বায়াজিদ গালিব, ক্যালগেরী, কানাডা :: সবাই তাকে ডাকে মিঃ হুগি। আমি এ নামটা স্বাভাবিক মনে করেছিলাম। আফ্রিকার ইথিওপিয়ায় তার জন্ম। ইথিওপিয়ার নামগুলি এমন তাই আমিও ভেবেছিলাম তার এটাই প্রকৃত নাম। কৌতূহল হলো, এখানে কেউ মিঃ সম্বোধন করে না। সে যত বড় কর্মকর্তাই হোক না কেন। সবাই নাম ধরেই ডাকে। হুগির আগে কেন মিস্টার লাগলো সেটাই তো বুঝতে পারছি না। তখন আমি ক্যানাডার টরেন্টোতে নতুন এসেছি। নতুন চাকুরী পেলাম হোয়াইট ক্যাপ বুক লিঃ এর পাব্লিকেশনে ডিস্ট্রিবিউটিশন ডিপার্টমেন্টে। কাজের প্রথমদিনে মিটিংয়ে ম্যানেজার আত্মপরিচয় করার আহবান জানালো সবাইকে। আমরা যার যার পরিচয় করছি। পরিচয়ের পালা যখন এক দীর্ঘদেহী কৃষ্ণাঙ্গের কাছে গেলো তখন ম্যানেজার কেভিন নিজেই বললো, ওর নাম মিঃ হুগি। মিটিংয়ে হাসির রোল। আমি তাঁকে দেখলাম লম্বায় সাড়ে ছয় ফুটের কম হবে না, চওড়ার কথা না আর নাই বলি। ওকে দেখে আমার প্রিয় লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর নরশার্দূলের বর্ণনার সাথে মিলে গেলো। আমি আকৃতিতে ছোট খাটো তাই ওর পাশে দাঁড়াতেই আমাকে গালিভার্সের লিলিপুটের মতোই লাগছিলো। আমি বললাম, হাই মিঃ হুগি নাইস টু মিট ইউ। সবাই হো হো করে হেসে উঠলো মিঃ হুগির দৃষ্টিতে ছিল অগ্নি, ঠিক যেন তেজস্বী মার্তণ্ড প্রতাপে আমাকে এখুনি ভষ্ম করে দেবে। আমি ভয়ে আমার চোখ সরিয়ে নিলাম। তার রাগের কারণও বুঝতে পারলাম না। পরে আমার পাশের মেয়েটি বললো, ওকে ভুলেও ওই নাম আর ডাকবে না। ওর আসল নাম ম্যাব্রাথু ম্যারাথু। কি মুস্কিলে পড়লাম আগের নামটাই তো সহজ উচ্চারণ ছিল। এ তো দেখছি দাঁত ভাঙা নাম। আমি বললাম, তাহলে কেভিন ওকে ওই নাম পরিচয় করিয়ে দিলো কেন? সে বললো, পরে জানতে পারবে। আমিও অনেক কষ্টে কৌতূহল দমন করলাম। কাজে মন দিলাম। সেই সাথে হুগির আসল নাম উচ্চারণের অনুশীলণ শুরু করলাম। একবার ক্ষেপে গেলে অনায়াসেই আমাকে কাপড় কাচার মত আছাড় মারতে তার কোনোই সমস্যা হবে না। সে ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। অস্বস্থি বোধ করছিলাম, সে যখনই আমাকে দেখছে তখনই তার অগ্নিশর্মা দৃষ্টি।
আমার ধারণা ছিল শুধু আমাদের দেশেই নামকরণ করা হয় এখন দেখছি সুদূর ক্যানাডাতেও! ছাত্র জীবনে নামকরণের সময় ছিলো বাংলা নববর্ষে। প্রতিবছর এই দিন ঘরে ফিরতাম নতুন নাম নিয়ে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠকালীন সময়ে বিশেষ করে আমাদের বন্ধুদের নামকরণের কোনো সময় ছিল না। যখন ইচ্ছে তখনই নামকরণ করা হতো। সে সময়ের একটা নামের কথা মনে পরে গেলো। আমরা বিকালে লন টেনিস খেলতাম, আমাদের সাথে খেলতেন আমাদের সিনিয়র ভাই শের খান, লম্বায় ছফুটের মত ছিপছিপে গড়ন। গায়ে মেদের বালাই ছিল না। পরের বছর আমাদের সাথে খেলায় যোগ দিলো শের ভাইয়ের মতোই ছিপছিপে লম্বায় কিছুটা খাটো, পাতলা গড়নেই একটি ছেলে। সাথে সাথেই শের খান ভাইয়ের সাথে মিল রেখে তার নাম রাখা হলো “পোয়া খান”। ভাবলাম মিঃ হুগির ব্যাপারটাও তেমন কিছু একটা হবে।
হুগি আমার উপর কেন এতো রাগ হলো আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। আমি না জেনে ওকে মিঃ হুগি ডেকেছিলাম, ইচ্ছেকৃত নয়, তারপরও এতো রাগ কেনো? যা হোক, আমার এখন মূল লক্ষ্য কিভাবে মিঃ হুগির সাথে ভাব করা যায়। আমি যখন কাজে ঢুকি, আমার দিন শুরু হয় হুগির রাগান্বিত চেহারা দেখে। ভাবলাম এর একটা বিহিত করা দরকার। ওর সাহায্য ছাড়া এখানে কাজ করা বেশ কঠিন। আমার কাজের কারণে ওকে হাতে রাখা খুবই জরুরী। কারণ ফর্ক লিফ্ট অপারেশনে ওই একমাত্র লাইসেন্সধারী। তাই ১২ ফুট উপরের সেলভ থেকে কোনো বইয়ের প্যালেট উঠানো বা নামানোর জন্য ওই একমাত্র ভরসা।
ভাবলাম মাসুম পদ্ধতি ব্যবহার করবো। মাসুম পদ্ধতি মানে, আমাদের বন্ধুদের মধ্যে মাসুমের মানুষ পটানোর একটা যাদু ছিলো। ওর অসংখ্য পদ্ধতির স্মৃতিচারণ করলাম, ভাবলাম সেগুলো প্রয়োগ করবো। তার আগে চেষ্টা করতে হবে আমাদের দেশীয় সাধারণ ঘুষ পদ্ধতি, কাজ না হলে এ ধীরে ধীরে আগাতে হবে মাসুম পদ্ধতিতে। একদিন ১৫/২০ মিনিট আগেই, হুগির জন্য ঢাউস সাইজের এক মগ কফি ও ডোনাট নিয়ে ঢুকলাম কাজে, দেখলাম হুগি বসে আছে একটা টুলে, তার তুলনায় টুলটি বেশ ছোট। সে তার উরুতে দুই কনুই ঠেকিয়ে হাতের দুই তালু থুতনিতে রেখে চিন্তায় মগ্ন। আমি তার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, শুভ সকাল ম্যাব্রাথু। চমকে উঠে তাকালো আমার দিকে, আমি কফির মগ আর ডোনাট তার দিকে বাড়িয়ে বললাম, তোমার জন্য। বিস্মিত চোখে আমার দিকে তাকালো তারপর কফির দিকে। আকর্নবিস্তৃত হাসি, অবাক হয়ে বললো, তুমি আমার জন্য কফি কিনেছো! তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আমি আরো অবাক হলাম কারণ এতো অল্পতেই ওর মন গলে যাবে বুঝতে পারিনি। মাসুম পদ্ধতি পর্যন্ত আর যেতে হয় নাই। এরপর থেকে হুগি আমার বন্ধু হয়ে গেলো, সেই সাথে আমার কাজ হয়ে গেলো জলবৎ তরলং। অবশ্য বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য মাঝে মধ্যেই কফি আনতে হতো। হুগি শত ব্যস্ততার মাঝেও আমার কাজ করে দিতো আনন্দ চিত্তে।
একদিন লাঞ্চের সময় দেখলাম সে একটা দূরের টেবিলে বসে আছে। আশেপাশে কেউ নেই, আমি সুযোগ বুঝে তার টেবিলে বসে পড়লাম। দেখলাম সে তিনতলা বিশিষ্ট একটি বার্গার, সাইড ডিশে গোটা বিশেক চিকেন উইং, সাথে এক গামলা ফ্রেন্সফ্রাই ও সবচে বড় ড্রিঙ্কস নিয়ে খাবার শুরু করার অপেক্ষায়। আমাকে দেখে খুশিই হলো। ভাবলাম আজ ওর মিঃ হুগি নামের বিস্তারিত জানবো। ওর মুড বেশ ভালো মনে হলো। আমি বললাম, তোমাকে একটা প্রশ্ন করবো রাগ করবে না তো? হুগিকে যতটা বোকা মনে করেছিলাম তা সে নয়। আমার হা করা দেখেই বুঝে গেছে আমি হামিদপুর বলতে চাই। বললো, হুগির বিষয়ে তো? তোমাকে অনেকদিন থেকেই বলবো ভাবছি। তারপর শুরু করলো তার আদ্যোপান্ত ইতিহাস। ম্যাব্রাথুর সংসারে তার স্ত্রী, ১৬ বছরের কন্যা, ১২ ও ১০ বছরের দুটি ছেলে। ছোট ছেলের জন্ম মন্ট্রিলে। বিভিন্ন চড়াই উৎরাই পার হয়ে রিফ্যুজি হিসেবে ক্যানাডার কুইবেকের মন্ট্রিল শহরে এসেছিলো, তারপর ধীরে ধীরে স্ত্রীপুত্রদের নিয়ে অবশ্যই তাদের আনতে বেশ সময় লেগেছে। তারপর তারা মন্ট্রিল থেকে টরোন্টোতে। সে এ কোম্পানিতে জব এজেন্সির মাধ্যমে দিন মজুর হিসেবে ঢুকেছিলো। বইয়ের প্যালেট স্থানান্তর, উপরে উঠা নামা করার জন্য এমনি একজনকে খুঁজছিলো কেভিন। তাই তাকে এই কোম্পানিতে ফর্ক লিফ্ট অপারেটর নিয়োগ দিয়ে, তার ট্রেনিঙ ও লাইসেন্সের ব্যবস্থা করে দেয়। ধীরে ধীরে তার কাজে সে বেশ দক্ষ হয়ে উঠলো। কাজের জায়গায় ম্যানেজারের নজরে পড়লে আর কোনো চিন্তা নেই। সে যাই হোক মেয়ের লেখাপড়ার জন্য একটা কম্পিউটার দরকার। এ ব্যাপারে তার কোনোই ধারণা না থাকায় সে ম্যানেজারের স্মরণাপন্ন হলো। ম্যনেজার বললো, পেপারে লক্ষ্য রেখো, ওখানে মাঝে মাঝে ভালো সেল দেয়। একদিন দেখলো ব্ল্যাক ফ্রাইডের সেল। পরদিন পেপার নিয়ে ম্যানেজারের সামনে হাজির। বললো, কেভিন দেখো ফিউচার শপে কম্পিউটারের হুগি সেল দিচ্ছে। কেভিন দেখলো সে হিউজ সেল কে হুগি সেল বলছে। তারপর থেকেই তার নাম হয়ে গেলো মিঃ হুগি।
মিঃ হুগির সাথে সম্পর্কিত আমার ছেলে বেলার এক স্মৃতি মনে পরে গেলো। বেড়াতে গিয়েছি সিরাজগঞ্জ খালার বাসায়। উল্লেখ্য, আমাদের সবার মধ্যে এই খালা বিত্তশালী। তাদের বিভিন্ন ব্যবসা কল কারখানা ছিল সে সময়। তাদের বাড়িতে নেপাল থেকে আগত একজন দারোয়ান ছিল। তাকে সবাই নেপালী বলেই ডাকতো। নেপালীর গড়ন মাঝারী, পেটমোটা, পরনে খাকি শার্ট, হাফপ্যান্ট, মাথায় পুলিশী হ্যাট, হাতে একটা দারোগার লাঠি। তখন ভাবতাম নেপালী বুঝি তার আসল নাম। ওই সময় আমার জানা ছিল না নেপাল একটা আলাদা দেশ। নেপালী সারাদিন বাসায় থাকে না। আমার একটা আগ্রহ ছিল ওর প্রতি, সে কি করে দিনের বেলায় কোথায় থাকে ইত্যাদি। আমার আগ্রহ দেখে সমবয়সী খালাতো ভাই আমাকে বললো, নেপালী থেকে সাবধান, ও কিন্তু মোত (মদ) খায়। সে সময় মদ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না, তাই পেশাব ভেবেছিলাম। এবং সাইকোলোজিক্যালি তার গা থেকে পেশাবের গন্ধ পেতাম। আমি নেপালী থেকে নিরাপদ দুরুত্বে থাকার চেষ্টা করি। ছেলেবেলার সব বোঝার বিষয়গুলি ছিল এলোমেলো। গানের বেলায়ও তেমন ছিল, “আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি আর মুগ্ধ এচোখে চেয়ে থেকেছি।..” আমি ভাবতাম “মুখ ধুয়ে চোখে চেয়ে থেকেছি”… অবশ্য মুখ ধুয়ে চেয়ে থাকার অন্তর্নিহিত অর্থ না বুঝলেও ভাবতাম চেয়ে থাকতে হলে মুখ ধুতে হবে।
সে যাই হোক, একদিন শহরে যাবার বায়না ধরলে খালু আমাদের সাথে নেপালীকে দিয়ে দিলেন নিরাপত্তার জন্য। আমি তার থেকে নিরাপদ দুরুত্বে চলতে থাকলাম, মনে আমার হাজারো প্রশ্ন। আমি জিজ্ঞেস, করলাম নেপালী ভাই, আপনি সারাদিন কোথায় থাকেন। তার বাংলা উচ্চারণ পরিষ্কার ছিল না। সে যা বললো তাতে বুঝলাম, সে সারাদিন বারোমাইস্যা কোম্পানির দারোয়ানগিরি করে, তারপর বাসার ফাই ফরমায়েশ। আমি সব বুঝলেও বারোমাইস্যা শব্দের অর্থ বুঝলাম না, ভাবলাম কোম্পানী বারো মাস খোলা থাকে তাই হয়তো তার নাম বারোমাইস্যা। আমার সিরাজগঞ্জ বেড়ানো শেষে পাবনায় ফিরলাম। সিরাজগঞ্জের কথা গল্প করছিলাম সবার কাছে। নেপালীর কথা, বারোমাইস্যার কথা। বড় ভাই বললেন, বারোমাইস্যা আবার কি? আমি বললাম নেপালী তো তাই বললো। ভাইয়া বললেন, ওটা বার্মা-শেল তেল কোম্পানী, বারোমাইস্যা না।
প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ২৩ নভেম্বের ২০২০/এমএম





