আলমগীর দারাইন, ক্যালগেরি, আলবার্টা, কানাডা :: পাশবিক নির্যাতন, বলৎকার বা ধর্ষণ, গনধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ করোনা কালীন সময়ে দেশের সর্বত্র বেড়ে গেছে। বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্মের অনেকেই আজ মাদকাসক্ত। তারা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড কি ধর্ষণ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে? মৃত্যুদন্ড কি ধর্ষণ প্রতিরোধে কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে?
কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের পত্রিকা খুললে একের পর এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা চোখে পড়ছে, সিলেট এম সি কলেজে গৃহবধু ধর্ষণ, বেগমগঞ্জে নারী উলঙ্গ করে নির্যাতন, যশোরে চলন্ত বাসে গনধর্ষণ ইত্যাদি। দেশে নারী ধর্ষণ, নারী নিপীড়ন, নারী নিগ্রহ, নারী হেনস্তা, নারী প্রতারণার মতো জঘন্য অপরাধ দিন দিন করোনার বন্দী জীবনেও বেড়ে চলেছে। সব সমাজেই ধর্ষণের মতো জঘন্য সামাজিক অপরাধ মানব সৃষ্টির পর থেকে যুগ যুগ ধরে হচ্ছে।
আমাদের দেশ তার ব্যতিক্রম নয়। অপরাধীরা সাধারণত স্থানীয় রাজনৈতিক ক্ষমতার ছায়াতলে থেকে লুটপাট, চাঁদাবাজি, জমি দখল, মারপিট, ধর্ষণ, মাদক সেবন, মাদক বিক্রি ইত্যাদি নানাধরণের অনৈতিক অপরাধজনক কর্মকান্ডের সঙ্গে ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় যুক্ত হচ্ছে । ছোট অপরাধ থেকে বড় অপরাধের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এরা সরকার বদল হলে কিছুদিন গা-ঢাকা দেয় তার পর আবার নতুন সরকারীদলে নাম লেখায়। এদের শিকার হচ্ছে সমাজের কিছু দূর্বল ও নিরীহ নারীরা ।
পুলিশের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০১৮-২০১৯ সালে প্রতিদিন ১৩ জন নারী ধর্ষনের শিকার হয়েছে (প্রথম আলো অক্টোবর ৯,২০২০ “নারীর বিরতিহীন লড়াই” কলাম)ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর ডেটা জানাচ্ছে, ভারতে ২০১৯ সালে গড়ে রোজ ৮৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।আমাদের দেশে ভারতের সিনেমা, নাটক এবং ইন্টারনেটে নীল ছবি দেখে ধর্ষণের মতো ঘটনা কিছুটা হলেও বেড়ে চলেছে।
ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, যৌন নির্যাতন আগেও ছিল এখন আরও বেড়েছে তার সাথে যুক্ত হয়েছে ইন্টারনেট, ফেসবুক, মোবাইল ফোনে ছবি ধারণ করে ব্লাকমেল করা। ইদানিং সমাজে প্রকাশ হচ্ছে বেশি। গনমাধ্যম, কঠিন আইন প্রনয়ণ, নারী শিক্ষা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিচারহীনতায় অপরাধীরা এখন আরও বেপরোয়া হয়েছে।
গনধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ সাধারণত সমাজে ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা ক্ষমতাধর ব্যক্তির আশ্রয় প্রশ্রয়ে অথবা এলাকায় রাজনৈতিক নেতাদের ছায়াতলে কিছু মাস্তান, সন্ত্রাসী শয়তান, মাদক সেবনকারী অসুস্থ প্রকৃতির তরুনেরা করে থাকে। এরা কখনো এককভাবে, কখনো সংঘবদ্ধভাবে পাশবিক নির্যাতন বা গনধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ সংগঠন করে। তারা নিজেদের অপ্রতিরোধ্য ভাবে। মনে করে কখনো ধরা পড়বে না। যদিও ধরা পড়ে তাদের গডফাদারা বাঁচাবে। তাছাড়া সমাজে কিছু অসুস্থ প্রকৃতির মানুষ চাকুরীর, বিবাহের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষন করছে।
আমাদের পুলিশ প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা, অভিভাবক, প্রবীনরা, সরকার, সম্মিলিতভাবে ধর্ষনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে অতীতে যেমন ব্যর্থ হয়েছে আজও হচ্ছে। গত কয়েক দশক ধরে গণমাধ্যমে প্রকাশ না পেলে, হইচই না হলে ধর্ষণ বা গনধর্ষণের মতো গুরুতরো অপরাধ গুলো নানা কারনে ধামাচাপা পরে যায়।
ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধ ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সমাজ মেনে নেয়। কারণ আমাদের দেশে অধিকাংশই রক্ষনশীল ও ধর্মভীরু মানুষ। ধর্ষণ কিম্বা নারী ঘটিত কোন ঘটনা পুরুষের পক্ষে চলে যায়। এমনকি নিজের পরিবার, আত্মিয়স্বজনরাও। মেয়ে শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী না হলে ক্ষতিগ্রস্ত নারীর উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পূর্ণ দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয়।
তার পোশাক, চলাফেরা, কেন সে অসময়ে বাসা থেকে বের হয়েছিল, সন্দেহ, অবিশ্বাস করা হয়। ধর্ষকেরা সাধারণত ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালী হয় বা তাদের আশ্রয় প্রশ্রয়ে ধর্ষণকারী সাহসী হয়ে উঠে। ধর্ষিতা দূর্বল হয়, সে কারণে সহজ শিকার হয়। ধর্ষণের ঘটনা প্রাথমিক ভাবে প্রমাণ কারার দায়িত্ব সরকার ও পুলিশ প্রশাসনের। কিন্তু ধর্ষণে সাক্ষিদের আদালতে হাজির না হওয়া, সাক্ষিদের প্রাণহানী ভয়ভিতি প্রদর্শন, অদক্ষ পুলিশ, আদালতে অপরাধী পক্ষের আইনজীবির বিব্রতকর প্রশ্ন, দীর্ঘ সময়ের পর মামলার প্রতিবেদন দাখিল, নানা কারনে ধর্ষণ মামলার আসামি খালাস পেয়ে থাকে।
তাছাড়া লোক জানাজানি হলে পরিবারের সন্মানহানী হবে এবং ভুক্তভোগীকে কেউ বিবাহ করতে চাইবে না, মামলা দীর্ঘসময় ধরে চলবে তাই ধর্ষিতা ও তার পরিবার চুপ থাকে। বেশিরভাগ সময়ে বিচার চাওয়া থেকে বিরত থাকে।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এখানো পুরুষ হয়ে জন্ম গ্রহন করলে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। সাধারনত পুরুষ বা ছেলে যা কিছু বলে বা করে তার পরিবার ও সমাজ সেটা মেনে নেয় ও বিশ্বাস করে। তাছাড়া ধর্ষণ প্রতিরোধের জন্য মায়েরা সমাজে তাদের দায়িত্ব একেবারে এড়িয়ে যেতে পারেন না। আন্দলোনটা ঘরের থেকে শুরু করতে হবে। সন্তানের বিবেক জাগ্রত করতে হবে, নৈতিকতার প্রথম শিক্ষা ঘর থেকে তারপর, বাইরের পরিবেশ।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সন্তান কোন বন্ধুদের সাথে মিশছে জানা এবং তাদের সাথে খোলামেলা আলাপ দরকার। পরিবেশ ও খারাপ সঙ্গদোষ ধর্ষক হতে প্রভাবিত করে। প্রশ্ন হলো যে সমাজে হিন্দুরা মা দুর্গার পূজা করে, মুসলিমরা মাকে আল্লাহর পরে সন্মান দেয় সেই সমাজে কিছু মানুষ অন্যের মা, বোন, কন্যাকে কি ভাবে ধর্ষন করে? সন্তান জন্ম দেওয়ার পর মাকে, নারীর প্রতি সন্মান করা শিক্ষা দিতে হবে। জনসচেতনতা, মূল্যবোধ, নৈতিকতার শিক্ষা দিতে হবে। কারোও ক্ষতি করা, সন্মানহানী করা, জুলুম, প্রতারণা করা অন্যায়। আর এর জন্য পরিবারের উপর যখন জবাবদিহিতা আসে তখন অযথা মিথ্যা যুক্তির আশ্রয় নিতে হয়।
সন্তানের সংগে বসুন, আলাপ করুন ধর্ষণের ফলে নারীর যে চিরস্থায়ী মনে ক্ষত হয়, সেটা বুঝান। ধর্ষিতা নারী কারও মা, বোন, কন্যা। একজন নারীর ছায়া তলে পুরুষ মানুষ বেড়ে উঠে, তাই প্রত্যেক মায়ের উচিত নারী ঘটিত যে কোন অপরাধ যে সমাজিক অপরাধ ও ঘৃণিত কাজ, সেটা বাল্যকাল থেকে সন্তানের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া, স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে সংযুক্ত করে এর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এখানে লজ্জার কিছু নাই।
মা তাঁর সন্তান, বোন তাঁর ভাই, কন্যা তার পিতার প্রতি অন্ধ থাকে, তাদের অপরাধ অন্ধদৃষ্টি দিয়ে দেখে। তাঁদের অপরাধ, অপরাধ বলে মনে হয় না। শুধু দেশের আইনি শাসন প্রতিষ্ঠার উপর কিম্বা সরকারের উপর নির্ভর করে থাকলে চলবে না। নারীদেরকে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গী বদলাতে হবে, সন্তানদের মূল্যবোধ শিক্ষা দিতে হবে। শুধু পুরুষের উপর একক ভাবে দোষ চাপালে চলবে না। ছেলে, ভাই, কিম্বা বাবা ধর্ষক হলে তাকে বলুন, প্রয়োজনে তার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করুন। আইনের হাতে তুলে দিন। সমাজ বদলে যাবে। ধর্ষণ কমে যাবে। মৃত্যুদন্ড ধর্ষণ নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট নয়।
লেখক: আলমগীর দারাইন, কলামিস্ট, ক্যালগেরি, আলবার্টা, কানাডা।
প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ১৫ নভেম্বের ২০২০/এমএম





