেশী হয়ে গিয়েছে। আপনি দুপুরে আর রাতে এইগুলো খাবেন।’
লোকটি খুশী হয়ে বলল, ‘ডাক্তার সাহেব এগুলো কী খাবার আগে না পরে খাব?’
সুন্দরীর দিকে তাকিয়ে আমারও বলতে ইচ্ছে করছে, ‘ওহে চঞ্চলা হরিনী, এক মুঠো ভাত কি আহারের পূর্বে না পরে ভক্ষণ করিব?’ কিন্তু কৌতুকতো আর বাস্তব হয় না। আমি বিরস বদনে বিড় বিড় করে বলি, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’
অতি উৎসাহে সে বলে, ‘অবশ্য সাথে প্রোটিন খাবে, মানে মাছ বা মাংশ। ডালও খেতে পার। তবে মনে রেখ ডালেও কিন্তু কার্বহাইড্রেট আছে।’
আমি ট্রান্সফরমার মুভির যন্ত্রের মত বলি, ‘আচ্ছা।’ যেন টার্মিনেটরের রোবট কথা বলছে একঘেয়ে যন্ত্রের স্বরে।
তরুনী আবার জিগ্যেস করে, ‘এরপর কখন খাও?’
‘ছ’টার দিকে ডিনার খাই।’
‘বলো কী? ছয় ঘন্টা কিছু খাওনা?’
‘তা বলতে পারো।’ একটু গর্ব এখন আমার।
‘এটাতো চলবে না।’
‘কেন? অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকলাম। বিষয়টাতো ভালো হবার কথা।’ আমার অনুযোগ।
‘না, এটা ভালো না। অনেক সময় দেখ না একজন মানুষ একটু পরপর খাচ্ছে অথচ সে শুকনা-পটকা।’
‘হ্যা দেখিতো। অবাক হয়ে বলি, এই ব্যাটা হাতি খেয়েও চিকার মতন। আর আমি চিকা খেয়েও হাতি সেজে বসে আছি। আমার বাতাস খেলেও হজম হয়ে শরীরে লেগে যায়।’
‘হা হা হা। বিষয়টা ঠিক তা না। মানব শরীরের চার ঘন্টা হচ্ছে সর্বোচ্চ সীমা। এর মধ্যে কিছু না কিছু খেতেই হয়।’
‘কিন্তু না খেলে?’
‘চার ঘন্টা পার হলেই মস্তিস্ক বুঝে ফেলে পাকস্থলীকে আর খাবার দেয়া হবে না। তখন সে নিজের আত্মরক্ষা অবস্থায় চলে যায়। সেইফ মুড বলে।’
‘সেটা কী রকম?’
‘মস্তিস্ক তখন শরীরে খাবার সঞ্চিত করা শুরু করে দেয়। অনেকটা ভবিষ্যৎ চিন্তায় জমিয়ে রাখার মত। কারণ শরীর স্বয়ংক্রিয়ভাবে সন্দেহে চলে যায়। পরবর্তী খাবার কখন আসবে তার কোন নিশ্চয়তা নাই। শরীর তাই নিজেকে বাঁচাতে সরবরাহ বন্ধ করে জমানো শুরু করে দেয়। বাস্তব জীবনে এর ভুরিভুরি উদাহরণ আছে, তাই না?’
‘তাইতো, ঠিক বলেছো। এভাবেতো ভাবিনি কখনও।’
‘হুমম। ছয় ঘন্টা পরে তোমার শরীরে খাবার আসলেও ক্ষতিটা ইতোমধ্যে হয়ে গিয়েছে। তোমার অ্যাকাউন্টে ভবিষ্যৎ-খাবার জমে গিয়েছে।’
‘কী ভয়ংকর! এখন কী করব?’
‘দু’টো কাজ করতে হবে। বিকেলে তিনটা/চারটার দিকে কিছু খেতে হবে। হালকা স্নাক্সস – ফলমূল বাদাম খেতে পার। তবে চীনাবাদাম না। অ্যালমন্ড বা ওয়ালনাট হলে হবে। কারণ বাদামে উপকারী কোলেস্টেরল থাকে।’
‘সেটা আবার কী?’
‘শরীরে দুই ধরণের কোলেস্টেরল থাকে। একটা হলো উপকারী, যেমন গরু আমাদের অতি উপকারী। জলপাইয়ের তেল, আঁশযুক্ত খাবার, তেলওয়ালা মাছ এসবে উপকারীটা পাবে। আর আরেকটা হলো মহা ক্ষতিকর, শয়তান। চর্বিজাতীয় খাবার হলো এই শয়তানের ডিপো। তাই মাংশর ব্যাপারে সাবধান! মুরগী খেতে পার তবে চামড়া বাদ।’
আমি মন খারাপ করে মেয়েটির দিকে তাকাই। তৈলাক্ত ইলিশ খেতে পারব শুনে ভাল লাগছে। তবে যে, প্রিয় গরু খাওয়া বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো। আমি আঁতকে উঠে বলি, ‘গরুর মাংশ খেতে পারব না?’
‘খাবে, তবে পরিমানে কম।’
আমি আরও বিবর্ষ হই। গরুর মাংশ মেপে খাবার চেয়ে মরে যাওয়াইতো ভালো। যে জগতে গরু খেতে পারব না সে জগতে বেঁচে থাকারতো কোন যুৎসই কারণ দেখছি না। দুনিয়ার সব ছেড়ে দিতে পারি। কিন্তু ভুনা খিচুড়ী আর ঝোলওয়ালা গরুর মাংশ ছাড়া বেহেশতে যেতেও আমি রাজি না। এখন কী হবে? ‘অন্য কোন উপায় আছে?’
আমার কাঁতর স্বর দেখে মায়া হয় মায়াবিনীর। হাসতে হাসতে বলে, ‘যদি লোভ সামলাতে না পারো বা খুব বেশী খেতে ইচ্ছে করে তাহলে সেদিন একটু বেশী হাঁটতে হবে।’
আমার বিরাট বোঝার উপর তখন মুলিবাশের নতুন আঁটি যুক্ত হয়। ‘হাঁটতে হবে মানে?’
‘হ্যা, প্রতিদিন আধা ঘন্টা করে হাঁটতে হবে। আর যদি বেশী খেয়ে ফেল কোনদিন, তবে এক ঘন্টা।’ গলার স্বর দৃঢ় শোনায় তার।
ঐ স্বরের আমি প্রতিবাদ করতে পারি না। অবশ্য, সামান্য আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। হোক না তা সুদূরে। আকাশে বা পাতালে কিংবা এভারেস্ট-চুড়ায়। হোক না সে আলো আসছে বহুদূর আলোকবর্ষ পার হয়ে। করুক না সে ক্ষীণ মিটিমিটি কীরণের মত। তারপরওতো অন্ধকার দূর করে দিচ্ছে। সামান্য হলেও চোখের তারায় ঝিলিক দিচ্ছে গর্বভরে। আমি তৃপ্তি অনুভব করি। কিছুটা শঙ্কামূক্ত দৃষ্টি আমার, ‘যাক মাংশ খাওয়া যাবে।’ গরুর ছিনার মাংশ খেতে আমি মহাকাশযানে চড়ে বসতে পারি। মঙ্গলগ্রহের যে একমূখী ডিলটা আছে সেটাও নির্বিঘ্নে গ্রহণ করতে পারি বিনা বাক্যব্যয়ে। গরুর মাংশ বলে কথা, তাই না?
‘তোমাকে এখন কোনো মেডিসিন দিলাম না। রক্তের গ্লকোজ টলারেন্সের এই টেস্টটা করাবে আগামী সপ্তাহে। দু’মাস পর আবার দেখবো আমরা। গ্লুকোজ লেভেল ঠিক থাকলে আর কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে থাকলে আপাততঃ ডায়েটিংই থাকবে। নাহয়, নিয়মিত মেডিসিনে যেতে হবে।’
‘ঔষধ খেতে হবে! বলো কী?’
আমার আঁতকে ওঠা দেখে হাসে সে। একটু গম্ভীর হয়ে বলে, ‘কানাডার সরকার সকল নাগরিককে সুস্থ্য রাখতে চায়। তাই সকলকে বিনে পয়সায় নিয়মিত পরীক্ষা করি আমরা। তুমিতো জান, প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিউর।’
আমি মাথা ঝাঁকাই। সম্মতির মতো করে ডান-বামে হেলেদুলে আবার সোজা করি। লেখা আর আঁকাউঁকি ভর্তি একটা কাগজ ধরিয়ে দেয় সে। মেয়েটির হাতের লেখাও চমৎকার। আমি সপ্রশংসে তাকিয়ে আছি। সে বলে, ‘এখানে সবকিছু লিখে দিয়েছি। এগুলো অনুসরণ করে চলবে।’
আমি মাথা নাড়িয়ে বিদায় নেই। মনে মনে ভাবি, আমি যে অনিয়মের ঢেঁকি সুন্দরী। তিনমাস আগে আমার ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান ডক্টর আলবার্ট কার্স একগাদা কোলেস্টেরলের ট্যাবলেট ধরিয়ে দিয়েছেন। নিজে ক্লিনিকের ফার্মেসি পর্যন্ত এসে কিনে দিয়েছেন, ‘প্রতিদিন একটা করে খাবে। তিনমাস পর আমি আপডেট দেখব।’
আমি যথারীতি মাথা নেড়ে চলে এসেছি। পয়সা দিয়ে কেনা ট্যাবলেট ল্যান্ডফোনের নীচের ড্রয়ারটায় পড়ে আছে। তিনমাসে একটাও ছুঁয়ে দেখিনি। মানপ্রিত কি জানে আমি ওর লেখা কাগজটা দুমড়ে-মুচড়ে স্ট্রিট মলের ট্রাশবিনে ফেলে দিয়েছি। রিসাইকেলে ফেলার সবুরটুকুও হয়নি। ফেরার পথে গাড়িতে বসে ভাবছি, বেশীদিন বাঁচব না বোধ হয়। সময় শেষ হয়ে আসছে। বুকের মধ্যে একধরণের ধরফর লাগছে। চিনচিনে একটা ব্যাথা। নিশ্চয় মানসিক কিছু। অবশ্য মনটা মরে গেলেইতো শরীর শেষ।
চোখ বড় বড় করে যদি জ্যোৎস্না গিলতে না পারি। অতি আগ্রহ নিয়ে যদি ‘দ্য সেয়িং অব প্রফেট’ পড়তে না পারি। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চুড়ায় বসে যদি বঙ্গোপসাগের সূর্যাস্ত না দেখতে পারি। তবে বেঁচে থেকে আমি কী করব? মনটাতো এই ইট-কাঠের বাঁধানো ফ্রেমে থাকতে চায় না। দেহ সেখানে যতই সুখে থাকুক না কেন।
প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/২৪ নভেম্বের ২০২০/এমএম





